সাধারণ তর্কঃ
বাংলা ভাষায় লিখিত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র বহুল আলোচিত উপন্যাস ‘লালসালু। ‘ট্রি উইদাউট রুটস’ নামে উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ(বা অনুসৃষ্টি)সাধারণ পাঠকমহলে প্রায়-অনুচ্চারিত হলেও বর্তমান অধিপতি ধারার একাডেমিক-সাহিত্য-বাজারে হামেশাই এর দেখা পাওয়া যায়। উপন্যাসটির(বা উপন্যাস দুটির)কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম মজিদ। চরিত্রটি জটিল নয়, খুবই সাধারণ- অন্তত পণ্ডিতেরা তাই মনে করেন। মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত একজন মৌলভী বেঁচে থাকার তাগিদে কীভাবে নতুন একটি এলাকায় গিয়ে বসতি স্থাপন করে, কীভাবে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে সে তৈরি করে তার চারপাশের দুর্ভেদ্য ও শক্তিশালী ক্ষমতা-বলয়, কীভাবে গ্রামের মানুষের অজ্ঞতা আর কুসংস্কারের সুযোগ নিয়ে সে প্রতিষ্ঠা করে মাজার-সংস্কৃতিকে এবং কীভাবে এ মাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে তার ধর্ম ব্যবসা এবং প্রতিনিয়ত নিজের এসব কর্মকাণ্ডের জন্য কীভাবে এবং কত রকমে সে অনুশোচনায় কাতর হয় কিংবা কাতর হতে হতে কীভাবে সে হঠাৎ আত্ম-সচেতন হয়ে ওঠে এবং নিজের ধর্ম-ব্যবসাকেই আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আবার- এ সবকিছুই পণ্ডিতেরা আলোচনা করেছেন, করছেন।
তবে যে আলোচনাটি হয় নি বা আমাদের চোখে পড়ে নি তা হলো মজিদ’কে যারা সৃষ্টি করেছেন,টিকা ভাষ্য সহকারে আলোচনা করেছেন এবং ক্রমাগত পূনঃনির্মাণ করে গেছেন বিভিন্নভাবে বিভিন্নসময়ে তারা কোন ধরণের চিন্তা পদ্ধতি থেকে ‘মজিদ’ চরিত্রটিকে বিশ্লেষণ করেন,কেন করেন ,কীভাবেইবা করেন। বিশেষ করে, নিউলিবারেলিজমের যুগে বাংলাদেশে যখন আবার সম্পাদিত হচ্ছে ইংরেজি উপন্যাসটি, এবং পাঠ্য করা হচ্ছে দেশের নানা একাডেমীতে, তখন আমাদেরকে নতুন করে বিচার করতে হয়;- দেখতে হয়, উপন্যাসটিতে ইতর-বিশেষ কিছু আছে কিনা। আমরা আরো দেখতে চাই যারা মজিদকে প্রতারক ও ঠগবাজ হিসেবে মূল্যায়ন করছেন, তারা কোন চেয়ারে বসে আছেন। মজিদ ‘প্রতারক’, ‘ঠগবাজ’ বা ‘ভণ্ড’- এ কথা মেনে নিলেও আমরা জানতে ইচ্ছুক যারা মজিদকে ‘প্রতারক’ ও ‘ঠগবাজ’ বানাচ্ছেন তারা নিজেরাই ঠগবাজ ও প্রতারক নন তো? মজিদকে ‘প্রতারক’ ও ‘ঠগবাজ’ বানালে তাদের কোন লাভ হয় না তো? আমরা এ তর্কটি উত্থাপন করতে চাই। আমরা দেখতে ইচ্ছুক, ঠিক কোন অবস্থান থেকে আমরা আধুনিকেরা দোষী সাব্যস্ত করে চলেছি মজিদকে।
এ বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে নিতে আমরা বারবার ফিরে যাবো উপন্যাসটির ইংরেজি সংস্করণ ‘ট্রি উইদাউট রুটস’-এর দিকে,যদিও ‘লালসালু’তেও আমরা প্রত্যাবর্তন করবো মাঝে মাঝে। আমরা আরো বুঝতে চাই, সেই ১৯৬৭ সনেই ইউনেস্কো ঠিক কোন কারণে আগ্রহ পোষণ করলো এই উপন্যাসটির প্রতি এবং কোন ধরণের আগ্রহের জায়গা থেকে উপন্যাসটির ইংরেজি সংস্করণ ইউরোপে ছড়িয়ে দিতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলো। ১ ইউনেস্কোর ‘আগ্রহ’ ও ‘অনুপ্রেরণা’র জায়গাগুলোকেও আমরা ধরতে চাই।
পদ্ধতিগত তর্কঃ
শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাসে কিংবা ইতিহাসের ভেতর জায়মান শ্রেণীসংগ্রামের কারণেই পৃথিবীর ইতিহাস বিজয়ীর ইতিহাস হিসেবেই আবির্ভূত হয়। বলা চলে শ্রেণী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উঠে আসা বিজয়ীরাই ইতিহাস তৈরি করে।
সুনির্দিষ্টভাবে বললে, পৃথিবীর সামাজিক ও রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাস শক্তিমানেরই ইতিহাস। ক্ষমতা-কাঠামোর কেন্দ্রে যাদের বসবাস তারাই প্রতিষ্ঠা করে ‘কর্তৃত্বের ইতিহাস’কে। ইতিহাসের প্রত্যেকটি ধাপে ক্ষমতা-কাঠামোর পরিবর্তন পালটে দেয় অনেক কিছুকেই, অধীনতার এক নতুন ইতিহাস শুরু হয়। নতুন ক্ষমতা-কাঠামোর প্রান্তে যাদের স্থান হয়, যাদেরকে আমরা ‘প্রান্তীয়’ বলি কিংবা যাদেরকে শাসনাধীন রেখে শাসক শ্রেণীর কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়, সেসব ‘প্রান্তীয়’রাও প্রাক্তন ক্ষমতা-কাঠামোর প্রান্তীয়দের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে না। নতুন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এ ক্ষমতা-কাঠামো বদলে দেয় অনেক কিছু, বদলে যায় শাসক ও শোষিত শ্রেণীর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার নিয়ম কানুন।
আর এর মধ্য দিয়েই নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে ইতিহাসের সেই নির্দিষ্ট ধাপে তৈরি হওয়া প্রতিষ্ঠানসমূহ। প্রাক্তন ক্ষমতা-কাঠামোর সহগামী সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহের অধিকাংশই মুছে যায় ইতিহাসের নব-জন্মে;যেগুলো ক্রিয়াশীল থাকে তাদের মধ্যেও পরিবর্তন সাধিত হয়,নতুন ক্ষমতা-কাঠামোর সাথে খাপ খাইয়ে নতুন ভাবে বিন্যস্ত হয়ে যায় এগুলো;-কোন কিছুই আগের মতো থাকে না। মুছে যেতে থাকে এর ধারক বাহক আর প্রচারকেরা।
সংঘাতের ইতিহাসের এ ধারাপরিক্রমায় আমরা প্রান্তীয়রা কি চাই, কোথায় দাঁড়াতে হবে আমাদের এবং দাঁড়াবোই বা কেন আমরা? আমরাও কি চাই ক্ষমতা-কাঠামোর কেন্দ্রে চলে যেতে,আমাদের সবকিছুকে কী আমরাই নিয়ন্ত্রণ করতে চাই? যদি আমাদের উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয়, তবে আমরা তর্কটি নিয়ে ভাবতে পারি। সকলেরই জানা, উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অর্থনৈতিক স্বার্থের অনুকূল ‘ক্ষমতা-কাঠামো’ সব সময়ই ধ্বংস করে দেয় সংখ্যালঘিষ্ঠের শাসন-শোষণ ও ক্ষমতা-কাঠামোকে।
ফলে,শোষণবাদী শক্তি ও কাঠামোর উচ্ছেদ ঘটে। এর সাথে সাথে উচ্ছেদ ঘটে অধিপতি ধারার সংস্কৃতি ও সাহিত্যের এবং এ সংক্রান্ত সমস্ত মহান(!) তত্ত্বের। মজিদকে নিয়ে আলোচনাকালে আমরা এ ব্যাপারটি মাথায় রাখবো। এ ব্যাপারে সচেতন থেকে আরেকটি ব্যাপারকে অনুসিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করে নিতে চাই: বর্গীকরণ করার মধ্য দিয়ে যদি কোন একটি ‘বর্গ’কে প্রাধান্য দেয়ার চেষ্টা করা হয় কিংবা সে বর্গকে ‘মহান’ হিসেবে আখ্যায়িত করে যদি অন্যকে শাসন শোষণের পথ উন্মুক্ত করা হয়, তবে এর বিরোধিতা করা এবং একে প্রতিরোধ করাই আমরা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব বলে বিবেচনা করছি। এ আলোচনার শুরুতে আরো যে ব্যাপারটিকে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করতে চাই তা হলোঃ পুঁজির স্ফীতি পুঞ্জীভবন বা অন্য যেকোনো কারণে সামরিক শক্তিতে বলীয়ান কোন জাতির মনস্তত্ত্ব বা মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো এবং তার সাথে সংগতিপূর্ণ আপাত নিরীহ জ্ঞান, বিজ্ঞান, ধর্ম বা সংস্কৃতির যে উত্থান সেসব কিছুকে প্রশ্নহীনভাবে ‘বিকশিত’ বা ‘উন্নত’ হিসেবে মেনে নেওয়ার ভ্রান্তি থেকে মুক্ত হলেই কেবল আমাদের দিক থেকে পদ্ধতিগতভাবে সঠিক অবস্থানে থাকতে পারা সম্ভব।
নইলে আমরা ধাঁধাঁয় পড়ে যাবো;বুঝতে পারবো না কোথায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা। বুঝতে পারবো না, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এলিট মুসলমান সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কেন নির্মাণ করেন একটি শেকড়বিহীন বৃক্ষের কথকথা। যে পাশ্চাত্য শিক্ষায় তিনি দীক্ষিত হয়েছিলেন,সেই শিক্ষার পরতে পরতে লুকিয়ে আছে ‘অপর’কে ‘নির্মাণ’ আর ‘পুনঃনির্মাণ’ করার বাসনা এবং অপরের উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখার অভিলাষ। এই ‘অপর’ হতে পারে যে কেউ, যেকোন কিছু। এই ‘অপর’ হতে পারে আফ্রিকা বা এশিয়া কিংবা ল্যাটিন আমেরিকা’র মানুষ,সংস্কৃতি ও সমাজ।
এই ‘অপর’ হতে পারে ‘মজিদ’ আর তার তৈরী ‘মাজার’। আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে,এই ‘অপর’কে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করেন আমাদের দেশীয় বুদ্ধিজীবী্রা। আরো দেখতে হবে,কোন পরিস্থিতিতে এই ‘অপর’কে পুনঃপাঠ বা পুনঃনির্মাণ করার ইচ্ছা তৈরী হয় আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মনে।
মূল আলোচনা:
মূল আলোচনায় ফিরে আসা যাক। উপরের কথাগুলো বলে রাখলাম এ কারণে যে, একটি নির্দিষ্ট ভিত্তিভূমির উপর দাঁড়িয়ে যেকোনো কিছুকে বিচার বিশ্লেষণ ও খতিয়ে দেখতে গেলে পদ্ধতিসংক্রান্ত এ আলোচনাগুলো জরুরি।
পাশ্চাত্য জ্ঞান-তত্ত্বের আপাত নিরীহ ভালোমানুষি চেহারার পেছনে যে হিংস্র শক্তি ও উদ্দেশ্য কাজ করছে তা সম্বন্ধে সচেতন হয়েই ‘মজিদ’কে নিয়ে আলোচনার মাঠে নামতে চাচ্ছি। ‘ট্রি উইদাউট রুটস’ উপন্যাসটির অধুনা সংস্করণের সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন নিয়াজ জামান। ইংরেজিতে এর ভূমিকা লিখেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ২ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবী, তাঁর প্রজ্ঞার উপর আমাদের আস্থা আছে। সুতরাং তাঁর ‘ভূমিকা’ অংশের কিছু আলোচনা দিয়েই আমরা বিষয়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে চাই:
“The village is almost mythical; it is without connection with the world outside, it has no radio set; no newspaper reaches it; no school exists; even that favourite pastime of the Bengalis called politics, is absent. Life here is elemental. Even for backward Bengal such a village is exceptional. Making full use of his style, which is subtle, often ironical and always lively, the novelist compels our credence entirely”
তর্জমা: “(ট্রি উইদাউট উপন্যাসের) গ্রামটি বেশ কাল্পনিক; বাইরের পৃথিবীর সাথে এর কোন যোগাযোগ নেই।
গ্রামটিতে রেডিও নেই। কোন পত্রিকা পৌঁছায় না ওখানে, একটিও বিদ্যালয় নেই, এমনকি বাঙ্গালীর অবসর কাটানোর প্রিয় উপায় ‘রাজনীতি’ও সেখানে অনুপস্থিত। জীবন এখানে আদিম। এমনকি, পশ্চাৎপদ বাঙলায় এরকম গ্রামের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। ঔপন্যাসিক তার নিজস্ব শিল্প কুশলতা প্রয়োগ করে আমাদের চোখে এ গ্রামটির অস্তিত্বকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন।
উপন্যাসটির নির্মাণকৌশলে প্রায়ই আয়রনির দেখা মিললেও এর বর্ণনাভঙ্গি বেশ ঝরঝরে”।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সমাজবাদী ঘরানার বুদ্ধিজীবী হিসেবে আমাদের দেশে পরিচিত। সমাজবাদী ঘরানার যান্ত্রিক-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে মাঝে মাঝে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। তাদের অনেকেই চায়ের কাপে উড়ন্ত পোকা পড়ে যাওয়ার মতো ঘটনায়ও সাম্রাজ্যবাদের গন্ধ খুঁজে পান। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সে ধরণের বুদ্ধিজীবী নন।
‘ট্রি উইদাউট রুটস’ উপন্যাসের কাল্পনিক গ্রাম মহব্বতনগরে কোন রাজনীতি নেই বলে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দাবি করছেন। আমরা সে দাবি মেনে নেই। পুরো উপন্যাসের কোথাও কোন রাজনৈতিক প্রচার চোখে পড়ে না। গ্রামটির ভূ-স্বামীর নাম খালেক। আর অন্যরা তার জমির বর্গাচাষীঃ একদম সরলরৈখিক একটি প্রতিবেশ।
উপন্যাসের বর্ণনানুযায়ী, এই পরিবেশেই একদম উড়ে এসে জুড়ে বসে মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত মজিদ। তার হাতে আর মগজে আছে ধর্মগ্রন্থ কোরান। গ্রামের মানুষদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে সে একটি মাজার প্রতিষ্ঠা করে। গ্রামের বাইরের দিকে পরিত্যক্ত একটি কবরকে আশ্রয় করে গ্রামের ক্ষমতা-কাঠামোর মধ্যে শিকড় গাড়ে মজিদ ও তার প্রতিষ্ঠিত মাজারটি, অর্থাৎ এ গ্রামে বিরাজমান সাংস্কৃতিক আবহের মধ্যে থেকে গড়ে উঠে নি মাজারটি। একদম টুপ করে বৃষ্টি ঝরার মতো গ্রামের সাংস্কৃতিক-কাঠামোতে আবির্ভূত হয়ে শিকড় গেড়ে বসতে চায় মজিদ।
সে কর্তৃত্ব বিস্তার করতে চায় এবং মাজারটির মধ্য দিয়ে সে তার কর্তৃত্বকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সফল হয়। এই হলো মোটামুটি উপন্যাসটির মূল বয়ান। কিন্তু প্রশ্ন অন্য জায়গায়ঃ মজিদ এবং তার মাজারটি কি আসলেই এক ‘শিকড়হীন বৃক্ষ’-এটি কি আসলেই ‘ট্রি উইদাউট রুটস’? মজিদ গ্রামের মানুষদের ধর্মান্তরিত করে নি, ধর্মকে উপজীব্য করে নিজে বেঁচে থাকতে চেয়েছে, প্রতারণা করেছে গ্রামের লোকদের সাথে, বন্ধুত্ব করেছে ভূ-স্বামী খালেকের সাথে- যে খালেক ঐ গ্রামের ‘ক্ষমতা-কেন্দ্র’। অদ্ভুতভাবে, খালেকও নানাভাবে প্রতারিত হয়েছে মজিদের কাছে। অর্থাৎ উপন্যাসটির মূল টার্গেট হচ্ছে মজিদ এবং মাজার এবং মাজার সংশ্লিষ্ট ধর্ম ইসলাম।
গোটা উপন্যাসে ভূ-স্বামী ব্যাপারী খালেককে দেখানো হয়েছে অসাধারণ নিরীহ ব্যক্তি হিসেবে যে কিনা বারবার প্রতারিত হয় মজিদের কাছে, একইভাবে যেমন প্রতারিত হয় গ্রামের সাধারণ মানুষ। অর্থাৎ ভূ-স্বামী ও সাধারণ মানুষকে একই কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছেন ঔপন্যাসিক। মজিদের ‘ভিক্টিম’ দুটি শ্রেণী: ভূ-স্বামী ও ভূ-প্রজা। গোটা উপন্যাসে মজিদ উপস্থাপিত হয়েছে একমাত্র ‘প্রতারক’ হিসেবে। ভূ-স্বামী ‘খালেক’কে দেখানো হয়েছে নিরীহ অক্ষম ব্যক্তি আকারে! সেই জন্যই কি ইউনেস্কো এটি প্রকাশে এতো আগ্রহ পোষণ করলো? পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদীরা যে দেশে সাম্রাজ্য বিস্তার করে সে দেশেই কাজ করে জমিদার কিংবা ভূ-স্বামীদের পক্ষে।
কেননা, এরকম আধা সামন্তীয় সমাজ-কাঠামোতেই কেবল তারা স্বার্থ উদ্ধারে সক্ষম। ঐ সব দেশে যেন পুঁজিবাদ বিকশিত না হতে পারে সে কারণেই তারা লালন ও সমর্থন করে এই ভূ-স্বামী জমিদারদের। প্রান্তীয় দেশগুলোতে পুঁজিবাদ বিকশিত হলেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে আবার নতুন করে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে ঐসব দেশের পণ্য সঞ্চালন ব্যবস্থার সাথে। এ কথাগুলো নতুন নয়,সকলেই জানেন। দেখা যায়, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সবসময় এসব প্রান্তীয় দেশগুলোতে একদল ভৃত্য তৈরি করে যাদের গালভরা নাম ‘জমিদার’ বা ‘ভূ-স্বামী’।
একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটানো হয়;এবং এ রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে আমাদের মধ্যকার ক্ষমতা-সম্পর্ক। সাহিত্যের পাত্র পাত্রীরাও এর বাইরে থাকে না। এইখানেই ‘রাজনীতি’ আসে। রাজনীতি এইভাবেই গোপনে-অগোচরে কাজ করতে থাকে। সুতরাং অদৃশ্য রাজনীতির খেলাকে ‘নেই’ বলে উড়িয়ে দেওয়াটা যৌক্তিক নয়।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী হয়তো বলতে চেয়েছেন, আমাদের তথাকথিত দলবাজি রাজনীতির ক্রিয়াকাণ্ড মহব্বতনগর গ্রামে অনুপস্থিত। আমরা সিরাজুল ইসলামের ঐ বয়ানের এই পাঠই গ্রহণ করবো। আবারো শরণাপন্ন হই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর। তিনি লিখেছেনঃ
“Majeed is a veritable colonialist and an active missionary, the two rolled into one. He plants fear into the hearts of the innocent peasants, makes them feel guilty for their neglect of the patron saint. He becomes the ruler and seeks to transform the simple peasants, almost pagans in their life-style, into devout Muslims.”
তর্জমা: “মজিদ প্রকৃতপক্ষে একজন কলোনিয়ালিস্ট এবং সক্রিয় ধর্মযাজক;-তার মধ্যে এই দু’য়ের সমন্বয় ঘটেছে। নিরীহ কৃষকদের মনে সে ভয়ের বীজ ঢুকিয়ে দেয়, রক্ষাকর্তা পীরের প্রতি উদাসীনতার জন্য তাদের ভেতর তৈরি করে অপরাধবোধের।
প্রায় পৌত্তলিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত এই সাধারণ কৃষকদের নেতায় পরিণত হয় সে, তাদের বানাতে চায় ধর্মপ্রাণ মুসলমান”
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যখন মজিদকে ‘কলোনিয়ালিস্ট’ হিসাবে বয়ান করেন, তখন সত্যিকার অর্থেই ধাঁধায় পড়ে যাই। তিনি তৈরি করেন এমন এক ‘মজিদ’, যে মজিদকে মনে হয় সুদূর হতে আগত এক শোষক, যে নৃতাত্ত্বিক কিংবা সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিক থেকে দেশের জনগনের সাথে সম্পৃক্ত নয়। বিশেষত কলোনিয়ালিজম শব্দটির সাথে যতো রকমের ধারণা জড়িত আছে, সবগুলোকেই ভেঙে ফেলেন তিনি। তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মতো বারবার ভুল করে ভেবে বসেন, মজিদই ঐ সামাজিক বিন্যাসের মূল শক্তি-কেন্দ্র। অথচ, অন্তত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বুঝতে পেরেছিলেন যে, মূল শক্তি কেন্দ্র খালেক ব্যাপারীর কাছেই।
তাই বারবার তিনি মজিদকে টেনে নিয়ে যান খালেক ব্যাপারীর কাছে, যদিও তিনি নিজেও বিচারিক মামলা থেকে অব্যাহতি দেন ভূ-স্বামী খালেককে এবং প্রতারক মজিদের দিকেই তাক করেন নিশানা। মিশনারি কলোনিয়ালিস্টদের বুঝতে দৃষ্টি ফেরাতে পারি, “সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র সমসাময়িক আফ্রিকান লেখক চিনুয়া আচিবির ‘থিংক্স ফল এপার্ট’ উপন্যাসের দিকে। ‘লালসালু’ প্রকাশিত হওয়ার দশ বছর পর প্রকাশিত হয় এটি। আদিম ইগবো সমাজে কী করে শ্বেতাঙ্গ কলোনিয়ালিস্টরা খ্রিস্টান মিশনারি হিসেবে আবির্ভূত হয়ে সমাজে বিস্তার করে প্রভাব এবং সমাজকে ভেতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে দিতে থাকে, কী করে সমাজের অবচেতনে তৈরি করে দেয় খ্রিস্টান ধর্মের বৈধতা-সবই গল্পের আকারে তুলে এনেছেন তিনি। কলোনিয়ালিস্ট মিশনারি আর স্থানীয় ইগবো জনগোষ্ঠীর ভিন্নতা (রঙ, বর্ণ আর ধর্ম) এবং অর্থনৈতিক স্বার্থই নির্দেশ করে দ্যায় এদের মধ্যকার তফাত।
আচিবি দেখাচ্ছেন, কলোনিয়ালিজমের সাথে জড়িত থাকে ভিন্ন ভিন্ন অর্থনীতি রাজনীতি ও সংস্কৃতি্র মধ্যকার দ্বন্ধ সংঘর্ষ। কিন্তু সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এসবের কোন কিছুকেই আমলে নেন না। তিনি বাতিল করে দেন কলোনিয়ালিস্ট শব্দটির সাথে জড়িত অন্যান্য সমস্ত ধারণাকে। জনাব চৌধুরীর ‘কলোনিয়ালিস্ট’ ধারণাটির সংকীর্ণ ‘পাঠ’ কতোটা যৌক্তিক তা পাঠকের আদালতে সমর্পন করলাম;-বিশেষ করে,তিনি যখন উল্লেখ করেন যে, মজিদ একজন কলোনিয়ালিস্ট। যদি তিনি অযৌক্তিক হয়ে থাকেন, তবে এ সিদ্ধান্তে আসতে হয়, সমাজবাদী ঘরানার বুদ্ধিজীবী হয়েও তিনি ত্রুটিপূর্ণ ধারণা দিয়েছেন আমাদের।
আরো বলতে হয়, এ ধারণার বিকাশ ঘটলে মজিদ চরিত্রটি যে আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিন্যাসের আভ্যন্তরীণ ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ারই উপজাত সে সম্বন্ধে আমরা অসচেতন থেকে যাবে। আরেকটু আগালেই আমরা দেখতে পাই, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলছেনঃ
“In an odd, and somewhat ironical, manner, this village represents Bangladesh in miniature, particularly in respect of poverty and fundamentalism, which in fact go hand in hand, one helping the other, here as much as elsewhere.”
তর্জমা: ব্যাঙ্গাত্নকভাবে বর্ণনা করা হলেও আশ্চর্যজনকভাবে এই গ্রামটি বাংলাদেশেরই ক্ষুদ্র সংস্করণ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে-বিশেষ করে, দারিদ্র্য আর মৌলবাদের চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে। সত্যিকার অর্থে, দারিদ্র্য আর মৌলবাদ পরস্পর হাত ধরাধরি করে চলে-একে অপরকে সাহায্য করে চলে;- এখানে যেমন, অন্যখানেও তেমনি”
প্রথমত, উপন্যাসটির প্রকাশকালে ‘বাংলাদেশ’ নামে কোন দেশের অস্তিত্ব ছিল না, এ সম্বন্ধে সচেতন হওয়ার পরেও সিরাজুল ইসলাম বিরাট ভুল করে বসলেন। বর্তমান বাংলাদেশকেই যদি এ উপন্যাসের গ্রামটির বৃহৎ সংস্করণ হিসেবে ধরা হয়,তবে কি আসলেই আমরা এ রকম কোন চিত্র পাবো?বাংলাদেশের রাজনীতি সংস্কৃতি কী এরকমই?ইংরেজি শিক্ষার প্রতি কারো কোন আগ্রহ নাই নাকি বাংলাদেশে?সবাই আরবী ফার্সি পড়তে মক্তবে যাচ্ছে?সবাই পরিণত হয়ে গেছে মৌলবাদীতে?বাংলাদেশ কী তাহলে একটি মৌলবাদী দেশ? নাকি তিনি বুঝাতে চাচ্ছেন এই বাংলাদেশে এখনও জায়মান আছে মৌলবাদ, যার উৎপত্তি বাংলাদেশের জন্মেরও অনেক আগে?মৌলবাদ নিয়ে জনাব চৌধুরীর ধারণা কী?আমরা এর উত্তর খুঁজতে ইংরেজি উপন্যাসটির আদি পুস্তক ‘লালসালু’র শরণাপন্ন হতে পারি। সেখানে দেখা যায় শহর প্রত্যাগত এক উদ্যমী তরুণকে যে কিনা গ্রামে স্থাপন করতে চায় একটি বিদ্যালয় এবং চরমভাবে বাঁধাপ্রাপ্ত হয় মজিদ ও তার লোকজন দ্বারা।
পুরো উপন্যাসে পাওয়া যায় একটি তীব্রভাবে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলিম সমাজের প্রতিচিত্র যা কোনভাবেই মৌলবাদকে উপস্থাপন করেনা। মৌলবাদ ভিন্ন ব্যাপার, এর নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ও সক্রিয় তৎপরতা/ভাষা রয়েছে;-এর উৎপত্তির সাথে জড়িয়ে আছে বৈশ্বিক রাজনীতি ও সাম্রাজ্যবাদের নানামাত্রিক হিসাব নিকাশ। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ মৌলবাদী কিনা সে সম্বন্ধে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী নিশ্চয়ই সচেতন থাকতে পারতেন। তিনি তা করেননি, আর এভাবেই উপন্যাসের নয়া পাঠ শুরু হয়, তৈরি হয় ভিন্ন বয়ান। উপনিবেশ উত্তর বিশ্বে যখন জর্জ বুশ স্বঘোষিত ‘ক্রুসেড’ পরিচালনা করেন কিংবা পরিচালনা করেন ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’ তখনই, বুঝা যায়, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীরা এভাবেই ভুল করে পাতা ফাঁদে পা ফেলেন।
২০০৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে বসে তিনি যখন এ উপন্যাসের ভূমিকা লিখেন, তখন মৌলবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত পাশ্চাত্যের ভাবাদর্শ আর চেতনার জালেই কি বন্দী হয়েছিলেন? যে কারণে তাকে লিখে জানাতে হলো, বাংলাদেশে (যদিও তখন পূর্ব পাকিস্তান) মৌলবাদের উত্থান অনেক আগেই-সেই ১৯৪৮ সন কিংবা তারও কয়েক দশক আগে থেকে? অথচ কিছুক্ষণ আগেই তিনি বললেন, “এমনকি, পশ্চাৎপদ বাঙলায় এরকম গ্রামের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। ঔপন্যাসিক তার নিজস্ব শিল্প কুশলতা প্রয়োগ করে আমাদের চোখে এ গ্রামটির অস্তিত্বকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন”। তারপর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলছেনঃ
“Waliullah’s memorable observation, ‘There are more tupees than heads of cattle, more tupees than sheaves of grass’, reminds us of an abiding collaboration between poverty and religion”
তর্জমা: “ওয়ালীউল্লাহ’র অবিস্মরণীয় উক্তি ‘এখানে গবাদি পশুর থেকে টুপির সংখ্যা বেশি; শস্যের থেকে টুপি বেশি’ আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় দরিদ্রতা আর ধর্মের অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ককে”
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আলোচনায় একবার বললেন দরিদ্রতা আর মৌলবাদের সম্পর্ক নিবিড়, আবার খানিক বাদেই বলছেন, দরিদ্রতা আর ধর্মের মধ্যে রয়েছে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক! তাহলে কী ধর্ম আর মৌলবাদ সমার্থক শব্দ, বিশেষ করে সারা বিশ্বে যখন ইসলাম ধর্মকে মৌলবাদ ও সন্ত্রাসের সাথে এক করে দেখার পশ্চিমা প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হচ্ছে? জনাব চৌধুরী কী সেই প্রজেক্টের মতাদর্শিক ফাঁদেই পড়ছেন না?
‘মজিদ’ বা লালসালু বা ‘ট্রি উইদাউট রুটস সম্বন্ধে আলোচনায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে নিয়ে দুটো কথা বলতেই হলো, কেননা বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা কীভাবে ভাবেন, কীভাবে নির্মাণ করেন নতুন বাস্তবতা বা তত্ত্ব এবং কী করে সেসব কিছুকে মোকাবেলা করার পথ বাতলান, সে সম্বন্ধে আমাদের সচেতন হতে হবে। টেক্সটের মর্মার্থ যখন টীকা ভাষ্যে নির্ভর করে তখন দেখতে হয় কতোখানি বিশ্বস্ততার সাথে রক্ষিত হচ্ছে টেক্সটের অর্থ, ভাষ্যকার কোনদিকে নিয়ে যেতে চাইছেন এবং এর মধ্য দিয়ে আমাদের অবচেতনে কীসের বীজ বপন করতে চাইছেন। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ‘ট্রি উইদাউট রুটস’-নিয়ে জনাব চৌধুরীর মন্তব্য বরঞ্চ পশ্চিমা খ্রিস্টীয় সাম্রাজ্যবাদ ও মৌলবাদের সহ ও অনুগামী।
আমার বিবেচনা ভুল হলে আমি নিজেই স্বস্তি পাবো। ‘ভূমিকা’ নিয়ে শ্রদ্ধেয় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আর বেশিদূর আগান নি। তিনি কয়েকটি কথা বলে ভূমিকাটি শেষ করেছেন। কিন্তু এখানে আরেকটু আগানো যাক, তার আগে আবারো শরণাপন্ন হতে হচ্ছে জনাব চৌধুরীর’ই। তিনি বলছেনঃ
“The change in the title of the new version of Lal Shalu indicates a shift of emphasis from the shrine to its caretaker. Although it is well nigh impossible to separate the two, here the focus on the man is sharper than it was in the original novel.”
তর্জমা: “লালসালু’র নতুন সংস্করণের নাম পরিবর্তনই ইঙ্গিত করে উপন্যাসটি মাজারের উপর গুরুত্বারোপ না করে এর খাদেমের প্রতি নজর দিচ্ছে।
যদিও এ দুটোকে(মাজার ও খাদেম)পৃথকভাবে দেখাটা প্রায় অসম্ভব, তবুও মূল উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুর(মাজার)তুলনায় এ (ইংরেজি)উপন্যাসে খাদেমের উপর বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে)”
এবার আরেকটি প্রশ্ন, এ সমাজ-কাঠামোতে কি ‘মজিদ’ কোন এক প্রতিবাদের নাম যাকে গুরূত্ব দিয়ে দেখতে হবে, নাকি মজিদ এমন এক ধর্মীয় ঔষধের নাম যার কাছে পাওয়া যায় দুঃখ শোকের আধ্যাত্মিক নিবৃত্তি? কিংবা ঔপন্যাসিক যেমন দেখাতে চেয়েছেন সেরকমই কী আমরা ভাববো, মহব্বতনগর গ্রামের একমাত্র সমস্যা ‘মজিদ’ নামক মাজার ব্যবসায়ীটি? প্রশ্নটি নিয়ে একটু ভাবতে চাই।
বিদ্যা-বুদ্ধি বিক্রি করে যারা খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকেন তারা কি মনস্তাত্ত্বিক ভাবে পরিণত হন মধ্যবিত্তে? বাংলার উৎপাদন ব্যবস্থায় কি তাহলে মধ্যবিত্ত শ্রেণী হিসেবে ধরতে হবে কেতাব ও পুঁথি ধারীদের, নাকি বাংলার গ্রামীণ কাঠামোতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অস্তিত্ব ছিলো না তখন? যদি না থাকে, তবে কায়িক পরিশ্রম মুক্ত বুদ্ধি ব্যবসায়ীদের পরিচয় কী, সমাজে তারা কী ভূমিকা পালন করতো? সমাজ কেন মেনে নিতো এদের অস্তিত্বকে, শুধুই ভয়ে?নাকি অন্য কারণে? উপন্যাসে ফিরে যাই। মজিদকে মেনে নেয়ার সাথে সাথে কি গ্রামের মানুষ খালেকের সামনে একটি আলাদা ‘ক্ষমতা-বলয়’কে তৈরি করে দিচ্ছে না? খালেকও নিরীহ ভাবে ব্যাপারটিকে মেনে নিয়েছে, কেননা উপন্যাসের বয়ান অনুসরণ করলে দেখতে পাই, লেখক বুঝাতে চাচ্ছেন, খালেক এক নির্বোধ ভূ-স্বামী যার অতোখানি চালাকি নেই, যতটা ‘চালাকি-বুদ্ধি’ রয়েছে কেতাব পড়া মজিদের মগজে। ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’- প্রবাদখানা এমনি এমনি তো তৈরি হয়নি। খালেক মজিদের মতো চতুর হলে মজিদকে সে গ্রামে আমন্ত্রণ জানাতো ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যে কাজ করতো ভিন্ন এক কারণ।
কেননা ইতিহাসের পাঠ থেকে আমরা জানি ধর্ম-ব্যবসা আর ক্ষমতা-কেন্দ্র একই সাথে কাজ করতে পারে এবং দুটি শ্রেণী পরস্পরের উপর অনেক ক্ষেত্রে নির্ভরশীল। কিন্তু ঔপন্যাসিক বারবার দেখাচ্ছেন খালেক নিরীহ এবং বোকা, ফলে সে মজিদকে কাজে লাগাতে পারে না। উল্টা মজিদই খালেককে কাজে লাগায়,তালাক দিতে বাধ্য করে তার প্রথম স্ত্রী’কে আর এভাবেই ‘ট্রি উইদাউট রুটস’ উপন্যাসটি বিচারিক মামলা থেকে অব্যাহতি দান করে খালেককে এবং কাঠগড়ায় দাঁড় করায় মজিদকে। রাজনৈতিক ক্যাটাগরী হিসেবে ‘ভূ-স্বামী’ খালেক যেমন বৈধতা পায় গ্রামের মানুষের কাছে,ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ক্যাটাগরী হিসেবে ‘খাদেম’ মজিদও বৈধতা পায় তাদের কাছে। এ বৈধতার কনক্রিট আর্থ সামাজিক কারণ রয়েছে;রয়েছে এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য।
কিন্তু ওয়ালীউল্লাহ সেসব নিয়ে কথা বলার দায়ভার নেন না;তিনি কেবল ‘মজিদ’ নামের একটি চরিত্র তৈরী করেন যে চরিত্রটি বিদ্যা-বুদ্ধি আর আরবী-ফার্সী কেতাবের উপর নির্ভর করে জীবিকা অর্জন করে, টিকে থাকে পূর্ব বাংলার বাঙালী মুসলমান সমাজে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ দেখছেন, এ সমাজও ভেঙে যাচ্ছে;-তাঁর মতো অনেকেই শিক্ষিত হচ্ছে পশ্চিমা শিক্ষায়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহরা গড়ে উঠছেন পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত নাগরিক হিসেবে;-ইউরোপ হতে আমদানীকৃত কেতাবের ধারক বাহক হয়ে উঠছেন তিনি। ফলে,তিনি যখন হেজিমনি সৃষ্টি করতে চান ইউরোপীয়ান জ্ঞানতত্ত্বের,তখন তার চোখের সামনে পুরানা সমাজের কেতাব ধারীরাই ভেসে উঠে;তিনি অস্ত্র তাক করে থাকেন তাদের দিকে। রাজনৈতিক ক্যাটাগরি ‘ভূ-স্বামী’দের প্রতি তার কোন নজর থাকে না ;বরঞ্চ,এ রাজনৈতিক ক্যাটাগরীটিকে তিনি দেখেন খুব স্নেহের দৃষ্টিতে,এমনই নিরীহ করে নির্মাণ করেন চরিত্রটিকে যে কেতাবধারী মজিদ তার সাথে পর্যন্ত প্রতারণা করতে সক্ষম হয় নানাভাবে।
এটা খুবই স্বাভাবিক যে,এ যুগের শক্তিশালী পক্ষের কেতাবধারী হয়ে প্রথমেই দূর্বল আর পরাজিত পক্ষের কেতাবধারীদের গুলি করতে চাইবেন তিনি। ইতিহাস তো সে স্বাক্ষ্যই দেয়। মনে রাখতে হবে,জনাব ওয়ালীউল্লাহ যখন ‘লালসালু’ উপন্যাসটি লিখছেন বাঙলায় তখন তার বয়স মাত্র ছাব্বিশ;-হয়তো অবচেতনেই, জীবিকার জন্য তিনি পরিণত হচ্ছিলেন পাশ্চাত্য কেতাব ও জ্ঞানতত্ত্বের প্রচারকে। ১৯৬৮-তে যখন উপন্যাসটির ইংরেজি সংস্করণ বেরোয় ইউরোপে,ততদিনে ওয়ালীউল্লাহ বুঝে গেছেন যৌবনের সেই ‘লালসালু’তে তিনি বড়ো একটি ভুল করেছেন!খাদেম ‘মজিদ’ যতখানি গুরুত্বপূর্ণ ‘লালসালু’র মাজারটি কোন অর্থেই ততোখানি গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই নাম পরিবর্তিত হয় উপন্যাসটির;-কোন নিরীহ নাম নয় এটি।
বেশ ভয়ংকর নাম-‘ট্রি উইদাউট রুটস’। উপন্যাসটির নানা জায়গায় ঔপন্যাসিককে মনে হয় মজিদের প্রতি বেশ সহানুভূতিশীল,কিন্তু আমাদের প্রশ্ন থাকবে সে সহানুভূতি’র রকম-সকম প্রকার-প্রকরণই বা কি যখন তিনি ইংরেজিতে মজিদকে সংজ্ঞায়িত করেন ‘ট্রি উইদাউট রুটস’ বা ‘শেকড়বিহীন বৃক্ষ’ হিসেবে?সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র এ ধরণের পিঠ চাপড়ানো সহানুভূতি আসলে শেষমেষ শক্তিহীনের প্রতি শক্তিমানের শক্তি প্রদর্শনী রূপেই আবির্ভূত হয়। কেননা,ওয়ালীউল্লাহ জানেন,মজিদ পরাজিত শ্রেণীর কেতাবধারী;উপরন্তু প্রতারক। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র কাছে কী এমন শুদ্ধতম ইসলামের ‘বয়ান’ আছে যে ইসলাম আবির্ভূত হয় ‘মাজার সংস্কৃতি’কে ঘৃণা করার মধ্য দিয়ে?তিনি কি শুদ্ধতম ইসলামবাদী?
এখন প্রশ্ন, পশ্চিমা অধিপতি ধারার জ্ঞানকাণ্ড আসলে আমাদের কী শেখায়, আর আমরাই বা কি বুঝি? ওই জ্ঞানকাণ্ড কি আমাদের এটা বুঝায় যে, ‘মজিদ’ চরিত্রটি শিকড়হীন বৃক্ষ আর শিকড়হীন বৃক্ষকে উপড়ে ফেলাটাই জরুরি? কেন লালসালু বা ‘ট্রি উইদাউট রুটস’ পড়ার পর বিশ্লেষকরা মজিদকে কেবল ‘প্রতারক’ হিসেবে বিবেচনা করেন কিংবা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীরা লিখেন মজিদ হচ্ছে একজন sly imposter?৩ সামন্তীয় সমাজে আর্থ সামাজিক-সংস্কৃতি-রাজনীতির জটিল বিন্যাসের মধ্যে ভূ-স্বামীরাও শোষণ করেছে কৃষকদের-এটা তো গাণিতিক ভাবে প্রমাণযোগ্য। কৃষকের শ্রমের ফসলেই ওদের ভূরিভোজন।
তাহলে মজিদ যখন একইরকম বৈধ সামাজিক সাংস্কৃতিক বলয়ে নিজের অবস্থান দৃঢ় করছে তখন কি সেটা কেবলই প্রতারণা? নাকি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ঔপন্যাসিক মনে করেন, কেবল ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বলয়ের প্রতিনিধিকে ঘায়েল করলেই প্রগতিশীলতার উত্থান ঘটতে পারে? নাকি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র কাছেও একটা সাচ্চা আরবিয় ইসলামের বয়ান ছিলো যে বয়ানে মাজার ব্যবসায়ীরা প্রতারক হিসেবে পরিগণিত হন?
পণ্য-পূজার যুগে যখন আবির্ভূত হয় আধুনিক উন্নত সমাজের ধারণা এবং বলা হয়, পাশ্চাত্যের গতিময় সমাজই উন্নত সমাজ, তখন পাশ্চাত্য ফ্যাশনে জর্জরিত স্যুট টাই পরিহিত আমলা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কী ভুলে যান, তিনি যেসব চিন্তা-কাঠামোর অধিকারী তা গঠিত হয়েছে আরেক ধরণের কুসংস্কার থেকে, যে কুসংস্কার কেবল গায়ের জোরে শক্তিশালী বলেই প্রান্তীয় জনগোষ্ঠীর কুসংস্কারকে ‘কুসংস্কার’ হিসেবে গণ্য করে আর নিজেরটাকে মনে করে মহান? পাশ্চাত্য জ্ঞানকাণ্ডের যে উত্থান, তার মধ্যকার যে বিভিন্নতা, সবই সম্ভব হয়েছে ক্রমাগত শক্তির আকাঙ্ক্ষা থেকে, যে আকাঙ্ক্ষার বীজ নানাভাবে পরিপুষ্ট হয়েছে তাদের সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিবেশের মধ্যে। কিন্তু, তারপরও ক্ষতিকর কুসংস্কার থেকে যায়-এ থেকে মুক্তি দরকার মানুষের। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ যে অবস্থান থেকে কথা বলেছেন সে শিখরের আরোহীরা কখনোই প্রশ্ন করেন না, মজিদকে কেন আশ্রয় নিতে হয় প্রতারণার। আরবি, ফার্সি’র কর্তৃত্বকে এক ফুঁ’তে উড়িয়ে দিয়ে যে মহান (!) ইংরেজি শিক্ষার বীজ বপন করা হলো, তাতে বাংলার মুসলমান সমাজের কেতাবধারীরা জীবিকার প্রয়োজনে ক্রমাগত প্রতারকে পরিণত হবে-সে কথা বলাই বাহুল্য। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহরাও তখন একই ভুল করেন- পরাজিত শ্রেণীর কেতাবধারীদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখা শুরু করেন।
নয়তো প্রমাণ করে দেন, ওরা প্রতারক; এবং প্রগতিশীল সেই তরুণকে সামনে টেনে আনেন যে কিনা গ্রামে প্রতিষ্ঠা করতে চায় একটি বিদ্যালয়, যেখানে চর্চিত হবে পাশ্চাত্য গ্রেকো-রোমান-খ্রিস্টীয় ভাবধারার জ্ঞান; আর প্রতারক মজিদকে পরিণত করেন এমন এক কূপমণ্ডূকে যে কিনা গ্রামের মানুষদের নিয়ে বিরোধিতা করে এই বিদ্যালয়ের, ধর্মান্ধতে পরিণত করেন তাকে এবং সিরাজুল ইসলামরা এই ফাঁকে পেয়ে যান ধর্মকে ‘মৌলবাদ’ বলার সুযোগ। এতে কি এটাই প্রমাণিত হয় না, অধিপতি ধারার পশ্চিমা জ্ঞানতত্ত্বের চশমা পড়ে এবং জ্ঞানকাণ্ডে ঝুলে ঝুলে এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীরা সমালোচনা ও আক্রমণ করছেন শক্তিহীন প্রান্তীয় জনগোষ্ঠীর বুদ্ধি-ব্যবসায়ীদের? কোন অর্থে মজিদ প্রতারক এবং অধিপতি ধারার (কিংবা বলা যায়, পারমাণবিক বোমাবাজির জ্ঞানে সমৃদ্ধ) প্রতারকেরা ‘জ্ঞানী’ ও ‘সেক্যুলার?’
প্রশ্নগুলো উত্থাপন করে রাখা দরকার। সেই সাথে আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, যেকোনো ‘প্রতারক’কেই প্রতিহত করা প্রয়োজন- প্রতারক হতে পারে সেক্যুলার ইউরোপীয় কিংবা প্রাচ্যের ধর্ম ব্যবসায়ী কিংবা ভূ-স্বামী কিংবা এ জমানার পুঁজিপতি। কিন্তু তার জন্য যা দরকার তা হলো, যে সামাজিক সাংস্কৃতিক বিন্যাসের মধ্যে এদের উদ্ভব বিকাশ এবং বিস্তৃতি তার বিলোপ সাধন। যে প্রতিবেশে এই শ্রেণীগুলো বৈধতা পায় তার বিচার না করে ভাসা ভাসা চোখে দেখলে জয় হবে তাদেরই যারা শুভ্র মুখোশের আড়ালে বের করে রাখে নিজেদের লেলিহান জিহ্বা।
এই ২০০৫-এ নিয়াজ জামান আর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীরা যখন নতুন করে সম্পাদনা করছেন ট্রি উইদাউট রুটস’কে তখন আমাদেরকেও নতুন করে ভাবতে হবে। দেখতে হবে, উপন্যাসটি আমাদেরকে নতুন করে কী শেখাতে চাচ্ছে আর আমরাই বা এর নতুন কী ভাষ্য তৈরি করছি। পরিশেষে জানাতে চাই, ট্রি উইদাউট রুটসের ‘মজিদ’ ঝড় বৃষ্টি বন্যার পানিতে প্রায় ডুবতে থাকা সেই মাজার ও তার গৃহের কাছেই ফিরে যায়-স্ত্রীদেরকে রেখে আসে খালেক ব্যাপারীর বাড়িতে। মজিদ বুঝে ফেলে, মাজারের ধ্বংসের ভেতরই তার ধ্বংস নিহিত-মজিদের প্রাণ ভোমরা রক্ষিত আছে মাজারেই। উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার আগের বছর উদ্ভব ঘটে পাকিস্তানের।
যখন প্রথম অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয় (১৯৬৭) কিছুটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র হাতেই এবং এর প্রকাশনার দায়িত্ব নেয় ইউনেস্কো তখন পাকিস্তানের ভেতর ফাটল ধরেছে, নব্য বুর্জোয়া শ্রেণীর বিকাশ ঘটছে পূর্ব প।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।