রাস্তার পাশে ঝুপরিরর মত একটি পিঠার দোকান। আসবাব বলতে দুটি পা নড়বড়ে বসার বেঞ্চ, দুটি মাটির চুলা কয়েকটি মাটির খোলা, প্লাস্টিকের কটকটে রঙ এর কয়েকটি ছোট ছোট প্লেট, দুটি স্টিলের গ্লাস, পানি রাখার জন্য একটি নীল রঙ এর প্লাস্টিকের ড্রাম। পাশের নির্মানাধীন বিল্ডিং এর পানির লাইন থেকে দিনের নির্দিষ্ট কিছু সময়ে ছোট বাল্টিতে করে পানি এনে এ ড্রাম ভর্তি করা হয়। ঢাকা শহরে নিম্ন আয়ের মানুষ দের এ পানি খেতে কোন সমস্যাই হয় না। একজন শক্ত সামর্থ মহিলা সেখানে একটার পর একটা চিতই পিঠা বানিয়ে যাচ্ছে।
আর একটা চুলাতে লাল আটার রুটি। রুটি একবারে কয়েকটি বানিয়ে পলেথিন এ ভরে পুরোন খবর এর কাগজে মুরে রাখে। কেউ চাইলে সেটা আর একটু গরম করে দেয়। রুটির সাথে গুড় বা মশুরের ডাল থাকে। কেউ কেউ আবার ডিম ভেজে নেয়।
পিঠা রুটি ভাজা ক্রেতা সামলানো সব কাজ সারা দিন এ মহিলা একাই করে। সন্ধ্যায় যখন বেশি ভির হয় তখন তার স্বামিও তার কাজে সাহায্য করে। তাদের ৫ বছর বয়স এর ছোট ছেলে আর ১০ বছর বয়সের এক মেয়ে কে নিয়ে মোটামুটি সুখের সংসার বলা যায়। ছেলেমেয়ে দুটিকে মাঝে মাঝে দেখাযায় দোকানের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে বা দোকানের কাজে টুকটাক সাহায্য করতে।
ঢাকা শহররে শীতকাল টা তেমন বোঝা যায় না তবে শৈত্যপ্রবাহের কয়েকটি দিন একেবারে যেন শহর কে শীতে কাপিয়ে দিয়ে যায়।
মোড়ের ছোট ছোট পিঠার দোকান গুলোই যেন শীতের শুরুতে মনে করিয়ে দেয় শীত আসছে। তবে উপরে বর্নিত দোকান টি সারা বছর খোলা থাকে। সেমিস্টার শেষ তাই আপাদত ক্লাশ নেই। বাসায় সবাই নেইও শুধু আমি রাজিব আর এক ছোট ভাই। শীতের সকালে আগের রাতের দেরিকরে ঘুমানোর কারনে আলসেমো ছেড়ে বিছানা ছাড়তে দেরি হয়ে যায়।
উঠে ভাবতে হয় সকালের নাস্তা করব, না কি একটু দেরি করে সকাল দুপুর মিলিয়ে একবারে খেয়ে নেব। বশিরভাগ দিনই দুটো একবারে সারলেও মাঝে মাঝে এত বেশি পেট ডাকাডাকি করে যে সকালের খাবার জন্য এই এগার টা বা সারে এগারোটার দিকে নামতেই হয়। আমার বন্ধু রাজিব কে অনেক ঠেলে গুতে ঘুম থেকে তুলে সকালের খাবার জন্য বের হই। উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টরের সতের নম্বর রোডে ঢোকার মুখে বেশ কয়েকটি চা র স্টল থাকলেও খালি পেটে চা টা ঠিক ভালোলাগে না। তাই একটু এগিয়ে যেতে হয়।
এত বেলা করে কেউ অবশ্যই আমাদের জন্য সকালের খাবার নিয়ে বসে থাকে না। বড় বড় নাম করা রেস্টুরেন্ট গুলোতে সকালের নাস্তা করার মত পকেটের অবস্থা আমাদের নেই, এমন কি চৌরাস্তার মোড়ে রাধুনীতে নান রুটি আর কোয়ার্টার গ্রিল খেতে গেলেও পরবর্তি কয়েকদিনের হাত খরচ নিয়ে ভাবতে হয়। টিউশনির টাকা অ্যাসাইনমেন্ট আর রিকশা ভাড়া দিতেই শেষ । তাই উত্তরা লেকের উপর ১৩ নম্বর সেক্টরের ব্রিজ টা পেরিয়ে একটা নার্সারির পাশ দিয়ে যে ১৪ নম্বর সেক্টরে যে রাস্তা ঢুকেছে সেটা থেকে একশ গজের মত এগিয়ে গেলে সেই ঝুপরির মত ঘরটিই আমাদের খাবার উত্তম স্থান। সেখানে ভেজালের কোন সম্ভাবনা নাই।
আর মাঝে মাঝে কয়েকজন মিলে একটু নাম ধাম ওয়ালা রেস্টুরেন্টে খেতে গেলেও ওয়েটারদের চাকচিক্য ময় সুন্দর পোশাক অনুসারে টিপস দিতে পারি না সে জন্য আমাদের কেমন তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে। অবশ্য সেটা তারা খুব বেশি করে প্রকাশ করতে পারে না, এত গুলো উঠতি বয়সের গরম রক্ত ওয়ালা ছেলেদের সামনে এটা প্রকাশ করা বিপদ জনক সেটা তারা জানে। সে তুলনায় এ ঝুপরি ঘরে আমাদের বেশ খাতির করে। আমরাও বয়স অনুযায়ী খালা মামা পাতিয়ে ফেলি। তাদের সাথে কোন ভাব ধরতে হয় না শুধু দুটো আন্তরিকতার সাথে কথা বললেই সরল মানুষ গুলো আমাদের আপন করে নেয়।
খাতিরের নমুনা গুলো এরকম এই যে আমরা দেরি করে খেতে যাচ্ছি সেটা কোন সমস্যা না আমাদের জন্য রুটি ভেজে দেবে হয়ত তাদের নিজেদের খাবার থেকে একটু তরকারিরও ব্যাবস্থা করে দেবে। খাবারের দাম যে কম তা বলাই বাহুল্য, আর আর এমন নিহস্বার্থ ভালোবাসা এই ইট পাথরের শহরে কই পাব?
অনেক দিন হল ঢাকা শহরে বিভিন্ন এলাকার মানুষ দের সাথে কথা বার্তা বলে তাদের কথা শুনে তাদের বাড়ি কোন এলাকায় এটা অনুমান করা আমার একটা নেশার মত। কোন কারন নেই এমনি। কিছুদিন চেষ্টার পর এখন বেশিরভাগ সময়ই মিলে যায় আমার অনুমান। এ জন্য যে খুব বেশি ঘোরাঘুরি করতে হয় তা নয় হয়ত রিকশায় যেতে যেতে রিকশাওয়ালা কে জিজ্ঞেস করি “কি মামা বাড়ি কই?” এমন আর কি।
এই দোকানে খেতে খেতে অভ্যাস বসতই একদিন জিজ্ঞাস করলাম “ খালার বাড়ি কি গাইবান্ধা না কি?”
খালা এক গাল হেসে মাথা নাড়ে। আমাদের বাড়ি এই গাইবান্ধার পাশে হওয়াতে এর অনেক এলাকাই আমাদের চেনা। কথা বলার জন্য জিজ্ঞেস করি গাইবান্ধা কই বাড়ি? সে বলল গাইবান্ধায় গবিন্দগঞ্জ থানার একটা পশ্চিমে একটা গ্রামে। নামটা আমার ঠিক মনে নেই তবে রাজিব চিনতে পারল কারন ওর নানা র বাড়ির পাশের গ্রামে সেই গ্রাম টি। সব মিলিয়ে রাজিব বেশ গল্প জমিয়ে ফেলল।
সেদিন খাবার শেষ করে চলে আসলাম। আবার সন্ধ্যায় খালার হাতের স্পেশাল পিঠা খাওয়ার জন্য যাই। গিয়ে দেখি তার স্বামীও আছে দোকানে। খালা আমরা গেলে আমাদের দেখিয়ে দিয়ে বলল যে আমাদের বাড়িও তাদের এলাকায়। খালার স্বামী কে খালু ডাকার নিয়ম থাকলেও এই শহরে মামা ডাকটা বেশ চালু তাই ওনাকে মামা ডেকে রাজিব কথা বলল।
এই মামা আবার খুবই মিশুক কথা শুরু হলে থামতেই চায় না। মজিদ তার নাম। পাশের এক বৃদ্ধা তাকে মজিদ চেয়ারম্যান বলে ডাকছে।
রাজিব কে অনেক প্রশ্ন করে সে জেনে নিল ওর নানা র নাম কি? মামা রা কি করে তাদের পরিচয় ইত্যাদি। শেষে অকে একেবারে ভাগ্নে বানিয়ে ছাড়ল।
তার পর শুরু করল তার অতীত গল্প। সে বলল এরশাদের আমলে গ্রাম সরকার এর সদস্য ছিল পরে গ্রামের লোকজন জোর করে পর পর তিনবার চেয়ারম্যান হওয়া এক ব্যাক্তির সাথে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে দেয়। তার কথায় জোর করা মনে হলেও আসলে তা ছিল তোষামদ। লোকটা সহজ সরল, আর গ্রাম সরকারের সদস্য মানে মোটামুটি মানুষ জনের মাঝে থাকে। অনেকে যখন এভাবে চেয়ারম্যান পদের কথা বলেছে একটা লোভ না হয়ে কি পারে? মানুষ এর মন ত।
সেই উৎসাহে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে নিজের কয়েক বিঘা জমি বিক্রি করে ফেলে। নির্বাচনের আগের কিছুদিন অনেক লোকের যাতায়াত তার বাড়িতে। মুড়ি খাওয়া, পাতিলের পর পাতিল ভাত নামছে কে কে খাচ্ছে তার কোন ঠিক ঠিকানা নাই। বিড়ি সিগারেট ত যাচ্ছে পানির মত। সব শেষে দেখা গেল নির্বাচনে সে তার বাড়ির ভোট ছাড়া আর কিছুই পায় নি।
এদিকে সবই প্রায় শেষ। শোকে বেশ কিছুদিন বাড়ি থেকে বেড় হয় নি। পরে যখন একটু স্বাভাবিক হয়ে একটু বাহিরে বেড়োন শুরু করল তখন যে মানুষ গুলো আগে উৎসাহ দিয়েছিল দেখাগেলো তারাই নানা ব্যাঙ্গবিদ্রুপ শুরু করেছে। শান্তি মত কোথাও বসতেও পারছে না। অপমানে সে এক রাতে বউ কে নিয়ে ঢাকা চলে আসে।
সেই থেকে যাযাবর এর মত আজ এখানে কাল এখানে করে দিন কাটাচ্ছে। বাড়িতে এখন যায় মাঝে মধ্যে। কথা বলার সময় বাড়ির কথা মনে করে তার চোখে পানি ছল ছল করে ওঠে কিন্তু সে আর ফিরে যেতে চায় না। অপমান অভিমান সে আজও ভুলতে পারেনি।
এ মানুষ টির সাথে কথা বলে লোভি মনে হয়নি।
কিছু দুষ্ট মানুষ এর মিথ্যা তোষামোদ এর কারনে জীবন টা তার অন্যরকম হয়ে গেছে। হয়ত এটাই নিয়তি।
নির্বাচনের আগে মিডিয়া গুলোতে বলে এলাকায় উৎসব মুখর পরিবেশ এর কথা। আর এ উৎসব মুখর পরিবেশেই সাধারন মানুষ তাদের অধিকার এর কথা ভুলে যায়, যোগ্য ব্যাক্তির কথা ভুলে যায়। হুজুগে গা ভাসায় কোন এক মার্কার দিকে ।
সঠিক নেতৃত্ব বেছে তারা নেবে কিভাবে? বেশিরভাগ যায়গায় হয়ত সত্যিকার এর মানুষ এর কথা ভাবে এমন নেতাই এখন খুজেই পাওয়া যাবে না। হয়ত এটাই আমাদের নিয়তি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।