এখনকার বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীকেই পড়াশোনা নিয়ে লড়াই করতে হয় দাঁতে দাঁত চেপে। শেষ পর্যন্ত পড়াশোনা আর পরীক্ষার তীব্র চাপকে সহ্য করতে পারে যারা, টেনশনে জর্জরিত অবস্থায় তারা কোনো রকমে উতরে যায়। যারা পারে না, এত চাপ আর টেনশনে সর্বনাশ হয় তাদের। কেউ ডুবে যায় বিষাদ আর হতাশায়।
পড়াশোনার সঙ্গে জ্ঞানলাভের সেই সাবেকি সম্পর্ক চুকে গেছে অনেককাল।
এখন পড়াশোনা আর জ্ঞান অর্জন করা নয়, পড়াশোনা এখন রীতিমতো একটা যুদ্ধ। আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে মল্লযুদ্ধ। বড্ড অমানবিক আর হৃদয়হীন এই যুদ্ধের নিয়মকানুন।
ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষার ব্যবস্থা আজকের নয়, বহুকালের। পড়াশোনার চাপ আগে ছিল না তাও নয়।
তবে কেন গত দু-তিন দশক ধরে পড়াশোনার চাপ মাত্রা ছাড়িয়ে আছড়ে পড়ছে ছাত্রছাত্রীদের মনে? কেনই বা টেনশনে টেনশনে শুধু জেরবার নয়, ক্ষতবিক্ষত হতে হচ্ছে আজকের ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশকে? এক কথায় এর উত্তর হতে পারে একটাই। ’র্যাট রেস’। ইঁদুর দৌড়।
ছাত্রছাত্রীদের সংখা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে পড়াশোনার প্রতিযোগিতা আগের চেয়ে বেড়েছে সন্দেহ নেই। বাড়তে থাকা এই প্রতিযোগিতা হতে পারত মেধার, জ্ঞানের।
হয়নি। বেশি নম্বর পাওয়া আর বিষয়গত জ্ঞানের গভীরতা আজ আর সমার্থক নয় সবসময়।
জ্ঞানের গভীরতা নয়, আরও বেশি নম্বর পাবার জটিল কায়দাগুলো তৈরি হয়েছে। গত তিন দশকে শিক্ষার ভয়াবহ বাণিজ্যিকীকরণের হাত ধরে। এই বাণিজ্যিক ব্যবস্থার দৌলতে নম্বর হয়ে দাঁড়িয়েছে পড়াশোনা আর পরীক্ষার একমাত্র লক্ষ্য।
সরকারি বা সরকারি সাহায্য পাওয়া স্কুলগুলোর আজকের বেহাল অবস্থা বড়সড় সুযোগ করে দিয়েছে শিক্ষা ব্যবসায়ীদের হাতে। ইংরেজির মতো ভাষা নিয়ে অযৌক্তিক একগুঁয়েমি থেকে যে দ্বৈত শিক্ষাব্যবস্থার সূত্রপাত, সেই দ্বৈত ব্যবস্থা রয়েছে দেশের পড়াশোনা নিয়ে ইঁদুর দৌড়ের গভীরে।
বাণিজ্যিক ব্যবস্থায় শিক্ষাও পণ্য। পড়াশোনা দৌড়। দৌড় আরও বেশি নম্বর ঝুলিতে ভরার।
দৌড়ে সবার আগে শেষপ্রান্তের ফিতে ছোঁয়ার। মেধা, পরিশ্রমক্ষমতা বা সাধ্য যাই হোক। সবাই চাইছে সবার আগে বাড়তে। ইঁদুর দৌড়ে অনেক ইঁদুরকেই মুখ থুবড়ে পড়তে হয় মাঝরাস্তায়। র্যাট রেসে নামতে বাধ্য হওয়া ছাত্রছাত্রীদের বেলায় ঠিক এটাই ঘটছে।
শিক্ষা যেখানে পণ্য, নামকরা বেসরকারি ভালো স্কুলগুলোতে ভর্তির জন্য ভিড় হওয়া সেখানে স্বাভাবিক। ভালো রেজাল্টের দৌলতে কিছু স্কুল চিহ্নিত হয়ে গেছে ’ভালো স্কুল’ হিসেবে। ছেলে মেয়েদের এরকম স্কুলগুলোর একটাতে ভর্তি করার জন্য প্রত্যেক বছর হাজার হাজার বাবা মা লাইন দিচ্ছেন সারাদিন ধরে। এরকম স্কুলগুলো ছাত্রছাত্রী নেয় দেখে শুনে, এ্যাডমিশন টেস্টের বহর বা মানও হয় সেই অনুযায়ী।
ভর্তি হবার তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে প্রস্তুতির জন্য রয়েছে নানা ধরনের টিউশন কোর্স।
বাবা মায়েরা ছেলে মেয়েদের নিয়ে ছোটেন এইসব টিউটরের কাছে। এ্যাডমিশন টেস্টের মান অনুযায়ী এরকম টিউটররা মাত্রা ছাড়া চাপে রাখেন ছাত্র ছাত্রীদের। চাপের মুখে ছাত্রছাত্রীরা সহজেই আক্রান্ত হয় টেনশনে। শুধু পরীক্ষার প্রস্তুতির টেনশন নয়, চান্স পাওয়া না পাওয়ার টেনশন। বাবা মায়ের রণং দেহি মনোভাবই ছেলেমেয়েদের বুঝিয়ে দেয় চান্স না পেলে তার রক্ষা নেই।
ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা তথাকথিত ’ইংলিশ মিডিয়াম’ স্কুলগুলোতে ভর্তির জন্য এখন ছেলে বা মেয়ের বয়স তিন বা সাড়ে তিন হলেই চলে। সুইডেনের মতো দেশে সাত বছরের নিচে বাচ্চাদের অক্ষরজ্ঞান পর্যন্ত নিষিদ্ধ। ছ বছরের নিচে স্কুলে যায় না বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের বাচ্চারা। এ দেশেও এ ব্যবস্থা বহাল ছিল কয়েক দশক আগেও। এখন নিয়ন্ত্রণহীন স্কুল ব্যবসা দুধের শিশুদের হাজির করছে স্কুলের ক্লাসে।
বাচ্চাদের মন বোঝার বা ওদের উপযোগী করে ওদের শেখানোর শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ নেই এরকম বেশিরভাগ স্কুলের তথাকথিত শিক্ষক শিক্ষিকাদের। চাপের মুখে যখন তখন ভেঙে পড়ে শৈশবের স্বপ্ন। চাপ সইবার ক্ষমতা তৈরি হবার স্বাভাবিক পদ্ধতি বিপর্যস্ত হয় এইসব ছেলেমেয়েদের জীবনে। একটু বড় হয়ে অল্প চাপই উদ্বিগ্ন করে তোলে এদের, টেনশনে টেনশনে জীবন হয়ে পড়ে দুর্বিষহ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।