আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নারীমুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন

আমার সম্পর্কে বলার মতো কিছু নেই।

নারীমুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনঃ বেগম রোকেয়া সম্বন্ধে সবাই কমবেশি অবহিত ৷বেগম রোকেয়ার কর্মজীবন সাহিত্যিক ও সংগঠক এই দুই পর্যায়ে আলোচনার দাবী রাখে ৷ আর এই দুই পর্যায়ের আলোচনার মাধ্যমেই বেগম রোকেয়ার সমাজ-সংস্কারক রূপটি জীবন্ত হয়ে ওঠে। সমকালীন বাঙালী নারী সমাজকে অজ্ঞতা ও অসহায়ত্বের পঙ্ক থেকে উদ্ধার করার ব্রত রোকেয়ার সমগ্র সাহিত্যকর্মে প্রতিফলিত ৷সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ ও মতিচুর (দুই খণ্ড) গ্রন্থগুলি তাই প্রায় সকলের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে ৷তবে এরই মধ্যে কিছু কিছু লেখায় লক্ষণীয় কিছু ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য স্থান পেয়েছে ৷সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, যেমন, তাঁর রচনায় অন্যান্য প্রসঙ্গের সঙ্গে গুরুত্ব দিয়েছেন রোকেয়াকে বিদ্যাসাগরের সমপর্যায়ের বাঙালীর আসন দান করে ৷বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে বাংলাদেশে বেড়ে ওঠা মেয়েটির বিয়ে হয়েছিল বাংলার বাইরে বিহারের ভাগলপুরে ৷নিজের বাড়িতে যেমন উর্দু ভাষার জগতেই ছিল তাঁর বসবাস, বিবাহ-পরবর্তী সময়ে সেটা আরও শক্তপোক্তভাবে বেঁধে দিয়েছিল তাঁর জীবনকে ৷কিন্তু তা সত্ত্বেও, অধ্যাপক চৌধুরীর ভাষায়, "বেগম রোকেয়া উর্দুভাষী ভাগলপুরকে মোটেই ভালবাসেন নি ৷ কেননা তিনি আগাগোড়া বাঙালী, রবীন্দ্রনাথের মত, বিদ্যাসাগরের মত ৷" এই মতের পক্ষে লেখক অনেক কথাই বলেছেন তাঁর লেখায় ৷প্রতিভা-কৃতি ও গৌরবে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রোকেয়ার বিস্তর ব্যবধানকে স্বীকার করে নিয়েই অধ্যাপক চৌধুরী মানসগঠনের দিক দিয়ে তাঁদের দুজনকে একই কাতারে নিয়ে এসেছেন বাংলার দুঃখী মানুষের জন্য তাঁদের চির ক্রন্দিত অন্তরকে তুলে ধরেছেন ৷তিনি লিখেছেন, "কিন্তু নারীস্থানে প্রবেশ করে সুলতানা মুসলমান মেয়েদের কথা আলাদাভাবে ভাবেননি তাঁর মনে পড়েছে হতভাগ্য বাঙালীর কথা ৷সব বাঙালীর, গোটা বাঙালী সমাজের ৷ মনে প্রাণে বাঙালী তিনি।" আবার তিনি বলেছেন, "আসলে বেগম রোকেয়া বুঝি বিদ্যাসাগরকেও ছাড়িয়ে যান তাঁর বাঙালীত্বে; বিদ্যাসাগরের জগতে মুসলমানরা ছিল না, রোকেয়ার জগতে কেবল মুসলমানই নয়, হিন্দুও রয়েছে ৷'নিরীহ বাঙালী' কোন একটি ধর্ম সমপ্রদায়ের মানুষ নয়, উভয় সমপ্রদায়ের মানুষ ৷রোকেয়ার তারিণীভবনে কেউ অস্পৃশ্য নয়।" জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী'র লেখাতেও এই প্রসঙ্গের অবতারণা আছে, "... ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে রোকেয়ার তুলনা আমার কাছে অত্যন্ত স্বাভাবিক মনে হয় ৷শুধু শিক্ষা ও সমাজ ভাবনায় নিজ নিজ ক্ষেত্রে এঁরা পথিকৃত্‍ বলেই নয়, অসীম সাহস, চারিত্রিক দৃঢ়তা, চিন্তাজীবন ও কর্মজীবনের সমন্বয়- এসব দিক দিয়েও দুজনের মধ্যে মিল আছে ৷বিদ্যাসাগর... দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে জয়ী হয়েছিলেন; বেগম রোকেয়ারও ছিল পরিবেশগত প্রতিকূলতা, অবস্থানগত প্রতিকূলতা ৷তিনি ছিলেন এক অনগ্রসর সমাজের নারী যে সমাজে নারীর জন্য কোন ভূমিকাই নির্দিষ্ট হয়নি তখন পর্যন্ত ৷সে ভূমিকা তাঁকেই সৃষ্টি করে নিতে হয়েছিল, এবং সে কাজ কোন অংশেই সহজ ছিল না, বিদ্যাসাগরের কাজের তুলনায় ৷আমি সমাজসংস্কারক বিদ্যাসাগরের কথাই বলছি ৷সামাজিক বিরুদ্ধতায়, হিংসায়, সঙ্কীর্ণতায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন দু'জনেই, কিন্তু পরাজয় স্বীকার করেননি ৷" এই প্রসঙ্গে মোহিতলাল মজুমদারের রচনা থেকে দুটো লাইন উদ্ধৃত করা প্রয়োজন মনে করছি, "একালে হিন্দু সমাজেও এমন নারী চরিত্র বিরল ৷ কিন্তু তজ্জন্য হিন্দু আমি কিছু মাত্র লজ্জা বোধ করিতেছি না, কারণ বেগম রোকেয়া শুধুই মুসলিম মহিলা নহেন, তাঁহার জীবনবৃত্ত পাঠ করিয়া আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিয়াছে যে তিনি খাঁটি বাঙালীর মেয়ে ৷" আধুনিক কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার ও প্রখ্যাত ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা দুইটি মূলত বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ কৃত রোকেয়ার প্রথম জীবনীগ্রন্থ রোকেয়াজীবনীর মূল্যায়নে সীমাবদ্ধ থাকলেও রোকেয়ার সামগ্রিক রূপটিও তাঁরা লক্ষ্য করেছেন ৷সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় একই সঙ্গে জীবনীকার শামসুন নাহার মাহমুদ ও জীবনী গ্রন্থের নামচরিত্র সম্বন্ধে সংক্ষেপে ও সূক্ষ্মভাবে প্রশংসা করেছেন, "রোকেয়া জীবনী বাংলা সাহিত্য জগতে একটি মহিয়সী নারীর চরিত্র প্রতিষ্ঠা করিল বাঙালী পাঠক সমাজ এই চরিত্রের আদর না করিয়া পারিবেন না ৷" তবে লেখক ও সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দ-এর লেখায় বেগম রোকেয়ার কিছুটা খণ্ডিত পরিচয় উপস্থাপনের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় ৷তাঁর লেখা থেকেই উদ্ধৃত করছি, "১৯০৪ থেকে ৩২, এই আটাশ বছর ছিল বেগম রোকেয়ার সাহিত্যচর্চার কাল ৷তাঁর প্রথম প্রবন্ধ 'নিরীহ বাঙালী' (১৩১০ সালে প্রথম প্রকাশিত)। শেষ প্রবন্ধ 'নারীর অধিকার' (তাঁর মৃত্যুর পর ছাপা হয়েছে)৷ অন্তবর্তীকালে তাঁর মানস বহুলভাবে পরিবর্তিত হয়েছে ৷পরিবর্তিত এই রেখামালার শনাক্তিকরণই বর্তমান রচনার অভীষ্ট ৷" এই শনাক্তিকরণের কাজটি করতে গিয়ে তিনি বলতে চেয়েছেন যে, বেগম রোকেয়া মূলত এবং প্রধানত মুসলমান ৷রোকেয়ার সাহিত্য সৃষ্টির প্রথম ও শেষ দিকের কয়েকটি রচনার উল্লেখ করে মান্নান সৈয়দ মানুষ রোকেয়ার এই খণ্ডিত রূপটি স্পষ্ট করতে সচেষ্ট হয়েছেন ৷এরজন্য তিনি রোকেয়ার রচনা থেকে যেমন উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন তেমনই অপর এক বিদগ্ধ সমালোচক গোলাম মুরশিদের বক্তব্যের অংশবিশেষ উল্লেখ করেছেন ৷ নারীর মানবিক অধিকারকে অস্বীকার করার জন্য ধর্মের আত্মাকে বাদ দিয়ে ধর্মের বহিরঙ্গের খোলসের প্রয়োগের বিরুদ্ধে রোকেয়ার লেখনী আজীবন সোচ্চার ছিল ৷রোকেয়ার নিজের ভাষাতেই, "ধর্মে যে সামাজিক আইনকানুন বিধিবদ্ধ আছে আমি কেবল তাহারই আলোচনা করিব, সুতরাং ধার্মিকগণ নিশ্চিন্ত থাকুন ৷" এবং সমগ্র জীবনব্যাপী তিনি এই নীতিতেই বিশ্বাসী ছিলেন বলেই আমরা জানি ৷এরপর তাঁর মুসলমান পরিচয়ের জন্য পৃথক কোন প্রয়াসের প্রয়োজন আছে কি? মালেকা বেগম তাঁর লেখায় সঙ্গত ও বাস্তবসম্মত এক প্রশ্ন তুলেছেন, "রোকেয়া সাখাওয়াত মানববাদী ৷মানবাধিকারের প্রবক্তা তিনি, এখনো কি আমরা তাঁকে চিনবো না সঠিক পরিচয়ে?" চিনবো না কেন? সুস্থবুদ্ধির শিক্ষিত নারীসমাজ তথা নরসমাজ যদি অনুসন্ধিত্‍সু মন নিয়ে রোকেয়া সমগ্র সাহিত্যকর্ম পাঠে নিবিষ্ট হন, তবে কি রোকেয়াকে মানববাদী না ভাবার কোন বিকল্প কেউ খুঁজে পাবেন? নারীর উন্নয়নই তাঁর জীবনবাণী আর নারী তো মানুষই! এক্ষেত্রে লেখিকার নিজের বক্তব্য উল্লেখযোগ্য, "রোকেয়ার সকল কাজ, আত্মনিবেদনের সঠিক লক্ষ্য ছিল মানুষের কল্যাণ সাধন ৷অবরোধবাসিনীর মুক্তি, নারীর দাসত্বমুক্তি, এসবের অর্থ নয় কি মানুষের মুক্তি?" তাহলে? এই মতবাদ প্রসঙ্গে আর একজন লেখকের নাম উল্লেখ করতে হয় ৷ ইতিহাসবিদ সালাহউদ্দীন আহমেদও তাঁর আলোচনার শেষে লিখেছেন, "নারীর অধিকারকে মানবাধিকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখতে হবে ৷" বেগম রোকেয়াকে তাই অবশ্যই মানববাদী বলতেই হবে ৷অধ্যাপক সালাহউদ্দীনের লেখায় আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ আছে। রোকেয়ার মতিচুর গ্রন্থটি যাঁরা পড়েছেন তাঁরা লক্ষ্য করে থাকবেন অলঙ্কার সম্বন্ধে লেখিকার কী ঘৃণা ও তিক্ত মতবাদ সেখানে ব্যক্ত হয়েছে ৷ এই অলঙ্কার-প্রীতি আমাদের দরিদ্র সমাজের জন্য এক অভিশাপের নামান্তর ৷সালাহউদ্দীন আহমেদের প্রবন্ধে উল্লেখ আছে যে, নারীদের মধ্যে হীনমন্যতাবোধও বেগম রোকেয়া সমালোচনা করেছেন; বিশেষ করে অলঙ্কারের প্রতি নারীদের মাত্রাধিক আকর্ষণকে তিনি দাসীসুলভ মনোভাব বলে মনে করতেন ৷রোকেয়া তাঁর অনবদ্য ভাষায় লিখেছেন, "কারাগারে বন্দীগণ পায়ে লৌহনির্মিত বেড়ী পরে, আমরা (আদরের জিনিষ বলিয়া) স্বর্ণরৌপ্যের বেড়ী অর্থাৎ 'মল' পরি ৷... কুকুরের গলায় যে গলাবন্ধ (dog collar)দেখি, উহার অনুকরণে বোধ হয় আমাদের জড়োয়া চিক্ নির্মিত হইয়াছে ৷... গো-স্বামী বলদের নাসিকা বিদ্ধ করিয়া 'নকদড়ী' পরায়, এদেশে আমাদের স্বামী আমাদের নাকে নোলক পরাইয়াছে ৷" এই অলঙ্কারপ্রীতি তথা দাসী মনোভাব কি আমরা বাঙালী মেয়েরা উপেক্ষা করতে পেরেছি? প্রয়াত মোহাম্মদ নাসির উদ্দীনের লেখায় বেগম রোকেয়ার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত্‍কারের চমৎ‍কার বর্ণনা পাওয়া যায় ৷পর্দার আড়াল থেকেই রোকেয়া তাঁর আলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন জনাব নাসির উদ্দীনের সঙ্গে ৷ এক পর্যায়ে তিনি জিজ্ঞেস না করে পারলেন না, "আপনি প্রগতিপন্থী মহিলা অথচ পর্দার ভিতরে থেকেই কথা বলছেন?" এর উত্তরে রোকেয়ার আজীবন বাহ্যিক অর্থে পর্দা মেনে চলার সপক্ষে তাঁর বক্তব্য খুবই তাৎ‍পর্য পূর্ণ, "পর্দা মানে অবরোধ নয়, কিন্তু আমি যে অনিচ্ছাকৃতভাবে অবরোধবাসিনী হয়েছি তার কারণ অনেক ৷আমার স্কুলটা আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় ৷একে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমি সমাজের অযৌক্তিক নিয়মকানুনগুলিও পালন করছি ৷... স্কুলের জন্য মেয়ে আনতে যাই, কিন্তু অভিভাবকরা আমাকে আগেই জিজ্ঞেস করেন পর্দা পালন করা হয় কিনা?... স্কুলের জন্য আমি সমাজের সব অবিচার অত্যাচার সহ্য করে চলেছি ৷" তাঁর জীবনব্যাপী সাধনায় বৃহত্তর কল্যাণের জন্য, কিছু কিছু ব্যাপারে এভাবে অসঙ্গতির সঙ্গে আপোসের কি করুণ প্রচেষ্টা! ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত শামসুননাহর মাহমুদ রচিত রোকেয়াজীবনী গ্রন্থের 'মুসলিম বঙ্গে নারী আন্দোলন' অংশে, ভয়ঙ্কর ভাবে প্রতিকূল বিপ্রতীপ অবস্থার মধ্যেও রোকেয়া কিভাবে তাঁর স্কুল বা সংগঠন 'আঞ্জুমানে খাওয়াতীন ইসলাম বাঙ্গলা'র কাজকর্ম পরিচালনা করতেন সে-বিষয়ে বেগম মাহমুদ রোকেয়ার সরস কৌতুকপূর্ণ অথচ দৃঢ়চেতা মনোভাব তুলে ধরেছেন ৷"তখন একবার বাহির হইতে অকারণে সামান্য বিরুদ্ধ সমালোচনা শুনিয়া একটু বিচলিত হইয়াছিলাম, সে সময়ে তিনি হাসিয়া বলিয়াছিলেন, 'যদি সমাজের কাজ করিতে চাও তবে গায়ের চামড়াকে এতখানি পুরু করিয়া লইতে হইবে যেন নিন্দা গ্লানি, উপেক্ষা অপমান কিছুতে তাহাতে আঘাত করিতে না পারে; মাথার খুলিকে এমন মজবুত করিয়া লইতে হইবে যে ঝড়ঝঞ্ঝা বজ্র বিদ্যুত্‍ সকলই তাহাতে প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া আসে ৷' এই একটিমাত্র কথার মধ্যে যেন আমরা এক নিমেষে তাঁহার জীবনের ইতিহাস খুঁজিয়া পাই ৷বাস্তবিকই চিরদিন তাঁহার গাত্রচর্ম ও মস্তকের আবরণে কেবলই আঘাতের পর আঘাত বর্ষিত হইয়াছিল ৷" 'যখন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলে শিক্ষক ছিলাম' রচনায় স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মেহেরুননেসা ইসলাম নিজের জীবনেরও এক চমকপ্রদ কাহিনী শুনিয়েছেন, "... আমার জন্ম ১৯২১ সালে... শুনেছি আমার জন্মের পর নানীদাদীরা সমস্বরে আর্ত চীৎ‍কার করে বলেছিলেন, 'আরে এই যে মাইয়া... মুখে নূন দিয়ে মেরে ফেল ৷' পরিবারের চতুর্থ কন্যা হিসাবে এ ছিল আমার পাওনা একথা অস্বীকার করার পথ নেই ৷আমার জন্মদাত্রী আমাকে বুকে চেপে আগলে রেখেছিলেন, মারতে পারেননি ৷" এভাবে মেহেরুননেসা শুধু যে বেঁচেই গিয়েছিলেন তাই নয়, রূপকথার গল্পের মতোই ক্রমান্বয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে চাকরীজীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার অসাধারণ সুযোগও তিনি পেয়েছিলেন ৷আর সেই সূত্রেই কালক্রমে, রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষায়তনে চাকুরী করার সুযোগ ও সৌভাগ্যও হয়েছিল তাঁর ৷এই স্কুলের তৎ‍কালীন বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায় তাঁর লেখায় ৷এই জাতীয় তথ্যসমৃদ্ধ বেশ কিছু লেখা গ্রন্থটির গুণী সমাজে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করেছে নিঃসন্দেহে ৷ মেহেরুননেসা ইসলামের সৌভাগ্যের মত সৌভাগ্যলাভের গর্ব আর একজনের লেখাতেও প্রতিফলিত ৷শিক্ষাবিদ আনোয়ারা বাহার চৌধুরী লিখেছেন, "আমার সৌভাগ্য যে আমি তাঁর জীবনকালে তাঁর স্কুলের ছাত্রী ছিলাম ৷আমার সৌভাগ্য যে, আমি তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুলে শিক্ষকতা করেছি ৷ আমার সৌভাগ্য যে, আমি তাঁর প্রতিষ্ঠিত মহিলা সমিতি আঞ্জুমানে খাওয়াতীন ইসলামের সম্পাদিকারূপে ১৯৩৮ সন থেকে ১৯৪৭ সন পর্যন্ত কাজ করেছি ৷" সত্যিই তো এতগুলো সৌভাগ্যজনক কাজের সুযোগ একাধারে পাওয়া কারো জন্য সত্যিই মহাসৌভাগ্য স্বরূপ ৷ রোকেয়ার সাহিত্যকর্ম সম্বন্ধেই প্রায় সবাই আলোচনা করেছেন কম-বেশি কিন্তু সুদক্ষিণা ঘোষের সুপরিসর লেখায় এই সাহিত্যসম্ভারের যে বিস্তারিত সামগ্রিক আলোচনা পাওয়া যায় তা আর কোন লেখায় নেই ৷ সাখাওয়াৎ রাষ্ট্রীয় উচ্চতর বালিকা বিদ্যালয়ের বর্তমান গৌরবের কিছু পরিচয় পাওয়া গেল লীনা সেনগুপ্তের লেখায় ৷ "...সেই সঙ্গে একটি আনন্দের বার্তা শুনলাম তা'হল বিদ্যালয়ের ছাত্রী লোপামুদ্রাগিরি সে বছর (১৯৯৫) মাধ্যমিক পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে ৷ প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য ১৯৯৪ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষাতেও মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছিল আমাদেরই ছাত্রী শ্রী ধারা গুপ্ত ৷" এই লেখারই অপর একটি অংশ, "...আজ অবধি বর্তমান বিদ্যালয় মূলত বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত পরিকাঠামোর উপরেই দাঁড়িয়ে আছে ৷বাহ্যিক চেহারার কিছু পরিবর্তন হয়েছে মাত্র_কিছু সংযোজন ও বিয়োজনের মধ্য দিয়ে নব কিশলয় আজ বিরাট মহীরুহে পরিণত হয়েছে ৷" স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থা, কড়া নিয়মকানুন, বিভিন্ন শিক্ষিকার বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন সোমা ঘটক "দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিয়মকানুন লেখাপড়ায় কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় দুঃখ করে বলতাম, 'তাহলে আমরা কথা বলব কখন? ... কথা বলব ক্লাসে নয়, বাসে নয়, লাইনে নয় ৷' ইদানীং কালের (খুব সম্ভব) ৫ম শ্রেণীর ছাত্রী চিরশ্রী কর্মকার কবিতায় লিখেছেন, "লেখাপড়া ছাড়াও জেনো খেলাধুলা সেবায়/ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিত্য চলে হেথায়/ উর্দু এবং বাংলা এই দুটি বিভাগে/ দিদিদেরই শাসন স্নেহ সবার প্রাণে জাগে ৷" 'বেগম রোকেয়ার বিজ্ঞান চিন্তা' রচনায় সুব্রত বড়ুয়া লিখেছেন বস্তুত বিজ্ঞানচিন্তার মধ্যে যে বিষয়টি প্রধান তা বৈজ্ঞানিক তথ্য আহরণ ও উপস্থাপন নয়, বরং বৈজ্ঞানিক যুক্তি-শৃঙ্খলার মাধ্যমে নির্মোহভাবে সত্যানুসন্ধান ৷বেগম রোকেয়ার জীবন ও কর্মে সাহিত্য চিন্তায় এর দৃষ্টান্ত প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না ৷সুব্রত বড়ুয়া এ প্রসঙ্গে যথার্থভাবেই ড. মুহম্মদ শামসুল আলমকে উদ্ধৃত করেছেন, "পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন শাস্ত্রের প্রগাঢ় প্রভাব রোকেয়ার বিভিন্ন রচনায় লক্ষণীয় ৷তাঁর সমসাময়িক কোন লেখিকার মধ্যে তো নয়ই, পুরুষদের লেখাতেও এমন বিশুদ্ধ বিজ্ঞানচর্চার তেমন নিদর্শন তখন দেখা যায়নি ৷ 'সৌরজগত্‍' 'পদ্মরাগ' প্রভৃতিতে প্রচুর বিজ্ঞান প্রসঙ্গ উপস্থাপিত হয়েছে ৷... বিজ্ঞানের সুস্পষ্ট প্রভাব, বিশেষভাবে মুদ্রিত হয়েছে Sultana’s Dream -এ ৷" সবশেষে, পারিবারিক সদস্য মাজেদা সাবেরের লেখায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়৷ এর একটি হল রোকেয়ার জন্মতারিখ ৷ মাজেদা সাবের লিখছেন, "কেউ নিশ্চিতভাবে জানে না তাঁর জন্মের সন, তারিখ ও মাস ৷শামসুন নাহার মাহমুদ লিখেছেন ১৮৮০ সনে তাঁর জন্ম ৷ রোকেয়া অবরোধবাসিনীর ২৩ নং নকশায় লিখেছেন তাঁর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন বড় বোন করিমুননেসার ছোট ছেলে আবদুল হালিম গজনভীর বয়স ছয় ৷আবদুল হালিম গজনভীর জন্ম হয় ১৮৭৬ সনে ৷ এ হিসাব রোকেয়ার জন্ম হয় ১৮৭৭, ১৮৮০ নয় ৷" বিয়ের ব্যাপারে খুবই মর্মস্পর্শী বর্ণনা পাওয়া যায় মাজেদা সাবেরের লেখায় ৷একটু বড় হলেও উদ্ধৃতি দেবার লোভ সংবরণ করতে পারছি না ৷ "দীর্ঘদেহী সাখাওয়াতের গায়ের রং ছিল ময়লা ৷ ছিল একজোড়া গোঁফ ৷ আর মাথায় চুল ছিল বেশ কম ৷ কপালের দিকটা প্রায় খালি হয়ে এসেছিল ৷এক কথায় বলা যায় কোন অবস্থাতেই সাখাওয়াৎ সুপুরুষ ছিলেন না ৷পক্ষান্তরে রোকেয়া ছিলেন অপূর্ব মুখশ্রী, দেহসৌষ্ঠব ও গাত্রবর্ণের অধিকারী ৷ "মানুষ মাত্রেই তার নিজের বিয়ে নিয়ে স্বপ্ন দেখে ৷ মেয়েরা বোধ হয় একটু বেশিই দেখে ৷পায়রাবন্দের জমিদারের মেয়ে রোকেয়াও নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখেছিলেন, পঙ্খিরাজে চড়ে টগবগিয়ে তরুণ সুদর্শন রাজপুত্র আসবে, গলায় মতির মালা, মাথায় হীরার মুকুট ৷কোমরে সোনার তলোয়ার ৷ কিন্তু না, সেসব কিছুই নয় ৷রোকেয়ার স্বপ্নের রাজপুত্র পঙ্খিরাজে চড়ে এলেন না, তিনি এলেন বিদ্যার জাহাজে করে আরো বিদ্যাদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ৷... রাজপুত্রের স্বপ্নকে রোকেয়া বিসর্জন দিলেন মাত্র ১৮ বছর বয়সে, তাঁর জীবনের অন্য একটা বড় ও মহৎ স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য ৷রোকেয়া এই বিয়েতে রাজী হলেন ৷" রোকেয়ার ব্যক্তিজীবনের এই সূক্ষ্ম বেদনাবহ ঘটনা পাঠকের মনে আরও কষ্টের জন্ম দেয় যখন মাজেদা সাবের লেখেন, "রোকেয়ার মা (খুব সম্ভবত বাবাও) পাত্রের বয়স ও রূপ সম্বন্ধে অবগত ছিলেন না ৷বিয়ের আসরে জামাই দেখে তাঁর মা অজ্ঞান হয়ে যান ৷এবং জ্ঞান ফিরে এলে বলেছিলেন, 'আমার ছেলেরা আমার সাথে বেঈমানী করেছে ৷ আমার সবচাইতে সুন্দর মেয়ের জন্য তারা সবচাইতে কুৎসিৎ পাত্র ঠিক করেছে ৷ আমি ওদেরকে কোনদিন মাফ করব না ৷' স্বামীর সঙ্গে রোকেয়ার বয়সের ব্যবধানও স্বাভাবিক ছিল না ৷ রোকেয়ার যখন বিয়ে হয় বিপত্নীক সাখাওয়াতের বয়স তখন প্রায় চল্লিশ আর রোকেয়ার বয়স তখন ১৮ (মতান্তরে ১৬)৷" মাজেদা সাবেরের লেখা থেকে রোকেয়ার ব্যক্তিজীবনের এই জাতীয় টুকরো টুকরো ঘটনা পাঠকের মনে স্বভাবতই এক অব্যক্ত বেদনাবহ বিস্ময় সৃষ্টি করবে ৷ কারণ ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে নিজে উদ্যোগী হয়ে রোকেয়া কোথাও কিছু বলেননি ৷বরং অনুরুদ্ধ হয়েও তিনি একবারই লিখেছিলেন, "আমার জীবন? অতি নগণ্য, 'কুকুরের কাজ নাই, দৌড় ছাড়া হাঁটা নাই' আমি সেই নিষ্কর্ম কুকুর ৷" অন্যত্র ব্যক্তিগত এক চিঠিতে রুদ্ধ ক্ষোভের কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় ৷ "আমার মত দুর্ভাগিনী অপদার্থ বোধ হয় এ দুনিয়ায় আর একটা জন্মায়নি ৷ শৈশবে বাপের আদর পাইনি ৷ বিবাহিত জীবনে কেবল স্বামীর রোগের সেবা করেছি ৷ দু'বার মা হয়েছিলুম, তাদেরও প্রাণ ভরে কোলে নিতে পারিনি ৷ আমি আমার ব্যর্থ জীবন নিয়ে হেসে খেলে দিন গুনছি ৷"

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.