আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"নারীমুক্তি" যখন বন্দিদশার পয়গাম: উন্নয়নের ডিসকোর্স এবং বাংলাদেশের "সিভিল" ক্যু[১]



[শিরোনামের ঈষৎ বদল সমেত লেখাটি নারী ও প্রগতি পত্রিকার ৪র্থ সংখ্যায় প্রকাশিত] সঙ্গত কারণেই পাবলিক জবান আমার ক্রমাগত আগ্রহের জায়গা হয়ে উঠেছে। সেটা কেবল এই কারণেই নয় যে, শাসন প্রতিষ্ঠায় সম্মতি বা কনসেন্ট সংক্রান্ত গ্রামসীয় বিশ্লেষণ[২] বাংলাদেশে স্বল্প আলোচিত, তবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। অন্য কারণ প্রথমটার সঙ্গে সম্পর্কিত। সম্মতির নিবিড় এক প্রক্রিয়া ও লণ হিসেবে পাবলিক জবানকে গুরুত্ব দেয়া আমি জরুরি বলে মনে করি। এসূত্রে, পাবলিক জবান সম্মতির ফলাফল বটে, কিন্তু আবার অনুঘটকও।

চূড়ান্ত বিচারে, সম্মতি ও পাবলিক জবানের সম্পর্ক আমার বিবেচনায় ডায়ালেক্টিক। এক হিসেবে বর্তমান ক্ষুদ্র রচনাটি ২০০৭-এ বাংলাদেশে সাধিত ক্যু-কে বিশ্লেষণের একটা প্রচেষ্টা। তবে সেই দাবিকে নথিভুক্ত করতে আমি অনিচ্ছুক। সেটা মোটেই এই কারণে নয় যে বাংলাদেশে বর্তমান জরুরি অবস্থায় কিছু কাজকর্মে বিধিনিষেধ জারি আছে, যদিও, অনস্বীকার্য, বিধিনিষেধে ভয় পাওয়া আমাদের পেশাগত কর্তব্য। বাংলাদেশের বর্তমান ক্যু-কে বিশ্লেষণ করতে চাইলে পাবলিক জবানের অধিকন্তু বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার আনদেখা বিষয়গুলোর রাজনৈতিক-অর্থশাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা করা অত্যাবশ্যক।

[৩] সেটা এই রচনায় করা হচ্ছে না। সেসূত্রেই, ক্যু বিশ্লেষণের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা এটা নয়। বরং আমার ল্য এমন একটা যাত্রাপথকে নির্দেশ করা যেখানে উন্নয়ন-ডিসকোর্স ক্যুকে অনুমোদন করছে, যেখানে উন্নয়নকারী ‘সিভিল সমাজ’ বরং ক্যু-এর একটা জোরাল অংশীদার (স্টেকহোল্ডার), যদি স্থপতি নাও হয়; এবং পরিশেষে নারী উন্নয়ন/মুক্তি প্রসঙ্গ সেই উন্নয়ন-ডিসকোর্সের অন্যতম বনিয়াদ। অধুনা বাংলাদেশের পরিচয় বা সত্তা গঠনে দুটো ধারণা কেন্দ্রীয়, এর বাক্সময় পরিমণ্ডলের কথা বিবেচনা করলে দুটোই ডিসকার্সিভ। একটা হচ্ছে ‘বাংলাদেশে তো নারীদের অবস্থার “উন্নতি” হচ্ছে’ এবং দ্বিতীয়টা হচ্ছে ‘বাংলাদেশে তো সীমাহীন দুর্নীতি হচ্ছে।

’ দুনিয়াব্যাপী জবর প্রমাণাদির হালফিল মোচ্ছবে এর একটা নিয়েও মোকাবিলা করা দুরূহ। বর্তমানের মিডিয়াস্কেপিক বাস্তবতায়[৪] এগুলো হচ্ছে এমন ধরনের প্রস্তাবনা/প্রোপোজিশন যার বিপ্রতীপ কিছু দাঁড় করানোর জন্য অবারিত কোনো ত্রে অবশিষ্ট থাকে না। সেই হিসেবে এগুলো শর্তাতীত প্রস্তাবনা। আমার ধারণা দুটো প্রস্তাবনাতেই নীতিবাগীশ ধারণার উচ্চভার এগুলোকে মরাল বানিয়েছে -- যথাক্রমে ‘উন্নতি’ এবং ‘দুর্নীতি’। এই দুই ডিসকোর্স এ সংক্রান্ত ধারণাদির বনিয়াদ রচনা করেছে; এতটাই শক্তভাবে যে ধারণাগুলো পরিশেষে প্রচারণায় রূপান্তরিত।

আপাতঃশ্র“তিতে এই জোড়াবচন পরস্পর স্বতন্ত্র এবং নিঃসম্পর্ক লাগতে পারে। কিংবা এ দুয়ের সম্পর্ক বড়জোর ‘দুর্নীতির কারণে উন্নতি বিঘিœত হচ্ছে’ ধরনের আরেকটি প্রচারণায় সীমিত, যে প্রচারণা পূর্বতনগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত এবং স্বীয় ডিসকোর্স-পরিেেত্রর জোরে বাংলাদেশে, ও বিশ্বে, প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আমার আগ্রহ আলোচ্য দুই ধারণার মধ্যকার জরুরি সম্পর্কটাকে নির্দেশ করা। আমার বিবেচনায় ধারণা দুটো পরস্পরের শর্তসাপে। খতিয়ে দেখলে, এমনকি, একটাকে অন্যটার যৌক্তিক প্রগমন (লজিক্যাল প্রগ্রেস) হিসেবে শনাক্ত করা সম্ভব।

‘দুর্নীতি’ এখানে একটা লোক্যাল/স্থানীয় প্রবণতা ও ব্যবস্থা হিসেবে চিত্রিত; এবং ‘উন্নয়ন’ একটা গ্লোব্যাল/বৈশ্বিক কাক্সা ও অর্জন হিসেবে ব্যক্ত। দুর্নীতির স্থানীয় কেন্দ্রগুলো বৈশ্বিক শিক্ষা-ও-প্রচেষ্টায় (একত্রে প্রজেক্ট বলেও চালানো সম্ভব) যেনবা উৎখাত হচ্ছে/হবে। দুর্নীতি পরিসীমিত হয়ে পড়ছে ‘ট্র্যাডিশন’ হিসেবে, আর উন্নয়ন প্রক্ষেপিত হচ্ছে ‘গ্লোবেলাইজেশন’, তাই [ট্র্যাডিশন থেকে] ‘ইম্যানসিপেশন’, হিসেবে। [৫] এই কাঠামোগত সম্পর্কের বাইরে ‘উন্নয়ন’ আর ‘দুর্নীতি'কে দেখা সম্ভব নয়। সঙ্গত কারণে, এই ধারণাগুলোর অনায়াস গ্রাহক না-হওয়া; এবং এই ডিসকোর্সগুলির সপ্রশ্ন তদন্ত জরুরি বলে বিবেচনা করি আমি।

এটা নিশ্চয় কাকতালীয় যে বাংলাদেশের ক্যু কিংবা ‘জরুরি অবস্থা’ এবং অধ্যাপক ইউনূসের নোবেলপ্রাপ্তি কাছাকাছি সময়ে ঘটেছে। কিন্তু এটা কাকতালীয় নয় যে অধ্যাপক ইউনূস ভোটাভুটির সংসদীয় রাজনীতিতে প্রত্য অংশ নেবার সিদ্ধান্ত নেন তাঁর নোবেলপ্রাপ্তির পর। এটাও কাকতালীয় নয় যে সেই সিদ্ধান্ত তিনি মাসাধিক কালের মধ্যেই প্রত্যাহার করে নেন। [৬] প্রত্যাহার করে নেয়াতে তাঁর মতা কমেছে নাকি বেড়েছে সেটা স্বতন্ত্র জিজ্ঞাসা; এবং প্রাসঙ্গিক। নিজেকে নিয়ে অধ্যাপক ইউনূসের উচ্ছ্বাস এবং আত্ম-অবয়ব মিডিয়াকৃত করতে তাঁর নিয়মানুগ প্রচেষ্টা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বটে, তবে বর্তমান আলোচনায় প্রাসঙ্গিক অধ্যাপক ইউনূসকে ঘিরে পাবলিকের উচ্ছ্বাস এবং তাঁর প্রকল্প বিষয়ে বৈশ্বিক পাবলিক জবান নিয়ে।

[৭] সাম্প্রতিক দু’ দশকে গ্রামীণ ব্যাংক সমেত দেশি-বিদেশি এনজিও’র ুদ্রঋণ কর্মসূচির বদৌলতে ‘নারী উন্নয়ন’ বহুল চর্চিত প্রসঙ্গ। এই কর্মসূচিতে যে ঋণগ্রহীতা হিসেবে নারীকে ‘টার্গেট’ করা হয়েছে কেবল তাই নয়, অধিকন্তু দরিদ্র নারীর ঋণগ্রহণকে উন্নয়নের একটা বৈশ্বিক সূচক হিসেবে পেশাদার অর্থশাস্ত্রে সিদ্ধ করা হয়েছে। অবশ্যই যাকে উন্নয়নশীল বিশ্ব বলা হয় সেসব রাষ্ট্রে। গ্রামীণ ব্যাংক এই প্রচেষ্টার অগ্রদূত হিসেবে গৃহীত হয়েছে। খানিক পর্যবেণের পর বিশ্বব্যাংকের মতো কর্তৃত্বশীল প্রতিষ্ঠানসমূহ একে অনুমোদন করেছে এবং একটা মডেল হিসেবে উৎসাহ দিয়ে আসছে।

বহু রাষ্ট্রে, স্থানীয় ও বহুজাতিক উদ্যোগে, একাধিক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্রঋণ চালু করেছে। গড়পড়তায় এসব উদ্যোগের মুখ্য ‘টার্গেট’ নারী। বলা হচ্ছে, সেসব প্রতিষ্ঠান ব্যাপক সাফল্য পাচ্ছে এবং উন্নয়ন হচ্ছে। [৮] এগুলো এখন জ্ঞাত প্রসঙ্গ। যে বিষয়টা এখানে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, খুব সাধারণ সমাজবিজ্ঞানীয় পর্যবেণগুলোও আড়াল হয়ে যাচ্ছে এই ডামাডোলে।

নারীর এই ধরনের ‘মুক্তি’ গার্হস্থ্য শ্রমের দীর্ঘকালীন নিগড় থেকে তাকে কিছুমাত্র সরায়নি, বরং তার শ্রমপ্রদানের ত্রে পরিবর্ধিত করেছে এবং সেই ক্ষেত্রের একচ্ছত্র জগন্নাথ হিসেবে ব্যাংক (পুঁজিবাজার) ও পণ্যবাজারকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। নারীমুক্তি বলে যে বিষয়টার প্রচারণা চলছে, বিশ্লেষণ করলে, তাকে [সীমিত পরিসরে] পণ্যখরিদ সামর্থ্যরে বেশি কিছু হিসেবে মালুম হয় না। কিন্তু এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হচ্ছে পাবলিক জবানে নারীমুক্তির প্রসঙ্গ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এর মূর্তদলিল হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, অধ্যাপক ইউনূসকে কেন্দ্র করে। নোবেলপ্রাপ্তির মতো মিডিয়া ইভেন্ট পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া থেমে ছিল না। তবে নোবেল পুরো প্রক্রিয়াটার সম্ভাব্য সর্বোচ্চ বৈধতা নিশ্চিত করেছে।

কাঠামোগত শর্তাদির কথা বিবেচনা করলে, বাংলাদেশের নারীর ‘মুক্তি’ সংক্রান্ত ডিসকোর্স গুরুতরভাবে সম্পর্কিত ‘পশ্চাৎপদতা’র ডিসকোর্সের সঙ্গে। সেটা, সাম্প্রতিক বিশ্বে, ইসলামের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। জরুরি অবস্থা ঘোষণার আগের কয়েক বছরে, যুগপৎ আওয়ামী ও চারদলীয় শাসনামলে, বাংলাদেশে অনেকগুলো হামলা বাহ্যতঃ ইসলামের জুজুবুড়িকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। ফলতঃ বাংলাদেশ প্রসঙ্গে দেশে ও বিশ্বে পশ্চাৎপদতার বৌদ্ধিক প্রকল্প ইসলামের সঙ্গে একাকার হয়ে যাবার আর কোনো বাধা থাকেনি। এসব হামলার স্থপতি প্রত্য ও পরোভাবে কোন কোন শক্তি ছিল তা বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক আমলে একটু আধটু জানা গেলেও তা নিয়ে বিস্তারিত জানতে চাইবার কোনো পাবলিক তাগিদ ল্য করা যায়নি।

কিংবা শাসক তরফে বিস্তারিত করবার কোনো ল্য আছে এমন প্রমাণও নেই। বরং সন্ত্রাসের থিসিসটার বিশ্বব্যাপী আধিপত্যের মধ্যে নিরাপদে থেকে যাওয়ার তাগিদ বিশেষভাবে ল্য করবার মতো। মিডিস্কেপিক বাস্তবতার সূত্র ধরে এটাও অনুমান করা অসম্ভব নয় যে কোনো প্রতিষ্ঠান -- ধরা যাক প্রেসের কোনো অংশ, তেমন সম্ভাবনা ক্ষীণ যদিও, তাও -- থিসিসটাকে মোকাবিলা করবার মতো তদন্তনির্ভর প্রতিবেদন হাজির করলেও প্রতিষ্ঠিত ‘সত্যে’র ভিন্ন কিছু দাঁড় করানো সম্ভব নয়। এই সমগ্র বাস্তবতাটি অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে ভাবা জরুরি। এতে করে একটা সুস্পষ্ট সংজ্ঞায়িত ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ শক্তি হিসেবে বর্তমান শাসকগোষ্ঠী বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে কেবল তাই-ই নয় বরং প্রত্য শাসকগোষ্ঠীর সহচর সিভিল সমাজ নিজের আশু সাফল্য হিসেবে ‘মৌলবাদ’-বিজয়কে চিহ্নিত করে কৃতিত্বের ঊজ্জ্বলতা বহন করতে পারে।

খেয়াল রাখা দরকার, কমবেশি দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের সিভিল সমাজ এর সংজ্ঞায়িত মৌলবাদের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধ চালিয়েছে। এমনকি গণ-আদালতের প্রোপটকে সিভিল সমাজের অবয়বনির্মাণ কাল বিবেচনা করলে ‘মৌলবাদ’ই এর পয়লা এজেন্ডা ছিল। বাংলাদেশের মতো সাধারণত শ্লথগতির বিচারপ্রক্রিয়ায় যেরকম দ্রুত ধৃত জঙ্গীদের ফাঁসি দেয়া হলো তাতে এই ধারণা কেবল পোক্তই হতে পারে। অধিকন্তু, মৌলবাদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের মীমাংসাকে ঝুলিয়ে না রেখে নতুন এজেন্ডা ঘোষণা করার সুযোগ এতে তৈরি হয়েছেÑধরা যাক ‘দুর্নীতি দমন’ -- সঙ্গে নতুন মাত্রার ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পের বনিয়াদ রচনা গ্লোব্যাল উন্নয়নবাদীদের সাহচর্যে। নারীমুক্তির ডিসকোর্স নয়া ভাষাভঙ্গি/আইডিয়ার রাজত্বের দিকে একটা প্যাসেজ হিসেবে কাজ করেছে এবং এর একটা অবিচ্ছেদ্য স্তম্ভ হিসেবে বিদ্যমান আছে।

নতুন মাত্রার ‘উন্নয়ন’ বলতে এখানে যা যা ভাবা যেতে পারে তার ব্যাপকতা আছে। বিষয়টা কেবল দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ‘টার্গেট’ করে কিছু কর্মসূচি নয় বরং রাষ্ট্রীক বৃহদায়তন খাতগুলোকে সুনির্দিষ্ট বিধিব্যবস্থার আওতাধীন করা এবং এর উপর নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর কর্তৃত্বকে নিরঙ্কুশ করে তোলা। এই তালিকায় থাকতে পারে বন্দর লিজ দেয়া থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক পার্ক বানানো, তেল/কয়লা ত্রেগুলোর স্বত্বাধিকার রাষ্ট্র থেকে কর্পোরেটে হস্তান্তর থেকে শুরু করে কেমিক্যাল হাব প্রতিষ্ঠা, কনস্যুমার ব্যাংকিংয়ে ঋণের মোচ্ছব করা থেকে শুরু করে নয়া নয়া ভোগ্যপণ্যের স্থানীয় বিপণনকারদের বেলাগাম বাড়তে দেয়া ইত্যাদি। এই তালিকার বড় একটা অংশ যে পাবলিক জবানের আলোচিত বিষয়ও হবে না সেটা অনুমেয়। [৯] এভাবে, পাবলিক জবানের গতিপথ বা ট্রাজেকটরি নিয়ে বিশ্লেষণ করলে ‘নারীমুক্তি’ সাম্প্রতিক কালের একটা বনিয়াদ ধাপ।

কার্যতঃ দুইভাবে বন্দিত্বের পয়গাম পাই আমরা। প্রথমটা, যেমনটা বলেছি সাধারণ সমাজবিজ্ঞানীয় পর্যবেণ, নারী শ্রমের উপর বাজারের নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে। দ্বিতীয়টা এই রচনার ভাবনাকেন্দ্রে ছিল। সেটা হচ্ছে: উন্নয়নের অন্যতম শক্তিশালী ডিসকোর্স হিসেবে ‘নারীমুক্তি’ বৃহদার্থে উন্নয়ন প্রকল্পসমূহকে বৈধতা দান করেছে; এই বৈধতাদান ‘উন্নয়ন’ অনুঘটকদের বহুজাতিক ও জটিল একটা চক্রকে আস্থাশীল করেছে নিজেদের সামর্থ্যের বিষয়ে এবং নয়া নয়া প্রকল্পের সম্ভাবনা উদ্ঘাটন করতে। ঢাকার ‘সিভিলসমাজ’ পাবলিক জবানে যে পোক্ত সম্মতিলাভ করেছে তাতে জটিল বহুজাতিক সেই চক্রের স্থানীয় রূপকার হিসেবে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করবার অধিকতর স্থায়ী জমিন পেয়েছে।

সেনাবাহিনী কতটা সামনে বা আড়ালে আছে সেটা বর্তমান ‘জরুরি অবস্থা’র আদৌ কোনো মুখ্য প্রসঙ্গ নয়। বর্তমান ক্যু’টা চরিত্রবিচারে ‘সিভিল’। [১০] [ফাইল শুরু মার্চ মাসে জাপান থাকাকালীন। পরিশেষে লেখা হলো জুন ২০০৭॥ ২১.০৬.০৭] টীকা ১। এই বিষয়ে আমার ভাবনা হাজির করার জন্য, এবং তর্ক/আলাপ দাঁড় করাতে, পয়লা প্রচেষ্টা ছিল এ বছরের জানুয়ারি মাসে, বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা জারি করবার অল্প কিছু পরেই।

এ কথা ঠিকই যে দৈনিক পত্রিকায় আমি অংশ নিতে চেষ্টা করিনি, এবং সেটার স্বতন্ত্র প্রোপট রয়েছে। ফলে বিষয়টাকে প্রধান দৈনিকগুলো জায়গা দিতে তৈরি ছিল কিনা সেটা খতিয়ে দেখার কোনো সুযোগ হয়নি। বরং লেখকদের একটা ইমেইল ফোরামে আমি হাজির হই। আলাপ-আলোচনা যদি নাও হতো, আমার প্রস্তাবনাকে দাঁড় করানোর জন্য চটুল তর্কাতর্কিও বিশেষ কাজের হতো। কিন্তু বাস্তবে গভীর নিরবতা দিয়ে সহকর্মীরা ট্রিট করলেন বিষয়বস্তুকে।

ইদানীং, আমার ধারণা, নৈঃশব্দ ক্রমাগত ঘণীভূত হচ্ছে। এরপরও আমার ভাবনা নিয়ে একটা ‘রচনা’ লিখতে বসা একেবারেই নারী ও প্রগতি পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক মুজিব মেহদীর নাগাড় সম্পাদকীয় নিষ্ঠার ফল। তিনি কৃতজ্ঞতাভাজন আমার। এখানে আরও একটা বিষয় স্বীকার করা জরুরি। গত অনেকদিন ধরে আমি লিখতে বসলে প্রস্তাবনা বি¯তৃত হয়ে ওঠে না।

অন্যভাবে বললে, আমার বিবরণী ক্রমশঃ লোপ পাচ্ছে, এবং ভাষা/চিন্তার প্রস্তরীভবন চলছে। সঙ্কট কিংবা পরিস্থিতি নিয়ে আমার কিছু পর্যবেণ আছে, আমি নিবিড়ভাবে ভাবছিও। এই পত্রিকায় পরপর প্রদায়ক থাকার সুবাদে পাঠকদের বিনীতভাবে জানিয়ে রাখলাম। ২। দেখা যেতে পারে ‘সিভিল সমাজ’ ও ‘হেজেমনি’ সংক্রান্ত তাঁর টীকা-টীপ্পনি ও আলাপসূত্রগুলো।

| Gramsci, A. 1973: Selections from Prison Notebooks. trans. and ed. by Q. Hoare and G. Nowell-Smith, London: Lawrence and Wishart. ৩। আমার চেনাজানাদের সঙ্গে মুখোমুখি আলাপে আমি এই ধারণাটা সামনে এনেছি যে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ক্যু-টাকে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে ওতোপ্রোত জড়িত, এমনকি হয়তো প্রত্য ফলাফল হিসেবে দেখা দরকার। সেসব মানুষ মুখ্যত বিদ্যাজগতের সঙ্গে সম্পর্কিত কিংবা কাছাকাছি। বিস্ময়কর হলো প্রায় সকলেই অনায়াসে, এবং ক্যাসুয়ালি, মেনে নিয়েছেন আমার বক্তব্য। এটাতে আমি ঘাবড়েছি।

আমার খুশি হবার কথা নিজ-থিসিস গৃহীত হচ্ছে বলে। কিন্তু আখেরে আমি আতঙ্কিত হয়েছি। যদি এই বক্তব্যটা এতটা অবধারিত হয় তাহলে রাজনৈতিক-অর্থশাস্ত্র বোঝেন এমন পণ্ডিতদের কাছ থেকে বিশ্লেষণ কই! আর যদি এটা একটা জটিল প্রস্তাবনা হয় তাহলে সেই বিস্ময় ও মাথাঘামানি কই আমার শ্রোতাদের! আমার আতঙ্কিত হবার কারণ বহুচর্চিত একটা স্থবিরতা, গভীর আত্মমগ্নতা এবং সুবিন্যস্ত গণ-বিস্মরণ। ৪। অর্জুন আপ্পাদুরাই তাঁর মিডিয়াস্কেপ ধারণার নিয়ে বলেছেন: “আধুনিক কালসমূহ...অংশত এর মিডিয়াস্কেপ দ্বারা গঠিত, যেহেতু মিডিয়া কেবল তথ্য সরবরাহ করে না অধিকন্তু সত্তার প্রকৃতির জন্যে এর রয়েছে সুগভীর প্রভাব।

” আপ্পাদুরাই (১৯৯০) উদ্ধৃত হয়েছেন Hugh Mackey Ges Tim O’Sullivan (eds.), The Media Reader: Continuity and Transformation, SAGE Publications and The Open University, London, 1999। সরাসরি আাপ্পাদুরাই দেখা যেতে পারে: Arjuna Appadurai, “Disjuncture and Difference in the Global Cultural Economy,” In Featherstone, M. (ed.) Global Culture: Nationalism, Globalization and Modernity, Sage, London, 1990|। তাঁর প্রয়োগকৃত অপর ধারণা ‘এ্যানথ্রোস্কেপ’-এর সঙ্গে এর সম্পর্ক খতিয়ে দেখতে আমি উৎসাহী। হালের দুনিয়ায় পরিসর বিন্যাসে মিডিয়াস্কেপ ও এ্যানথ্রোস্কেপ কীভাবে পরস্পরপ্রবিষ্ট সেই জিজ্ঞাসা নিয়ে আরও উৎসুক কাজ জরুরি। এটার পিছনে আমার আরও সময় দিতে হবে, কিন্তু এটুকু এখানে বলা প্রাসঙ্গিক হবে যে বাস্তব ও সমকালীন বৈষম্যের কাঠামো বিচারে আনার েেত্র আপ্পাদুরাই এবং সমভাবী উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তকদের নানান গররাজি ভূমিকা সত্ত্বেও বাস্তবতা ও রেপ্রিজেন্টেশন-এর মধ্যকার জটিল সম্পর্ক অনুধাবনে মিডিয়াস্কেপ ধারণা দারুণ সূত্র বাৎলাতে পারে।

৫। ‘ট্র্যাডিশন’ ও ‘গ্লোবেলাইজেশন’ এর সম্পর্ক নিয়ে আমি ভাবিত। তবে সেটা মুখ্যত সাংস্কৃতিক ফর্ম/রূপের বেলায়। যাকে ট্র্যাডিশন বলা হচ্ছে, তা গ্লোবেলাইজেশন প্রক্রিয়ার জন্য অধিকতর জরুরি বলে ঠাহর হয়। দেখি নিরন্তর ট্র্যাডিশনের অন্বেষ চলে, আবিষ্কার করা হতে থাকে।

এরিক হবসবম (এবং টি. রেঞ্জার) সম্পাদিত কিতাবখানি (১৯৮৩) The Invention of Tradition অন্য প্রোপটে। যদ্দুর মনে পড়ে, আমার এইসব ভাবনা নিয়ে তাল/কাল কাটাবার সময়ে আরও দু’একটা কাজ নাড়াচাড়া করেছিলাম। মনে পড়ছে না এখন। এই মুহূর্তে গ্রন্থসন্ধান বা নেটসার্চ করবার অবস্থায় নেই আমি। এসব বিষয়ে হালফিল আরও কাজ নিশ্চয় হচ্ছে।

অজ্ঞতার জন্য আমি মার্জনা চাই। ৬। পরিশেষে নির্বাচনী রাজনীতিতে তিনি থাকবেন না কিংবা তাঁর বৈশ্বিক প্রভাবশালী মিত্ররা তাঁকে সরে যাবার ভাল দিকগুলো বোঝাবেন সে বিষয়ে আমার কোনো সংশয় ছিল না। মধ্য ফেব্র“য়ারিতে কবিবন্ধু সুমন রহমান তাঁর এক সহপাঠী সমেত এই বিষয়ে আমার ভাবনা জানতে চেয়েছিলেন। তাঁকে ধন্যবাদ।

আমার ভাবনা আমি ব্যক্ত করেছিলাম। চার মাসের ব্যবধানে এটুকু যোগ করার আছে যে আপাতঃগ্রাহ্যে অধ্যাপক ইউনূসের সিদ্ধান্ত জরুরি অবস্থার বিধিনিষেধের কারণে মনে হলেও, বিধিনিষেধ না থাকলেও এই সিদ্ধান্তে তিনি আসতেনই। ৭। দেখা যেতে পারে “জাতীয়তাবাদ, আইকনপ্রতিষ্ঠা এবং র‌্যাডিক্যালাইজেশনের রাজনীতি: অধ্যাপক ইউনূসের নোবেলপ্রাপ্তির প্রোপটে”, সমাজ নিরীণ, বিশেষ সংখ্যা, সমাজ নিরীণ কেন্দ্র, ঢাকা, ২০০৭। ৮।

ঘটনাচক্রে, লেখালেখি থেকে বিরতির জন্য চ্যানেল টেপাটেপি করতে গিয়ে এুনি পশ্চিমবাংলার একটা চ্যানেলে একটা বিজ্ঞাপন দেখি। এরা (প্রতিষ্ঠানটি ভুলে গেলাম) দাবি করছে গত বছরগুলোতে ৪ কোটি লোককে এরা ‘স্বনির্ভর’ বানিয়েছে। ল্যণীয় যে ভাষা ব্যবহারে ‘স্বনির্ভর’ ধারণাটা কালেভদ্রে উন্নয়নের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। উন্নয়ন ধারণাটা ব্যবহার করা হলে দরিদ্র নারীর ঋণগ্রহণকে খোদ উন্নয়ন বলা হয়; আবার সরকার ও রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠান সারাণ ‘উন্নয়নের সুফল’ পৌঁছে দেবার ঘোষণা দেয়। শেষোক্ত ঘোষণায় মনে হয় উন্নয়নটা ঘটছে অন্য কোথাও এবং সেটার সুফল সেই ত্রে থেকে দারিদ্রপীড়িত মানুষজনের কাছে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

বেশ প্যাঁচালো পরিস্থিতি কিন্তু। ৯। প্রতিবেশি পশ্চিমবাংলায় কোনো ক্যু ব্যতিরেকেই এই কাজগুলো [বাম]ফ্রন্ট সরকার করে চলেছে। তবে ৩০ বছর আগে তাঁরা ‘রেভল্যুশন’ করেছিলেন এই বাস্তবতায় ক্যু-এর হয়তো আলাদা কোনো তাৎপর্য নেই। টাটাকে গাড়ি বানানোর জন্য কয়েক শ’ একর জমি কিংবা সেলিমকে কিংবা হিন্দুস্তান স্টীলকে -- বিশ্বব্যাঙ্কের সুপারিশ এর থেকে ভালভাবে কেউ কার্যকর করত না।

এটাও স্মর্তব্য যে, পশ্চিমবাংলায় যেগুলো অন্ততঃ প্রেসে আলোচ্য বিষয় হয়েছে, কিছু আন্দোলনের প্রেেিত, মহারাষ্ট্র কিংবা মধ্যপ্রদেশ কিংবা ভারতের অন্যান্য রাজ্যে সেসব এমনকি আলোচ্যও নয়; নিভৃতপ্রায় সাধিত প্রকল্প। ১০। আরও নিশ্চিত করে বললে আমি [ট্রান্সন্যাশনাল] টেকনোক্রেসি ক্যু বলতে চাইব। এখানে টেকনোক্রেসি বলতে আমি এমন একটা অশক্তি বোঝাচ্ছি যেখানে সিভিল ও মিলিটারি ব্যূরোক্রেসির সখাসদ্ভাবে ডেভেলপমেন্ট প্রফেশনালস কেবল সামিল হয়েছেন তাই-ই নয়, বরং সেই অংশই রাষ্ট্রোত্তীর্ণ সম্পর্কাদির দিকনির্দেশনা দেবার জায়গায় আছে। এটা মিলিটারির শক্তির তিবৃদ্ধির প্রসঙ্গ নয়, বরং একটা পরিবর্তিত গ্লোব্যাল পরিস্থিতিতে মিলিটারি ব্যূরোক্রেসির প্রতিক্রিয়া ও লাভতির জায়গাগুলোকে সামনে নিয়ে আসতে তৎপর অনুঘটকের প্রশ্ন।

এই অনুঘটক বাংলাদেশের ডেভেলপমেন্ট প্রফেশনালসদের মধ্যে রয়েছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.