৭১-এর শুরুর দিকের কথা। চারদিকে যুদ্ধের আগাম বার্তা, বাতাসে রক্ত আর গুলির গন্ধ ভাসছে। শিশির আর তারেক দুই বন্ধু। শিশিরের বাবা ওদের গ্রামের চেয়ারম্যান, আর তারেকের বাবা কৃষক। একই স্কুলে পড়ে তারা।
সবে অষ্টম শ্রেণী থেকে পাস করে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে। এরমধ্যেই স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে। তারেকরাও গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। এতসব দেখে শিশির তার বাবা জাফর খাঁন কে বলে “আব্বা, হগলেই তো গেরাম ছাইড়া চইলা যাইতাছে, আমরা যামু না?” তার বাবা বলে, “না আব্বাজান, আমরা যামু না! তুমি ডরাইওনা, হেরা আমাগোরে কিছু করব না।
” একথা শুনে শিশির তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে- “হেরা কারা আব্বা?” তার বাবা বলে-“হেরা হইল আমাগো মেহমান, আমাগো অতিথি। ” শিশির বুঝতে পারেনা এসব কথার অর্থ কি! সে মনে মনে চিন্তা করতে থাকে গ্রামে যদি অতিথিই আসে তবে গ্রাম ছেড়ে মানুষ পালাবে কেন? কেন গ্রামের মানুষ তাদের বাপ-জাদার ভিটেবাড়ী ছেড়ে চলে যাবে, তারেকরা পালিয়ে গেল কেন? তার কিশোর মন এতসব প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাই না।
এভাবেই দিন যেতে লাগল, দেশের অবস্থা খারাপ থেকে খারাপ হতে লাগল। শিশির তাদের পাশের গ্রামের এক বাজারে রোজ রেডিও শুনতে যাই। রেডিওতে সে মিলিটারী আর মুক্তিবাহিনীর কথা শুনতে পাই।
সে বুঝতে পারেনা মিলিটারী আর মুক্তিবাহিনী কি? সে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে, “আব্বা, মিলিটারী কী আর মুক্তিবাহিনী কী?” তার বাবা বলে “আব্বাজান, মিলিটারী হইল আমাগো মেহমান; মুক্তিবাহিনী হইল আমাগো মেহমানের শত্রু, আমাগো মেহমানের শত্রু মাইনে আমাগো শত্রু, বুঝলা আব্বাজান?” শিশির তার বাবার কথা শুনে আপনমনে মাথা নাড়তে নাড়তে তার বাবার সামনে থেকে চলে গেল।
বেশ কিছুদিন পর তাদের বাড়ীতে কিছু সামরিক পোশাক পরা লোক আসল। লোকগুলো তার বাবার সাথে গোপনে কথা বলতে লাগল। সে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করল, “ঐ লোকগুলান কেডা আব্বা?” তার বাবা বলল “হেরা পশ্চিমের দেশ থেইকা আইছে, হেরা হইল আমাগো মেহমান, তোর কোন ডর নাই; হেরা আমাগো এইহানে বেড়াইতে আইছে, আমাগো বাড়ীতে কয়দিন থাকব। ” একথা শুনার পর সে তার বাবাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।
যখনই সে ঐ লোকগুলোকে দেখত, তার কলজেটা যেন হিম হয়ে যেত। তাদের বাড়ীতে যেন তারাই আগন্তুক, শিশিরের বারবার এইকথা মনে হতে লাগল।
যুদ্ধ যখন চরম পর্যায়ে, তখন শিশির দেখল যে তাদের মেহমানগুলো প্রতিদিন দশ-পনেরো জন লোক ধরে আনত এবং কোথায় যেন নিয়ে যেত। একদিন সে ঠিক করল যে তাদের মেহমানগুলো ঐ লোকগুলোকে কোথায় নিয়ে যায় সে দেখবে। আর এর জন্য সে অপেক্ষা করতে লাগল।
একরাতে সে দেখল তাদের মেহমান জনা পঞ্চাশেক লোক নিয়ে এল, এবং রাতের খাবারের পরেই আবার তারা বেরিয়ে পড়ল। শিশির তাদের পিছু নিবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। লোকগুলো বের হওয়ার সাথে সাথে সে ও বেরিয়ে পড়ল। চুপিসারে যে কেউ ওদের পিছু যাচ্ছে লোকগুলো তা বুঝতে পারল না। প্রায় আধা মাইল যাওয়ার পর তারা থামল।
গ্রামের প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। শিশিরের এই জায়গাটা খুবই চেনা। এই জায়গায় সে আর তারেক প্রায় সময় আসত, গাছে চড়ত, পাখির বাসা খুঁজত। এই জায়গায় সামরিক পোশাক পড়া লোকগুলো ধরে আনা লোকগুলোকে তাদের সামনে একলাইনে দাঁড় করালো। যে লোকগুলোকে ধরে এনেছে তাদের হাত পিছমোঁড়া করে বাঁধা।
শিশির একটি ঝোপের আড়ালে বসে এই সব দেখতে লাগল। হঠাৎ তীব্র গুলির আওয়াজে শিশির চমকে উঠল, সে দেখল তাঁর সামনের বন্দী লোকগুলো একে একে ঢলে পড়তে লাগল। শিশির তার দুচোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। কোন মানুষ এভাবে অন্য কতগুলো মানুষকে গুলি করতে পারে! সে এতদিন শুধু যুদ্ধের কথা রেডিওতে শুনেছিলো কিন্তু আজ সে সচক্ষে দেখল যুদ্ধের ভয়াবহতা। সামরিক পোশাক পরা লোকগুলো নিরীহ লোকগুলোকে যেভাবে হত্যা করছে তা দেখে তার অবুঝ মনে ঐ বাঙালী লোকগুলোর জন্য করুণা জেগে উঠল।
তার ডুকঁরে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করল। সে কোনরকমে কান্না চেপে ঐ জায়গা থেকে সরে পড়ল। সে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে তার বাড়ীতে গিয়ে তার বাবাকে বলল, “আব্বা, আব্বা আমাগো বাড়ীতে যে মানুষগুলা আইছিল, হেরা কতগুলান মানুষরে ধইরা গ্রামের ঐ মাথায় নিয়া গুলি কইরা মাইরা ফেলাইছে!” তার বাবা একথা শুনে ছেলেকে ধমকে উঠে বলল, “তুই হেগো পিছন পিছন গিয়া এগুলান দেইখা আইছস, তই না? তরে আমি হেগো পিছন পিছন যাইতে কইছি? ক তুই কেন গেছিলি? মরার সাধ জাগছে মনে? তুই ও মরবি, আমারেও মারবি!” এই কথা বলার পর শিশিরের বাবা তার গালে একটা চড় লাগিয়ে দিল। কিশোর ছেলেটা বুঝতে পারল না কেন তার বাবা তাকে চড় মারল। সে কাঁদতে কাঁদতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
শিশির একা একা তাদের পুকুর পাড়ে গিয়ে অনেক্ষণ কাঁদল। সে চিন্তা করল, সে এ বাড়ীতে আর থাকবে না। সে চলে যাবে এ বাড়ী ছেড়ে। যেই ভাবা সেই কাজ। সে তার রুমে গিয়ে তার কিছু কাপড়-চোপড় নিয়ে রাতেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
ভোর হতে হতে সে তাঁদের গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে পাশের গ্রামে চলে এল। এখানে সে এক লোকের সাক্ষাৎ পেল। সে লোকটাকে সবকিছু খুলে বলল। লোকটা তখন তাকে বলল, “তোমার আব্বাজান পাকিস্তানী মিলিটারীগোরে জাইগা দিছে। হেই পাকিস্তানী মিলিটারীগোরে বাঙালী মানুষরে খুন করতে সাহায্য করতাছে।
হেই এহন রাজাকার হইয়া গেছে। পাকিস্তানী মিলিটারীরা আমাগো বাঙালিগোরে মাইরা ফেলাইবো। ” তখন লোকটি তাকে আবার বলল, “ভাই, তুমি যাইবা আমার সাথে?” শিশির বলল, “কোনহানে?” লোকটি বলল, “তোমারে আমি মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্পে লইয়া যামু। হেই খানে তুমি আমাগো সাথে থাকবা। ” শিশিরের অবুঝ মনে তখন ঝড় বয়ে যাচ্ছিল।
তার মনে তখন হাজার হাজার নিরীহ বাঙালীর লাশ ভেসে উঠছিল। তার ইচ্ছা হল প্রতিশোধ নেয়ার, সে এককথায় রাজি হয়ে গেল। তখন সে লোকটির সাথে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে গেল। ক্যাম্পে গিয়ে ক্যাম্প প্রধানকে সব খুলে বলল লোকটি। ক্যাম্প প্রধান তখন শিশির কে বলল, “তুমিই ভাই প্রকৃত বাঙালী, যে পিতা তোমারে জন্ম দিছে; সে পিতা যখন রাজাকার হইয়া গেছে, তখন তুমি তারে ছাইড়া চইলা আইছ; এতো মহান একটা কাম করছ।
তুমি তোমার পিতার সন্তান নও, তুমি এদেশের সন্তান। এ দেশ তোমার পিতা, এদেশ তোমার মাতা। ” এতসব শোনার পর শিশিরের মনে তখন প্রশ্ন জাগল, “আমি কার সন্তান?”
সে মুক্তিবাহিনীর সাথে থাকতে লাগল, এবং অল্পদিনেই সে অস্ত্র চালনা শিখে ফেলল। এর কিছুদিন পর সে ক্যাম্পপ্রধান কে বলল তাদের গ্রামে যাওয়ার কথা। শিশির বলল, “আমাগো গেরামে মিলিটারীরা যে ক্যাম্প করছে, হেইখানে আমরা আক্রমণ করমু, আমার লগে ৭-৮জন মানুষ দিলেই অইব।
একথা শুনে ক্যাম্পপ্রধান খুশি হয়ে উঠল। তার পরদিন সন্ধ্যায় শিশির সহ ৭জন মুক্তিবাহিনী তাদের গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। মধ্যরাতের শুরুতেই তারা তাদের বাড়ীর সীমানায় পৌঁছাল। তাদের বাড়ীতে তখন একটি মাত্র আলো জ্বলছিল। সে আলোয় দেখল তার বাবা জাফর খাঁন আর এক মিলিটারী বসে কথা বলছে।
আস্তে আস্তে তারা তাদের কাচারী ঘরে ঢুকে পড়ল। সেখানে তারা ঘুমন্ত মিলিটারীদের নির্দয়ভাবে ছুরি দিয়ে জবাই করল। এর পর তারা তাদের বাড়ীর সামনে এল, হঠাৎ সামনে থেকে এলোপাথাড়ি গুলি শুরু হয়ে গেল। এই গুলিতে দুই জন মুক্তি বাহিনী জায়গাতেই মারা গেল। শিশিরের গায়েও গুলি লাগল।
সে কোনমতে একপাশে সরে এল। টানা আধঘন্টা বন্দুকযুদ্ধের পর পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এল। তাদের ঘর থেকে তার বাবা ও এক মিলিটারী হাত তুলে দরজা দিয়ে বের হয়ে এল। মুক্তিবাহিনীর চারসদস্য তাদের গ্রেফতার করল। আহত শিশির সবদেখে অনেক কষ্টে ওদের সামনে এল।
সে তার বাবাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, “আব্বাজান, কেমন আছেন?” তার বাবা চমকে উঠল, কিন্তু কিছু বলার সাহস পেল না। সে তার বাবাকে আবার বলল, “আব্বাজান, আপনে সত্যি কইরা বলেন তো আমি কার সন্তান? আপনে কেন এই দেশটার লগে বেইমানী করলেন। কেন আপনে এই হারামীগোরে এইহানে জাইগা দিলেন? আব্বাজান, যা করছেন করছেন, এহন আমি করমু আপনে দেখবেন। ” শিশিরের এইকথাগুলা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। প্রচন্ড রক্তক্ষরণে সে আরো দুর্বল হয়ে পড়ছিল।
আচমকা শিশিরের বন্দুকথেকে একটা গুলি এসে তার বাবার কপালে লাগল। শিশিরের সাথের চার মুক্তিবাহিনী শিশিরের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়ে পড়ল। শিশিরের বাবা আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। শিশির তার বাবার লাশের কাছে গিয়ে বসে পড়ল, এবং সে বলল “আব্বাজান, আপনে জানেন, আপনার লাইগা কত অবুঝ পোলা তার বাপ হারাইছে? আইজ আমি আরো অনেক অবুঝ পোলার লাইগা আমার বাপ হারাইলাম। আপনে না থাকলে ঐ অবুঝ পোলাগোরে আর বাপ হারাইতে হইবোনা।
” এই বলে শিশির তার বাবার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে লাগল। অনেকক্ষন পর মুক্তিবাহিনীর এক সদস্য তার কাঁধে হাত রেখে তাকে ডাকতে লাগল। কিন্তু শিশিরের কোন সাড়া পাওয়া গেল না। সে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়েছে তার বাবার বুকে তার দেশ মার জন্য।
চার মুক্তিবাহিনী শিশিরের রক্তাক্ত শরীরখানা কাঁধে নিয়ে যাত্রা শুরু করল ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে।
(বন্দী মিলিটারী প্রধানও তাদের সাথে রয়েছে। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।