তোমার অস্তিত্বে সন্দিহান, তবু্ও সদাই তোমায় খুঁজি
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এ বছর তেমন একটা ভাল দল গড়তে পারেনি। রোনাল্ডো, তেভেজরা চলে গেছেন। সে তুলনায় ভাল কোন রিপ্লেসমেন্ট পাওয়া যায়নি। লিও'র করিম বেনজেমা-কে ভেড়ানোর একটি প্রচেষ্টা ছিল। শেষ পর্যন্ত সেটাও সফল হয়নি।
গত কয়েক বছরে ইউনাইটেডের প্রতিদ্বন্ধী রুশ ধনকুবের রোমান আব্রাহোমোবিচের চেলসি দলটির অবস্থা অপেক্ষাকৃত অনেক ভাল। উল্লেখযোগ্য কোন নতুন খেলোয়ারকে দলে না ভেড়ালেও পুরনো প্রায় সবাইকে ধরে রেখেছে। ম্যানচেস্টারেরই আরেক ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটি মধ্যপ্রাচ্যের ধনুকবের শেখের টাকায় তুলনামূলক ভাল গড়েছে। গত বছর তারা রবিনহো, এলানোদের দলে ভিড়িয়েছিল। এ বছর আর্জেন্টিনার তেভেজ ও টগোর আদেবায়োর-কে দলে এনেছে।
মাত্র কয়েক বছর আগে প্রথম বিভাগ থেকে প্রিমিয়ার ডিভিশনে উন্নীত হওয়া এ ক্লাবটির উত্থান সত্যিই অবাক করার মত। বলা যায় তারা প্রায় ইউনাইটেডের সমপর্যায়ে চলে এসেছে। সে কারণেই সম্ভবতো ম্যানচেস্টার ডার্বি ম্যাচের আগে এক সাংবাদিক ইউনাইটেডের কিংবদন্তী কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে এমন কোন দিন আসবে কিনা যেদিন ম্যানচেস্টার ডার্বি ম্যাচে ইউনাইটেড সিটির বিরুদ্ধে আন্ডারডগ হিসেবে খেলতে নামবে। স্যার অ্যালেক্স উত্তরে বলেছিলেন, তাঁর জীবদ্দশায় নয়। স্যার অ্যালেক্স জ্ঞানী এবং সফল মানুষ।
এক জীবনে তিনি যা করেছেন তা অন্যদের করতে কয়েক জনম লেগে যাবে। তারপরেও স্যার অ্যালেক্সের উল্লেখিত মন্তব্যটা আমার কাছে একজন অহংকারী মানুষের দম্ভোক্তি বলেই মনে হয়েছে। তৎসত্ত্বেও আমি চাই তাঁর এই দম্ভোক্তি চিরকাল অটুট থাকুক। কিন্তু এমন কোনদিন যদি আসে যে ম্যানচেস্টার ডার্বি ম্যাচে ইউনাইটেড সিটির বিরুদ্ধে আন্ডারডগ হিসেবে খেলতে নামছে তখন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন কিংবা ইউনাইটেডের কোটি কোটি অনুরাগীর মতো আমাকেও তা মেনে নিতে হবে। উত্থান পতন পৃথিবীর স্বাভাবিক প্রথা।
চিরদিন কারো সমান যায় না।
গল্পটা আমার নানার কাছে বহুবার শুনেছি। ১৯৪৬-৪৭ সালের দিকের কথা। জিন্নাহ'র দ্বি-জাতি তত্ত্বের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে সারা ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছে। সাম্প্রদায়িক বিবেচনায় চিরকালের শান্ত জনপদ বলে বিবেচিত এই বাংলাও সেই বিষবাস্প থেকে রক্ষা পায়নি।
এরমধ্যে সবচেয়ে উপদ্রুত এলাকা ছিল নোয়াখালী। দাঙ্গা বন্ধের প্রচেষ্টায় গান্ধী সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। তিনি নোয়াখালীতেও এসছিলেন। কৌতুহলবশত আমার নানা তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন। আমার নানা গ্রামের স্বল্পশিক্ষিত একজন মানুষ।
পত্রিকা পড়ার সুযোগ তাঁর হয়নি। গান্ধী সম্পর্কে যতটুকু জেনেছেন তা লোকমুখে শুনেই জেনেছেন। তাঁর ধারণা ছিল সারা ভারতজুড়ে বিখ্যাত এ মানুষটি আচরণ এবং পোশাকে জৌলুসপূর্ণ হবেন। কিন্তু চোখের সামনে এ বিখ্যাত মানুষটিকে গ্রামের একজন সাধারণ জেলের মতোই নেংটিপরা অবস্থায় দেখেছেন। তার চলনে, আচরণে বা চাহনীতে কোন জৌলুস ছিলনা।
সকাল থেকে সন্ধ্যা তিনি পায়ে হেটে মানুষের দরোজায় দরোজায় গিয়েছেন। শুনিয়েছেন সাম্প্রদায়িক মিলনের অমৃত বাণী। মানুষকে গেয়ে শুনাতেন কবিগুরুর সেই অমর গান, 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসেরে তবে একলা চলরে। '
সমসাময়িক কালের সাধারণ মুসলমানদের মতো আমার নানাও মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলেন, মুসলমানদের আলাদা আবাসভূমি কামনা করতেন। তারপরেও আমার নানাকে আমি কোনদিন গান্ধীর সমালোচনা করতে দেখিনি।
নিজের মহাত্ম দিয়ে এমনভাবে গান্ধী জয় করেছিলেন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল ভারতীয়কে। ভারতের শতকোটি মানুষ তাঁকে 'বাপু' বলে ডাকে। অনেক ভারতীয় তাঁকে ভগবান বিষ্ণুর মানব অবতার হিসেবে নিয়মিত পূজা করে থাকেন। কেউ কেউ তাঁকে ভগবান বুদ্ধের পর সর্বশ্রেষ্ঠ এশীয় হিসেবে স্বীকৃতি দেন। কিন্তু স্বীকৃতি দেয়া আর তাঁর আদর্শ মানা এক বিষয় নয়।
গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে সৃষ্ট ভারত আজ পৃথিবীর অষ্টম সামরিক শক্তি। প্রতিদিনই সে তার সামরিক শক্তিকে বাড়িয়ে চলছে। অপরদিকে বিশ্ব খাদ্য দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন জানানো হয়ছে বর্তমানে পৃথিবীতে অনাহারী মানুষের সংখ্যা শতকোটি যার অর্ধ্যেকই ভারতীয়। নিজের অর্ধশত কোটি মানুষকে অনাহারী রেখে ভারতীয় নেতাদের এই বিশাল সামরিক আয়োজন কার স্বার্থে? প্রশ্নটার কোন উত্তর পাইনা। উত্তর না পেলেও এটা বুঝি যে, ভারতের অর্ধশত কোটি অনাহারী মানুষ তাঁদের নেতাদের এই সামরিক নীতিকে মেনে নিয়েছে।
যেমন প্রতিবেশী হিসেবে আমরাও মেনে নিয়েছি বা নিতে বাধ্য হয়েছি ভারতের আগ্রাসী নীতিকে।
হিমাংশু আমার বন্ধু। শৈশবের প্রাণোচ্ছল বিকালগুলো, কৈশোরের শবেবরাতে মরিচাবাতি ফুটানো রাত্রিগুলো কিংবা দূর্গাপুজার ক্লান্তিহীন সময়গুলো আবর্তিত হয়েছে তাঁকে ঘিরে। স্মৃতিবিহীন এই জীবনের অধিকাংশ সুখস্মৃতির অংশ সে। আবার জীবনের সবচেয়ে দুঃসহ স্মৃতিটিরও অংশ সে।
একটা সময় এলাকার বেশিরভাগ জমিজমার মালিক ছিল তাঁরা। প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের স্থানীয় প্রতিনিধি কিংবা সামরিক জান্তার স্থানীয় লাঠিয়াল সর্দারেরা এক এক করে পর্যায়ক্রমে গ্রাস করেছে সেগুলো। অন্যান্য বিষয়ে মতভেদ থাকলেও দখল আর লুটপাটের বিষয়ে আমাদের মহান নেতা বা তাঁদের চামচাদের মধ্যে কোন মতভিন্নতা নেই। দেখতে দেখতে একসময় হিমাংশুদের বসতভিটাটাও দখল হয়ে গেল। ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শণ চক্র, মহাদেব শিবের গলায় প্যাচানো নাগ বা দূর্গার দশবাহু তাঁকে রক্ষা করতে পারেনি।
টিকে থাকার প্রচেষ্টায় হিমাংশুরা একসময় দেশ ছাড়ল, সীমান্তের ওপারে উদ্বাস্ত হল। যে রাষ্ট্র তাঁকে নিরাপত্তা এবং সমঅধিকারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সে রাষ্ট্রের হর্তকর্তাদের স্থানীয় চ্যালারাই তাঁকে সর্বশ্রান্ত করেছে। আমরা শুভানুধ্যায়ী বন্ধুরা শুধু দূর থেকে তাকিয়ে তা দেখেছি। কিছু করতে পারিনি।
হিমাংশুর দেশত্যাগ আমাকে রাষ্ট্রের অনাচার এবং আমার নিজের ব্যর্থতার বিষয়টি বারবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে হিমাংশুর স্মরণে আমি কাঁদি। জগতের সব পরাজিত আর অপদার্থরাই হয়তো মাঝরাতে কাঁদে।
মানুষটি সম্পর্কে আমার এবং আপনার বোধোদয় ও অভিব্যক্তি একই রকমের। আমি কিংবা আপনি ভাল করেই তাঁর ভিতরের বা বাইরের কদর্য্য রূপটাকে জানি। তারপরেও তাঁকে সমীহ করে চলি।
ঝামেলাবিহীন জীবনের স্বার্থে তাঁর ছোটখাট অন্যায়গুলো মেনে নেই। অবশ্য অন্যায়গুলো বৃহৎ হলেও তা মেনে নেয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। আপনার ক্ষেত্রে আমি দূর থেকে তাকিয়ে তা দেখব, আমার ক্ষেত্রে আপনি। পরম্পরায় এ সংস্কৃতিটা চলে আসছে। অদূর ভবিষ্যতে এর কোন পরিবর্তন ঘটবে তেমন লক্ষণও দেখিনা।
কৈশোরের সেই প্রেম এখনও মাঝে মাঝে নিজের মাঝে উম্মাদনার সৃষ্টি করে। নিঃসঙ্গ মুহুর্তে এখনও তাঁর অভাব অনুভূত হয়। সেলফোনের কন্টাক্ট লিস্টের নাম্বারগুলোতে তাঁর নাম্বারটা খুঁজি। যদিও খুব ভাল করেই জানি সেলফোনটা হাতে আসার অনেক আগেই সে আমার পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। কল্পনা করি চলার পথে কোন রাস্তার বাকে হঠাৎ তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেছে।
অবশ্য এটাও জানি যে, কোনদিনও আর দেখা হবেনা।
আসলে জীবনের সাধগুলো পূরণের জন্য একটা জীবন কোন অবস্থায়ই যথেষ্ট নয়। কিন্তু আরেকটা জীবন কি মানুষ পায়? যদি সত্যিকার অর্থেই আরেকটা জীবনের নিশ্চয়তা থাকত তবে এই জীবনের জীর্ণতা থেকে মুক্তি পেতে আমি আত্মহত্যা করতেও পিছপা হতাম না। নিশ্চিতভাবেই আমি তা করতাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।