মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।
ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের পূরোধা, ভাষা সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের কিংবদন্তি নেতা চৌধুরী হারুনর রশীদ। তিনি আজীবন মানব মুক্তির জন্য নিবেদিত ছিলেন।
জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি ব্যয় করেছে শোষিত মানুষের মুক্তির মন্ত্রে, আলোকিত মানুষের সমাজ গড়তে। এদেশের প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে তিনি ছিলেন প্রথম সারির লড়াকু।
চৌধুরী হারুনর রশীদের জন্ম ১৯২৬ সালের। চট্রগ্রামের পটিয়া থানার মনসা গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাঁর বাবা আহমেদুর রহমান চৌধুরী। তাঁর পিতামহ আশরাফ আলী ছিলেন সম্ভ্রান্ত জমিদার। পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারের কাছে।
তারপর গ্রামের পাঠশালা ও প্রাইমারী স্কুল। মাধ্যমিক শিক্ষা চট্রগাম শহরের পাহাড়তলী স্কুলে। তাঁর বড় ভাই ছিলেন রেলওয়ে কর্মচারী। তিনিই শহরের পাহাড়তলী স্কুলে হারুনর রশীদের পড়াশুনার বন্দোবস্ত করেছিলেন। তাঁর শৈশব কেঁটেছে চট্রগ্রাম যুব বিদ্রোহ ও সশস্ত্র অভ্যুত্থানের তরঙ্গ প্রবাহে।
দেশপ্রেম ও ভারতমাতার স্বাধীনতা অর্জনের উত্তাল জাগরণের আবহে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযদ্ধ চলাকালে চট্রগ্রামে জাপানী সৈন্যদের বোমা হামলা শুরু হলে তাকে গ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপর তিনি সেখানে হাবিলাস দ্বীপ হাইস্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুলে পড়াশুনা করার সময়ে তিনি ১৯৪১ সালে মুসলীম ছাত্র লীগের কর্মী হিসেবে ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হন। ওই স্কুল থেকে ১৯৪৬ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
১৯৪২-৪৩ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। এই সময় ইংরেজ শাসকদের অবহেলার কারণে সারা বাংলায় দুর্ভিক্ষ ও মহামারী দেখা দেয়। গ্রাম-বাংলার আনাহারী মানুষ খাবারের জন্য ছুটছে কলকাতার দিকে। ওলিতে-গলিতে, রাজপথে-ফুটপথে অগনিত মানুষ ক্ষুধার তাড়নায়-যন্ত্রণায় ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।
কাক ও কুকুরের সঙ্গে বুভুক্ষু মানুষ অখাদ্য-কুখাদ্য খুঁজে ফিরছে ডাস্টবিনে- নর্দমায়। এই সময় তিনি তার সহপাঠীদের নিয়ে চট্রগ্রাম শহর ও গ্রামা গ্রামে ত্রাণ ও চিকিৎসার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
মেট্রিক পাশ করার পর কলেজে পড়াশুনাকালে তিনি বামপন্থী প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ও যোগসূত্র গড়ে ওঠে। ওই সময় তিনি মুসলীম লীগের অসাম্প্রদায়িক অংশের সাথে (যার নেতৃত্বে ছিলেন রফিক উদ্দিন) যুক্ত হন। কিছু দিন পরে তিনি ওই জেলার যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
মুসলীম লীগের সাম্প্রদায়িক ধারার নেতৃত্বে ছিলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী। এই সাম্প্রদায়িক ধারার বিরুদ্ধে চৌধুরী হারুনর রশীদ তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেন এবং শেষ পর্যন্ত ওই অঞ্চলের মুসলীম লীগকে অসাম্প্রদায়িক ধারার নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন।
পাকিস্থান সৃষ্টি হওয়ার প্রাককালে তিনি এর সমর্থক ছিলেন। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতে তিনি পাকিস্থানের আসল চরিত্র নিরূপন করতে সক্ষম হন। ১৯৪৮ সালে তিনি মুসলীম লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে সম্পূর্ণ রূপে নিজে গুটিয়ে নেন।
ওই বছর চট্রগ্রামে গঠিত হয় প্রগতিশীল শিল্পী সাহিত্যিকদের সংগঠন ‘সাংস্কৃতি বৈঠকম্ব’ এবং প্রকাশিত হয় ‘সীমান্তম্ব’। চৌধুরী হারুনর রশীদ এতে একজন সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। এসময় তিনি চট্রগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘প্রভাতী’ পত্রিকায় ছদ্মনামে রাজনৈতিক কলাম লিখতেন।
১৯৪৯ সালে তিনি শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত হন। রেল-শ্রমিক আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে তাদেরকে সংগঠিত্ করার কাজে একজন সংগঠকের ভূমিকা পালন করে শীঘ্রই নেতৃত্বের কাতারে চলে আসেন।
এ সময় তিনি শ্রমিকদের রাজনৈতিক চিন্তা বিকাশের জন্য ‘সাপ্তাহিক আওয়াজ’ নামে একটি পত্রিকা বের করেন। চৌধুরী হারুনর রশীদ এই পত্রিকার কার্যকারী সম্পাদক ছিলেন।
১৯৫০ সালে রেলওয়ে আয়াউন্টস এমপ্লয়িজ লীগের নির্বাচনে দালাল শ্রমিক নেতা চেরাগ খান চৌধুরী হারুনর রশীদের কাছে হেরে যান। একই বছর তিনি এদেশের ব্যাংক কর্মচারীদের প্রথম সংগঠন ব্যাংক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫০ সালের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সমায়ে তিনি জীবনবাজী রেখে অসীম সাহসীকতার সাথে এই দাঙ্গা মোকাবেলা করেন।
‘সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তান চক্রান্ত রুখো’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে ১৯৫১ সালের ১৬-১৯ মার্চ হরিখোলার মাঠে অনুষ্ঠিত হয় এদেশের প্রথম সাংস্কৃতিক সম্মেলন। এই সম্মেলনের পিছনে চৌধুরী হারুনর রশীদের ভূমিকা ছিল। তিনি এই সংগঠনের তিনি দপ্তর সম্পাদক ছিলেন। ওই বছর তিনি লিয়াকত আলী খানের ‘বেসিক প্রিন্সিপল কমিশনের’ বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত করেন। এ জন্য তাঁকে পাকিস্তান পুলিশ গ্রেফতার করে।
কিছু দিন পর তিনি মুক্তি পান।
১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে তিনি চট্রগ্রামে প্রধান সংগঠক হিসেবে নেতৃত্ব দেন। এই আন্দোলনে তিনি ছাত্র-যুব, শ্রমিক, কর্মচারী, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী এবং রাজনৈতিক কর্মী ও নেতৃবৃন্দ নিয়ে সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে নিজে এর যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এক পর্যায়ে তিনি এই সংগঠনের আহবায়কের দায়িত্বও তাঁকে পালন করতে হয়। ভাষা আন্দোলনের সময় পাকিস্তান সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে।
এ সময় ১৫ হাজার শ্রমিক তাঁর মুক্তির দাবিতে জেলখানা ঘেরাও করে। ফলে পাকিস্তান প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে বিখুব্ধ জনতাকে সামাল দেয়। চৌধুরী হারুনর রশীদ বিনা বিচারে ৪ বছর আটক ছিলেন। জেলের মধ্যে তিনি কারা কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। জেলে থাকাকালীন সময়ে তাঁকে পূর্ববঙ্গ রেলওয়ে লীগের সহ-সভাপতি ও যুব লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
১৯৫২ সালেই তিনি কমিউনিষ্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসলে তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি ১৯৫৬ সালে কমিউনিষ্ট পার্টির সিদান্তে প্রকাশ্য আওয়ামী লীগে রাজনৈতিক কাজ শুরু করেন। এ সময় তিনি কালুর ঘাট জুট মিল শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু তিনি বেশী দিন এ সংগঠনের মধ্যে কাজ করতে সক্ষম হয়নি।
কারণ পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও সাম্রাজ্যবাদ ঘেঁষা বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে আওমীলীগের মধ্যে মতবিরোধ বাধে। ফলে এ সময় মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে ন্যাপ গঠিত হয়। তখন চৌধুরী হারুনর রশীদ এ সংগঠনের প্রাদেশিক কমিটির সদস্য ও চট্রগ্রাম জেলা কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৫৮ সালে রেলওয়ে এমপ্লয়িজ নির্বাচনে পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৮-৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি মাথায় হুলিয়া নিয়ে ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজে নিয়োজিত থাকেন।
সাথে সাথে পাকিস্তান সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আনোলন ও শ্রমিক ঘর্মঘট এবং জনমত গঠনের কাজেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬২ সালে আত্মগোপন অবস্থায় আইয়ুব খানের সাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার নেপথ্য ভূমিকা রাখেন। ষাটের দশকে তিনি চট্রগ্রামে ছাত্র ইউনিয়ন গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও অবদান রাখেন। ১৯৬৭ সালে তিনি আত্মগোপন অবস্থায় চট্রগ্রাম জেলা ন্যাপের সভাপতি এবং প্রাদেশিক ন্যাপের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ সালে কমিউনিষ্ট পার্টির জেলা সম্পাদক ‘অমর সেনের’ মৃত্যু হলে চৌধুরী হারুনর রশীদকে জেলার উক্ত পদে নির্বাচিত কারা হয়।
এসময় তিনি ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলার দায়িত্ব নেন। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে তিনি চট্রগ্রামের নেতৃত্বে দেন।
১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি উজ্জ্বল নাম চৌধুরী হারুনর রশীদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রথম সারির সংগঠক। তরুণ ছাত্র-ছাত্রী, শ্রমিক ও কৃষকদের রিক্রুট, ট্রেনিং, অস্ত্রশস্ত্র ও রসদের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি এবং কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনার যোদ্ধাদের অন্যতম পরিচালক ও সংগঠক ছিলেন তিনি।
১৯৭২ সালে তিনি রেল-শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এবং ন্যাপের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৭৩-৭৪ সালে তিনি আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনে বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন। জেনেভায় অনুষ্টিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সম্মেলনে তিনি যোগ দেন। তিনি বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়নের জেনারেল কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর পার্টি নির্দেশে তিনি আত্মগোপনে যান।
১৯৭৬ সালে তিনি শামসুন্নাহার মিনুকে সহধর্মিনী করেন। তাদের পরিবারে একটি মাত্র সন্তানের জন্ম হয়। তার নাম নার্গিস চৌধুরী। ১৯৭৮ সালে তিনি প্যালেস্টাইনের মুক্তি সংস্থা ও সিরিয়ার শ্রমিক ফেডারেশনের আমন্ত্রেণে আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রমিকদের সাথে আলোচনা ও বৈঠক করেন।
১৯৮৮ সালে তিনি পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে প্রায় কর্ম অক্ষম হয়ে পড়েন।
১৯৯৬ সালে থেকে একেবারে অচল হয়ে পড়েন। এরপর থেকে তিনি আর সুস্থ্য হয়ে ওঠেননি। ২০০০ সালের ১৯ অক্টোবর তিনি মারা যান।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।