আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধির প্রতিভূ ও মজলুম মানুষের কৃতিত্ব



রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধির প্রতিভূ ও মজলুম মানুষের কৃতিত্ব ফকির ইলিয়াস ==================================== একটি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা কি হওয়ায় উচিত, তার বিভিন্ন সংজ্ঞা দেয়া যেতে পারে। কিন্তু একজন স্বঘোষিত খুনি যদি কোন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব পায় -তাহলে বিষয়টি কোন চোখে দেখা যাবে? কোন দৃষ্টিতে দেখা উচিত? এই প্রশ্নগুলো নতুন নয়। প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হয়েছে ১৯৭৬ সাল থেকেই। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের পটপরিবর্তনের পর থেকেই। না, কেউ কোন উত্তর দেননি।

যাদের উত্তর দেয়ার কথা ছিল, তারা বরং প্রকারান্তরে এসব খুনিদের নানা ধরনের জোগান দিয়েছেন। তা না হলে এসব চিহ্নিত খুনিরা বিদেশের মাটিতে কিভাবে মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা-বাণিজ্যের মালিক হলো? হ্যাঁ, আমি জাতির জনক হত্যার খুনিদের কথাই বলছি। বলছি, সে সব হায়েনাদের কথা, যাদের হাত থেকে শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী, কেউই সেদিন রক্ষা পায়নি। যারা আঘাত হেনেছিল রাষ্ট্রসত্তার ওপর। পনেরোই আগস্টের নির্মম হত্যাযজ্ঞের পর এদের রাতের আঁধারে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

এবং তা করা হয় সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় আয়োজনে। এরপরের ঘটনাবলি আরও কলঙ্কজনক। এদের বিদেশে বড় অঙ্কের অর্থপুঁজি দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ দেয়া হয়। খুনি মেজর ডালিম কেনিয়ায় এবং কর্নেল রশীদ লিবিয়ায় কীভাবে মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা মালিক হলো, তা জাতির এখনও অজানা। কিছু খুনিদের বিদেশের বিভিন্ন মিশনে রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেয়া হয়।

আচ্ছা, কোন খুনি কি একটি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হতে পারে? কীভাবে পারে? এই প্রশ্নটি এখনও আমার মনে ঘুরপাক খায়। প্রশ্নটি ঘুরপাক খায় এখনও কোটি প্রজন্মের মনে। যারা বিশ্বাসই করতে চান না, এরা বিভিন্ন মিশনে পোস্টিং পেয়েছিল। অতি-সম্প্রতি সাবেক রাষ্ট্রদূত মি. ওয়ালিউর রহমান এ বিষয়ে বেশ কিছু অজানা কথা জাতিকে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, (দৈনিক আমাদের সময় ২২ নভেম্বর ২০০৯ রোববার) একটি বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা এসব খুনিদের বিদেশে খুঁজে খুঁজে হত্যা করার প্রস্তাব দিয়েছিল ১৯৯৮ সালে।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রস্তাবে কোনমতেই রাজি হননি। ভাড়াটে এই প্রাইভেট গোয়েন্দা সংস্থা এজন্য মোটা অঙ্কের অর্থ চেয়েছিল। কিন্তু সে সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তিনি প্রতিহিংসাপরায়ণ হত্যায় বিশ্বাস করেন না। তিনি চান এসব খুনির বিচার হবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মাটিতে। সত্য ও ন্যায়বিচার পাক বাংলার মানুষ।

ওই সাক্ষাৎকারে সাবেক রাষ্ট্রদূত মি. ওয়ালিউর রহমান খুনিদের ফিরিয়ে আনতে তার প্রচেষ্টার কথা, ওই সময়ের সরকারের তৎপরতার কথাও বর্ণনা করেছেন বিস্তারিতভাবে। বলেছেন, খুনি কর্নেল রশিদ রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমানের বিরুদ্ধে কীভাবে ভাড়াটে মস্তান লেলিয়ে দিয়েছিল। এটা খুবই স্পষ্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশের আপামর মানুষ ন্যায় ও সত্যের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞের বিচার চেয়েছেন। আর চেয়েছেন বলেই আইন কখনই নিজের হাতে তুলে নেননি। ঘাতকদের রাস্তাঘাটে ধাওয়া করেননি।

মেজর ডালিম, কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশিদ, মেজর বজলুল হুদা প্রমুখ খুনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- বিষয়ে নানা দাম্ভোক্তি করেছে দেশে-বিদেশে। যেহেতু এই ঘটনার বেনিফিশিয়ারিরা রাষ্ট্রক্ষমতা ভোগ করেছেন তাই তারা এদের বিরুদ্ধে 'টুঁ' শব্দটি পর্যন্ত করেননি। আর এভাবেই ঘাতক হায়েনাচক্র হয়ে উঠেছে বাংলাদেশে রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতিভূ। দুই. বাংলাদেশে যে চক্রটি এই হত্যাকারীদের, এই নির্মম প্রক্রিয়ার পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল তারা নব্যরূপ ধারণ করেছিল ২০০১-এর নির্বাচনে জেতার পর। এরা গোটা দেশজুড়ে একটি বলয় গড়ে তুলেছিল নিজস্ব আঙ্গিকে।

গড়ে তুলেছিল নিজস্ব 'ভবন'। যে ভবনটি থেকে সব গুপ্তহত্যা, লুটপাট, দুর্নীতি ও ব্যাভিচার মনিটর করা হতো। এসব কথা তৎকালীন স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, আবদুস সালাম পিন্টুরা এখন অকপটে স্বীকার করছেন। তারা এমনভাবে প্রাচীর তৈরি কওে রেখেছিল, যাতে একটি ভেঙে পড়লে অন্যটি তাদের রক্ষা করে। আর এরই ধারাবাহিকতায় তারা মনে করেছিল 'সংবিধান রক্ষার' দোহাই দিয়ে তারা রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার ভিতটি চিরস্থায়ী করে রাখতে পারবে।

এই 'ভবন' ওয়ালারা কখনই ভাবতেই পারেনি, ওয়ান ইলেভেনের মতো একটি ঘটনা বাংলাদেশে ঘটতে পারে। অথচ তাদের দিবাস্বপ্ন চুরমার করে দিয়ে বাংলাদেশে 'ওয়ান ইলেভেন' সংঘটিত হয়েছিল। জনগণ হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল সেই দুর্বৃত্তদের হাত থেকে। এটা খুবই বেদনার কথা বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধির প্রতিভূ কি হবে, কি হওয়া উচিত সে বিষয়ে কোন গাইডলাইন জোরালোভাবে রাজনৈতিক সংস্কৃতির আওতায় তৈরি হয়নি। কিন্তু এর অর্থ তো এটা ছিল না, প্রকাশ্যে খুনিরা দূতাবাসগুলোতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে।

৩০ লাখ শহীদের রক্তের অবমাননা করবে তারা। ১৯ নভেম্বর ২০০৯ বাংলাদেশে যে সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা বিশেষ কোন দলের কৃতিত্ব নয়। কৃতিত্ব বাংলাদেশের মজলুম মানুষের। কৃতিত্ব এই তরুণ প্রজন্মের যারা বার বার সত্যের অন্বেষণে শিকড়মুখী হতে চাইছে। এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার।

যে চেতনা সব অসাধ্য সাধন করেই যাবে শেষ পর্যন্ত। মনে পড়ছে, বাংলাদেশের এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী, চিহ্নিত রাজাকার শাহ আজিজুর রহমান এক জনসভায় বলেছিলেন, 'শেখ মুজিবকে হত্যার পর এই দেশের একটি মানুষও তো কাঁদেনি। ' তার এই কথাটি কি সত্য ছিল? মানুষ অধিক শোকে পাথর হয়ে যায়। ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের নির্মমতা এতই নিষ্ঠুর ছিল-এরপর সাধারণ মানুষ পাথর হয়ে গিয়েছিল তাদের আর কিছুই বলার মতো মানসিক অবস্থা ছিল না। তারা ছিলেন বাকরুদ্ধ।

এর অর্থ এই ছিল না, তারা মুজিব হত্যার বিচার চাননি। দেশে তখন জগদ্দল পাথর হয়ে জনগণের বুকের ওপর চেপে বসেছিল সামরিক জান্তা খুনিদের, জিয়ার, এরশাদের। তারা রাষ্ট্রক্ষমতা হাতিয়ে নিয়ে এবং স্থায়ী বন্দোবস্ত রাখতে ছিল নানাভাবে মরিয়া। সেই সুযোগে দেশে ছিল একাত্তরের পরাজিত রাজাকার শক্তির দৌরাত্ম্য। সব মিলিয়ে একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরিতে তৎপর ছিল সব সম্মলিত অশুভ শক্তি।

তারপরও মুজিব হত্যার প্রতিবাদ হয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে শিক্ষাঙ্গনে, শিল্প-কারখানা, হাটে-মাঠে ও গ্রামে-গ্রামান্তরে। প্রতিবাদ হয়েছে সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে, কবিতায়, গানে, নাটকে ও মজলুম মানুষের প্রাণে প্রাণে। এটা চরম লজ্জার কথা, ঘাতকদের মদদপুষ্ট ক্ষমতাসীনরা হত্যাকান্ডের মামলা পর্যন্ত করতে দেয়নি। থানা মামলা নেয়নি। অথচ সামরিক বুট, জনগণের বাহুর চেয়ে শক্তিশালী হওয়ার কথা ছিল না শহীদের রক্তেভেজা বাংলাদেশে।

জাতির জনক হত্যার বিচারের রায় দ্রুত কার্যকর করা হোক- এটা বাঙালি জাতির প্রাণের দাবি। সে সঙ্গে চার জাতীয় নেতা হত্যাকান্ড, এর মদদদাতাসহ অপশক্তি এবং এর ধারাবাহিকতায় সব রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের বিচার সম্পন্ন করা হোক। ২৫ ফেব্রুয়ারির 'পিলখানা হত্যাকান্ড' সেই রক্ত পিপাসু প্রেতাত্মাদের মদদ, যারা দেশকে অস্থিতিশীল রাখতে চায়। এরা কিন্তু এখনও থেমে নেই। তাই এদের মোকাবেলা করতে হবে গণমানুষকে সঙ্গে নিয়েই।

নিউইয়র্ক, ২৪ নভেম্বর ২০০৯ ---------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ। ঢাকা । ২৭ নভেম্বর ২০০৯ শুক্রবার প্রকাশিত ছবি- মারিয়াস ভ্যান মিগদাল

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.