আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফুলবাড়ী কয়লাখনি প্রতিরোধ আন্দোলন-০১

চোখ খুবলে নেয়া অন্ধকার, স্ফুলিঙ্গ জ্বেলে দাও!

(২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট হাজার হাজার কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র জনতা ঘেরাও করে এশিয়া এনার্জির অফিস। দাবি ছিল ফুলবাড়ীকে ধ্বংস করে, জাতীয় সম্পদ পাচারের লক্ষ্যে খোলা মুখ পদ্ধতিতে কয়লা খনি করা যাবে না। সেদিন সরকারের পুলিশ ও বিডিয়ার বাহিনীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন ৩ জন, আহত হন শতাধিক। জনতার ধারাবাহিক আন্দোলনের মুখে সরকার বাধ্য হয় কয়লা খনি বন্ধ করার চুক্তি করতে। এখানেই শেষ নয়, সেই এশিয়া এনার্জি আবারও নামে-বেনামে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে কয়লা খনির জন্য।

কিছুদিন আগে সেনা বাহিনী সেখানে জরিপ চালায় কয়লা খনির পক্ষে। ফুলবাড়ীতে চলছে আতঙ্ক, অসন্তোস। আবারো দানা বাধতে চলছে আর একটি ২৬ আগষ্টের। এরই প্রেক্ষিতে আমাদের এই ধারাবাহিক প্রতিবেদন। এই প্রতিবেদনটি ২০০৬ সালে লড়াইয়ের মাঠে আমাদের চোখে যা ধরা পড়ে তা থেকে প্রস্তুতকৃত।

আপনাদের সবার মতামতের ভিত্তিতেই এটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পেতে পারে। ) ফুলবাড়ী কয়লাখনি প্রতিরোধ আন্দোলন সুচনা: দেশের মধ্যে রাজশাহী জেলায় আবাদী জমির পরিমান (অনুপাত) সবচেয়ে বেশী, শতকরা ৭৪ ভাগ। এরপরেই আবাদী জমির বেশী পরিমান দিনাজপুর জেলায়, শতকরা প্রায় ৭২ ভাগ। তার মধ্যেও তিন ফসলি জমির অনুপাত সম্ভবত এখানেই সবচেয়ে বেশী। এই দিনাজপুর জেলারই সর্বাধিক ইতিহাস সমৃদ্ধ থানাটির নাম ফুলবাড়ী, যেখানে সমতলভূমি কাগজের পৃষ্ঠার মত সমতল।

দিনাজপুর হলো আমাদের দেশের সবচেয়ে উৎপাদনশীল অঞ্চল। সারাদেশে ধান উৎপাদনে গতবছর দিনাজপুর জেলা ছিল প্রথম এবং একক থানা হিসেবে প্রথম ছিল ফুলবাড়ী। একসময় বাংলার শস্যভাণ্ডার বলা হতো বরিশাল জেলাকে, আর এখন শস্যভাণ্ডার হিসেবে কোন জেলাকে চিহ্নিত করতে গেলে তার অন্যতম দাবিদার হবে দিনাজপুর জেলা। এবং এই জেলারই সবচেয়ে উৎপাদনশীল থানা ফুলবাড়ী। লোকমুখে জানা যায়, কোন এক রাজার কন্যা ফুলদেবীর ফুলের বাগান ছিল এই ফুলবাড়ীতে।

সে সময় রাজকন্যা ফুলদেবীর বাগানবাড়ী হিসেবে পরবর্তীতে এ জায়গার নাম হয় ফুলবাড়ী। একজন সাংবাদিকের মন্তব্য- ‘ফুলের মত সুন্দর ফুলবাড়ী’। নদীর পাড় ধরে গ্রামের দিকে এগিয়ে গেলেই বোঝা যাবে এই সৌন্দর্য। রাস্তার দুধারে বড় বড় গাছের সারি, রাস্তার দুপাশে ধান, পাট, আখ, সব্জীর সমতল এবং সেইসাথে লাগানো নদী সবমিলিয়ে এক চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্যের বিস্তীর্ণ ভূমি। প্রত্যেকটা গ্রাম মানে নানা ফলের ও বনজ অনেক গাছে ঘেরা একগুচ্ছ ঝক্-ঝকে মাটির বাড়ী।

ইদানিং দু-একটা বিল্ডিংও তৈরী হয়েছে। এই ফুলবাড়ীতেই বসবাস এ মাটির মূল অধিবাসী সাঁওতালদের অধিকাংশের। ফুলবাড়ী পৌরসভা এবং ফুলবাড়ীর ৪টি ইউনিয়ন, বিরামপুর থানার ১টি ইউনিয়ন, পার্বতীপুর থানার ১টি ও নবাবগঞ্জ থানার ২টি ইউনিয়ন জুড়ে যে এলাকায় এশিয়া এনার্জি নামক সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানী খনি উত্তোলনের চেষ্টা করছিল সে এলাকাতেই আছে সাঁওতাল, পাহান, বুনো-এইসব জাতিসত্ত্বার ৭২টি গ্রাম, প্রায় ৬০ হাজার মানুষ। যারা আজ থেকে দুই যুগ আগেও জানত না মিথ্যা কাকে বলে, খুন-ধর্ষণ কাকে বলে। কেবল আদিবাসীরাই নয় বাঙ্গালিরাও এখানে দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় অধিকতর সোজা-সাপ্টা, জটিলতামুক্ত মননসম্পন্ন।

সাধারণতঃ নিস্পৃহ চরিত্রের এবং পরস্পরের প্রতি দারুণ আন্তরিক। আদিবাসী ও অনেক আগে থেকে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী স্থানীয় বাঙ্গালি ছাড়াও খনি এলাকায় আবাস আছে কিছু বিহারিসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা যেমন- চাপাই নবাবগঞ্জ, নীলফামারী এবং ভারতের উত্তর দিনাজপুর ও পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন এলাকা থেকে স্থানান্তরিত বা বাস্তুচ্যুত মানুষ। এইসব মানুষরা ফুলবাড়ীর কোথাও কোথাও গড়ে তুলেছে নিজেদের এক একটি গ্রাম বা পাড়া। ফলে একদিক থেকে সমগ্র এলাকার মানুষ ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্ম, অভিজ্ঞতা, চিন্তায় দেশের অনেক অংশের তুলনায় অধিকতর বৈচিত্রপূর্ণ। বৃটিশ আমল থেকেই এখানকার মানুষের আছে সংগ্রামের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য যা নিয়ে গোটা জাতীই এখনও গর্ব বোধ করে।

তেভাগা আন্দোলনে এই এলাকা ছিল জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কেন্দ্র। সিধু-কানু মাঝিদের গাঁ। ’৪৭-এর কৃষক সম্মেলনে ফুলবাড়ী থেকে প্রায় অর্ধলক্ষ কৃষক ২দিন যাবত পায়ে হেটে নীলফামারীতে গিয়ে অংশগ্রহণ করে। কাগমারী সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে এ অঞ্চলের অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ। ৬০-৭০ দশকে ফুলবাড়ী ছিল সমগ্র উত্তরাঞ্চলে বামপন্থী আন্দোলনের কেন্দ্র, যেন নকশালপন্থী আন্দোলনে উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি।

’৭১-এ যুদ্ধের সময় সমগ্র দেশ যখন প্রধানত আওয়ামীলীগ ও শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন তখন ফুলবাড়ী-পার্বতীপুর-বিরামপুর ছিল ভাসানীর ন্যাপের নিয়ন্ত্রণে, বামপন্থীদের দিশায় আন্দোলনমুখর। বামপন্থীদের দীর্ঘকালীন ব্যাপক উপস্থিতি, জনগণের ব্যাপক অংশের রাজনৈতিক সক্রিয়তার কারণে ’৭১ পরবর্তী ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সব জাতীয় আন্দোলন ফুলবাড়ীতে দেশের অনেক অংশের তুলনায় সাধারণের চেয়ে বেশী ব্যাপক ছিল। ’৯০ দশকের শেষ উল্লে¬খযোগ্য গণআন্দোলন ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা বিরোধী আন্দোলনও উৎপত্তির জেলা হিসেবে অনেক বেশী আলোড়িত ছিলো এখানে। রাজনৈতিক তৎপরতা ও আন্দোলন-সংগ্রামের এসব ঐতিহ্যের কারণেই হয়ত এখনও ফুলবাড়ীতে যে রাজনৈতিক তৎপরতা দেখা যায় তা যেন জাতীয় মানের চেয়েও পোক্ত। এখানকার ডানপন্থী দলগুলোর মধ্যেও যেটুকু সহনশীলতা, শ্রেণীগত ঐক্যের স্পষ্ট দৃঢ়তা ইত্যাদি দেখা যায় জাতীয় মঞ্চে আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী শ্রেণীভিত্তি ও অনুৎপাদনশীল প্রকৃতির কারণে একই শ্রেণীর হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী-বিএনপি-জাপা-জামাতিদের মধ্যে তা দেখা যায় না।

যেমন- জাতীয়ভাবে বুর্জোয়া দলগুলোর নিজেদের মধ্যে উলঙ্গ কামড়া-কামড়ি এবং তথাকথিত বাম ও বুর্জোয়া দলগুলোর জোটভুক্ত হতে অহরহ দেখা গেলেও ফুলবাড়ীর অবস্থা হলো সাধারণভাবে যেকোন প্রয়োজনে বা ইস্যূতে এখানকার বামপন্থীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী-বিএনপি-জাপা-জামাতিরা পরস্পর জোটবদ্ধ আছে, থাকে সবসময়ই। ঐতিহাসিকভাবে গড়ে ওঠা দুটি অঘোষিত কিন্তু যেন চিরন্তন রাজনৈতিক জোট এখানে স্পষ্ট, যার একটি হলো ডানপন্থী এবং অপরটি হলো বামপন্থী। সব কিছুতেই আওয়ামী-বিএনপি-জাপা-জামাতিরা এখানে খুব চমৎকার ঐক্যবদ্ধভাবে পরস্পরের স্বার্থ সংরক্ষণ করে। সবমিলিয়ে, সংগ্রামী চেতনায় ফুলবাড়ী ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল- আমাদের দেশে অগ্রসরতম এক স্থান, অগ্রসরতম জনতার এক অবস্থান। ১৯৯৪ সালের এক সরকারী সিদ্ধান্ত অনুসারে এখানেই বাস্তবায়িত হতে চলেছিল ৫/৬ লক্ষ মানুষ উচ্ছেদের, সমগ্র উত্তরবঙ্গ ধ্বংসের পদক্ষেপ-উম্মুক্ত পদ্ধতির তথাকথিত ‘ফুলবাড়ী কয়লা খনি প্রকল্প’।

সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানী এশিয়া এনার্জি, তার এদেশীয় দালাল ও সংশি¬ষ্ট অন্যান্যদের এক হরিলুট প্রকল্প। এ ধ্বংসযজ্ঞকে বুকের তাজা রক্তে রুখে দিয়ে ফুলবাড়ীর জনতা আমাদের যে ধাক্কা দিয়ে গেল সেটিকে যাতে সকলকে জাগরিত করার কাজে লাগানো যায় সেজন্যই আমাদের এই প্রতিবেদন: কয়লা খনি সম্পর্কিত তথ্যাদি: ৫০ দশকের শেষার্ধে এদেশে বড় আকারে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান শুরু হয়। এজন্য বাংলাদেশের (তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তান) ভূতাত্তিক জরিপ বিভাগ (জিএসবি) কুপ খনন করলে (১৯৬২সালে) জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে প্রায় ১০০০ মিটার গভীরে দেশের প্রথম উত্তোলনযোগ্য কয়লাখনি আবিস্কৃত হয়। এই খনিতে মজুদের পরিমান ১০৫৩ মিলিয়ন টন। ১৯৮৪-৮৫ সালে জিএসবি’র উদ্যোগে আবিস্কৃত হয় রংপুরের খালাসপীরে কিছুটা কম গভীরতায় ৬৮৪ মিলিয়ন টনের দেশের ২য় কয়লাখনি।

জিএসবি ১৯৮৫-৮৭ সালে আবিস্কার করে দিনাজপুরে বড়পুকুরিয়ায় ১৫০ মিটারের বেশী গভীরে ৩০০ মিলয়ন টন মজুদের ৩য় কয়লাখনি। ১৯৯৫ সালে আবিস্কার করে দিনাজপুরের দীঘিপাড়ায় ২৫০ মিটার গভীরতায় দেশের ৪র্থ কয়লাখনি। ১৯৯৪ সালে শুরু হওয়া জিএসবি ও যুক্তরাজ্য ভিত্তিক কোম্পানি বিএইচপি’র যৌথভাবে খনি উত্তোলন ও অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় ১৯৯৭ সালে আবি¯ৃ‹ত হয় দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে ১৫০ থেকে ২৫০ মিটার গভীরতায় ৫৭২ মিলিয়ন টন মজুদ সম্পন্ন দেশের ৫ম কয়লাখনি। এবং সর্বশেষ ২০০০-০১ সালে জিএসবি আবিস্কার করে সুনামগঞ্জের ট্যাকেরহাটে প্রায় ১০০ মিটার গভীরে দেশের ৬ষ্ঠ কয়লাখনি। ১১ফেব্র“য়ারী ১৯৯৮ দেশের প্রচলিত আইনে অবৈধভাবে ফুলবাড়ী কয়লাখনি থেকে কয়লা উত্তোলনের জন্য তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার বৃটিশ কোম্পানি এশিয়া এনার্জি কর্পোরেশনের সাথে চুক্তি করে বা এশিয়া এনার্জির কাছে বিএইচপি’র অংশীদারিত্ব হস্তান্তরিত হয়।

এইসময় থেকেই এশিয়া এনার্জি বাংলাদেশে কয়লাখনির উত্তোলন সম্পর্কিত কার্যক্রম শুরু করে। এ কাজের জন্য এশিয়া এনার্জি কর্পোরেশন বাংলাদেশ পিটিওয়াই লিমিটেড গঠন করে। ১৯৯৯-’০৪ সময়ে খনি উত্তোলন সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকার লাইসেন্স ইত্যাদি সংগ্রহ সংক্রান্ত কাজ করে এশিয়া এনার্জি বাংলাদেশ লি: । ২০০১ সালে ব্যাপকতর অভিকর্ষ জরিপ এবং ২০০৩-’০৫ সময়কালে নতুন ১০৭ টি অনুসন্ধান কুপ খনন করে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ২০০৩ সময় নাগাদ কোম্পানি আন্তর্জাতিকভাবে পুঁজি সংগ্রহ-বাড়ানোর কাজ করে।

২০০৪ সালের শেষের দিকে এশিয়া এনার্জি ফুলবাড়ীতে তার অফিস স্থাপন করে খনি এলাকায় নানা রকম জরিপ ও অন্যান্য কার্য্যক্রম শুরু করে। তখন থেকে খনি এলাকার জনগণ এ সম্পর্কে ক্রমাগত সচেতন হয়ে উঠতে থাকে। ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৫, এশিয়া এনার্জি খনি উন্নয়নের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পায় যার ভিত্তিতে খনি উন্নয়নের একটি পরিকল্পনা ২রা অক্টোবর ’০৫ অনুমোদনের জন্য কোম্পানি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কাছে জমা দেয়। সরকার এ পরিকল্পনা যাচাইয়ের জন্য ১২ সদস্যের একটি বিতর্কিত কমিটি গঠন করে। নভেম্বর, ২০০৫ কোম্পানি অনুমোদনের জন্য সরকারের কাছে খনির পানি ব্যবস্থপনা সংক্রান্ত পরিকল্পনা জমা দেয়।

ইতোমধ্যে এপ্রিল, ২০০৫ থেকে ফুলবাড়ীতে খনি বিরোধী আন্দোলন গতি পেতে থাকে এবং জাতীয়ভাবে এবিষয়ে আলোচনা ও আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। এই প্রেক্ষিতে সরকার নিজেদের আড়াল করে এশিয়া এনার্জি’র কয়লাখনি হালাল করতে ‘কয়লা নীতি’ নামক শিখন্ডি হাজির করে। ডিসেম্বর, ২০০৫ এই ‘কয়লানীতি’-র প্রথম খসড়া জ্বালানি মন্ত্রনালয়ে উত্থাপিত হয়। এর উপর সমাজের নানা অংশের মতামত (লোক দেখানো) সংগ্রহের জন্য সরকার জানুয়ারী, ’০৬ থেকে সিরিজ মতবিনিময় অনুষ্ঠান আয়োজন করতে থাকে। মে, ২০০৬ এশিয়া এনার্জি বাংলাদেশি কোম্পানী ‘ফাল্গু সন্ধানী’-কে খনির পানি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিয়ে ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি করে।

জুন, ’০৬ এশিয়া এনার্জি এদেশের অর্থনীতিতে ফুলবাড়ী কয়লাখনির ভুমিকা সংক্রান্ত একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক জাতীয় স্বার্থের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে কোম্পানির পক্ষে এই ফাঁপানো প্রতিবেদনটি তৈরি করে। আবিস্কারের সময় ১৯৯৭ সালে প্রথমবার ফুলবাড়ী কয়লা খনির মজুদ নির্ধারণ করা হয় ৩৮৭ মিলিয়ন টন । পরবর্তীতে ২০০৪ ও ২০০৫ সালের মধ্যে এই মজুদ পুনঃনির্ধারিত হয় যথাক্রমে ৪২৬ এবং সর্বশেষে ৫৭২ মিলিয়ন টন। সেই ১৯৯৪ সালেই বড়পুকুড়িয়ায় খনি উত্তোলন প্রসঙ্গে এদেশের প্রেক্ষিতে উম্মুক্ত খনন পদ্ধতি এমনকি বৃটিশ বিশেষজ্ঞ দল কর্তৃকও বাতিল হয়।

তারপরও অবৈধভাবে খনি উত্তোলন, এই উত্তোলনে অবৈধ উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়কে আড়াল করে জনগণের নজর অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার ষঢ়যন্ত্র-চক্রান্তের অংশ হিসেবে সরকার কোম্পানির সাথে যোগসাজোশের এই প্রক্রিয়া শুরু করে। বিএইচপি‘র সময়কাল থেকেই এখানে খোলামুখ পদ্ধতিতে খনি উত্তোলনের কথা বলতে থাকে কোম্পানিগুলো। ১৫ জানুয়ারী, ২০০৫ তারিখে গোপনে ও অবৈধভাবে উম্মুক্ত খনন পদ্ধতি এবং ফুলবাড়ী ও বড়পুকুড়িয়ায় কোম্পানীর পুকুর চুরি হালাল করার জন্য ‘খনি ও খনিজ সম্পদ বিধিমালা ’৬৮’র ’ পরিবর্তন করে তৎকালীন বিএনপি সরকার। যা কেবল একটি পত্রের মাধ্যমে শুধু কোম্পানিকে জানিয়ে দেয়া হয় কোথাও কোন আলোচনা ছাড়াই। খনি উত্তোলনে যে কোন বিদেশি কোম্পানি কর্তৃক দেয় সাধারণ রয়ালটির পরিমান ২০%-কে পরিবর্তন করে উম্মুক্ত খননে রয়ালটি ৬% ও ভুগর্ভস্থ খননে রয়ালটি ৫% নির্ধারণ করা হয়।

এবং ‘চোরের মা’র বড় গলার’ মত সরকার ঘোষণা করে- ‘‘ কোম্পানিকে সংশ্লিষ্ট সকল বিধিবিধান ও পরবর্তী সময় পরিবর্তিত সকল বিধিবিধান মেনে চলতে হবে’’। এশিয়া এনার্জি ২০০৩ সালে জানায় খনি উত্তোলনের আগে ২ বছরের জরিপ-সমীক্ষায় তারা ব্যয় করবে ১৩.৫ মিলিয়ন ডলার। যা ২০০৫ সালে বাড়িয়ে প্রথমে বলে ১৮ মিলিয়ন ডলার এবং পরে আরো বাড়িয়ে বলে ২০ মিলিয়ন ডলার । আর শুরু থেকে খনির জীবনকাল ৩০/৩৫ বছরের বেশী সময়ে মোট বিনিয়োগের পরিমান তারা অতি অল্প সময়ে ৪ দফায় আকাস-কুসুম পরিবর্তন করে। প্রথমবার জুন, ২০০৫- এ বলে ১.৪ বিলিয়ন ডলার, সেপ্টেম্বর, ২০০৫-এ ১.৬ বিলিয়ন ডলার, ০২ অক্টোবর, ২০০৫-এ বলে ১২ বিলিয়ন ডলার এবং সবশেষে ফেব্র“য়ারী, ২০০৬-এ বলে ১৪ বিলিয়ন ডলার।

যা তৃতীয়বারের তুলনায় প্রায় ১.৭ গুন, দ্বিতীয়বারের তুলনায় ৮.৭৫ গুন এবং প্রথমবারের তুলনায় ১০ গুন বেশী। এ হল বিদেশি কোম্পানি কর্তৃক খরচ বেশি দেখিয়ে দ্রুত গতিতে সম্পদ লুটের পুরোনো কৌশল। কোম্পানির দেয়া তথ্যে ফুলবাড়ী কয়লা খনির সংক্ষিপ্ত বর্ননা হলোঃ এই খনিতে কয়লা স্তরের পুরুত্ব ১৫ থেকে ৭৫ মিটার। যার বিস্তৃতি ৩Х৮ বর্গ কি. মি. এলাকা জুড়ে। এশিয়া এনার্জি কর্পোঃ বাৎসরিক ১৫ মিলিয়ন টন হারে ৩০-৩৫ বছরে এই কয়লা উত্তোলন করবে।

উত্তোলিত কয়লার শতকরা ৮০ ভাগ ভারত ও এশিয়ার অন্যান্য দেশে রপ্তানি করবে কোম্পানি (এদেশের সম্পদে বিদেশিদের পুষ্ট নিশ্চিত করতে)। বাকি শতকরা সর্বোচ্চ ২০ ভাগ কেবল দেশের মধ্যে থাকবে নিজেদের ব্যবহারের জন্য। খনির পাশেই পর্যায়ক্রমে ২১০০-২৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে এই ২০% কয়লা ব্যবহার করে কোম্পানিই আবার উৎপাদিত বিদ্যুৎ আমাদের কাছে বিক্রি করবে। এজন্য ০৯ অক্টোবর, ২০০৫, এশিয়া এনার্জি ৫০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা জমা দেয়। এছাড়াও ঐ ২০ ভাগ ও আরো কয়লা যাতে সহজে বিক্রি করা যায় সেলক্ষ্যে পরোক্ষভাবে এদেশে টাটা কোম্পানির বিনিয়োগের পক্ষেও ওকালতি করেছে এশিয়া এনার্জি।

এখানকার কয়লার শতকরা ৭৫ ভাগ উন্নত তাপীয় কয়লা, যাতে ক্ষতিকারক সালফারের পরিমান শতকরা এক ভাগেরও কম। খনিতে উপজাত হিসেবে পাওয়া যাবে মুল্যবান বেশ কিছু উপাদান। ৬% রয়ালটির বাইরে এসব উপাদানসহ খনিতে আরো কিছু থাকলে (প্রাচীন কয়লা খনিতে অত্যন্ত মূল্যবান প্রাকৃতিক/খনিজ হীরক পাবার সম্ভাবনা থাকে। এখানে সে সম্ভাবনা আছে কিনা কোম্পানি নিশ্চয় তা জানতে দিবে না। ) তার কোন কিছুতেই বাংলাদেশের কোন অধিকার থাকবে না।

কোম্পানির তথ্যমতে উপজাত হিসেবে পাওয়া যাবে- রাস্তা, ইট ইত্যাদি তৈরীর ক্লে ( বিশেষ ধরনের কাঁদা ); কাঁচ তৈরীর টারসিয়ারী বালু; কাগজ, ঔষধ, সিরামিক সামগ্রী তৈরীর কেওলিন; বালুপাথর: কাঁদাপাথর; কঠিন শিলা(ৎড়পশ); সিমেন্টের পরিবর্তে ব্যবহারযোগ্য ফ্লাই এ্যশ; পানি ইত্যাদি। খনি বাস্তবায়িত হলে আমাদের দেশের সম্ভাব্য ইতিবাচক মোট প্রাপ্তি হলো- ১। বাৎসরিক ২৪৫ মিলিয়ন ডলার ট্যক্স ও রয়ালটি (যা বর্তমান রপ্তানী আয়ের তুলনায় খুব নগন্য, ০.৩%-এরও কম)। ২। ২১০০ জনের অস্থায়ী ও ১১০০জনের স্থায়ী চাকুরী (যা দেশের বড় একটি পোল্ট্রী ফার্মের কর্মসংস্থানের তুলনায়ও কম)।

মাত্র ৯১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে কোম্পানি পাবে (বাৎসরিক ৭১৫ মিলিয়ন ডলার হারে মোট ২৫ বিলিয়ন ডলার বা দুই লক্ষ কোটি টাকা মূল্যের ) আমাদের সম্পদের সবটুকু। আর অনেক কমিয়ে বললেও এর যা ফল হবে তা হলো- ১. সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৬ লক্ষাধিক মানুষ, যাদের অধিকংশকেই (প্রায় ২লাখ) করা হবে চিরতরে ভিটা-বাড়ী ও সবকিছু থেকে উচ্ছেদ। ২. প্রথম দফায়ই ধ্বংস হবে ১০ হাজার হেক্টর আবাদী জমি, ১৩৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা এবং পর্যায়ক্রমে ৬৫৬.৩৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা। ৩. চিরজীবনের জন্য তৈরী হবে কয়েক বর্গ কি. মি. এলাকা জুড়ে ১০০০ফুট গভীর খনির বর্জযুক্ত বিষাক্ত পানির এক খাদ। ৪. বিষিয়ে যাবে সমগ্র উত্তরবঙ্গসহ পর্যায়ক্রমে গোটা দেশের জলজ পরিবেশসহ সামগ্রিক পরিবেশ, ধ্বংস হবে জৈব বৈচিত্র।

৫. নিশ্চিত হবে সমগ্র উত্তরবঙ্গের মরুকরণ প্রক্রিয়া। ১২০০ বৃহদাকৃতির নলকুপে প্রতি সেকেন্ডে ৮ হাজার লিটার পানি উত্তোলিত হওয়ার ফলে খনির চারদিকে ৫০/৬০ কিলোমিটার এলাকা হবে একেবারে পানিশুন্য (ভূগর্ভস্থ পানিস্তর শুন্য হওয়ার কারণে)। সমগ্র উৎপাদন তো পরের কথা ! কেবল কয়েকটি ফসলের হিসেবে প্রতিবছর ক্ষতি হবে ১৮০০ কোটি টাকার বেশি। যা খনি হতে প্রতিবছরের আয়ের তুলনায় ৩০০ কোটি টাকা বেশি। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে নীট ক্ষতি বার্ষিক ৩০০ কোটি টাকা।

এসব ধ্বংসযজ্ঞের জন্য কোম্পানি সূচি ঠিক করেছিল -২০০৬ সালের শেষ দিকে (সম্ভবতঃ সেপ্টেম্বর/অক্টোবর মাসে) ভূনিম্নস্থ পানিস্তর শুন্য করার জন্য ব্যাপক ভিত্তিতে পানি উত্তোলন শুরু করবে। ২০০৮/ ’০৯ সাল নাগাদ কয়লা স্তরের উপরের মাটি খনন করে কয়লা উত্তোলন করা শুরু করবে। ২০১১ সালে উৎপাদন সর্বোচ্চ মাত্রায়-বাৎসরিক ১৫ মিলিয়ন টনে পৌছবে। এশিয়া এনার্জি’র প্রস্তাবিত এই খনির সীমানা ছিল- ফুলবাড়ী পৌরসভাকে মাঝখানে রেখে দক্ষিণে ও দক্ষিণ-পূর্বে বিরামপুর থানার খানপুর-দক্ষিণ শাহবাজপুর থেকে শুরু করলে এরপর দক্ষিণ-পূর্বে নবাবগঞ্জ থানার জয়পুর ইউনিয়ন, উত্তর-পূর্বে পার্বতীপুর থানার হামিদপুর ইউনিয়ন, উত্তরে ফুলবাড়ী পৌরসভা, উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে যথাক্রমে ফুলবাড়ী থানার খয়েরবাড়ী, আলাদীপুর ও দৌলতপূর ইউনিয়ন এবং বিরামপুর থানার গোলাপগঞ্জ ইউনিয়ন। (চলবে...)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.