১৯৯৯ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ঢাকার একটি নাম করা প্রতিষ্ঠানে আমি শিক্ষকতা করতাম। এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়ে বাঙলা পড়াতাম। সময় পেলে পুঁথিগত সিলেবাসের বাইরেও আমার মায়ের শেখানো প্রিয় বাঙলা ভাষা, এর নানা বৈশিষ্ট্য ও সম্ভাবনা নিয়ে কাসে আলোচনা করে আমি তৃপ্তি লাভ করতাম। আমার অতি প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীরাও প্রত্যাশা করত গতানুগতিক পড়াশুনার চাপ হালকা করতে নিয়মিত প্রাসঙ্গিক লেকচারের পাশাপাশি আমি যেন তাদের মধ্যে কিছুটা সাহিত্য রস বিলাই এবং সম্ভাবনার কথা বলি। এরই ধারাবাহিকতায় আমি তাদের মধ্যে বাঙলা ভাষা বিষয়ক আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি স্থাপনের চর্চা করতাম।
আমি বিশ্বাস করতাম এবং এখনও করি যে, বাঙলা ভাষার একজন শিক্ষক হিসেবে সেটা আমার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অনিবার্য দায়িত্বও বটে।
আমি অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস ও নির্বিঘœ ভবিষ্যৎ দর্শনের ভিত্তি মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে একটি অনিবার্য বার্তা পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করেছি যে, অচিরেই বাঙলা হবে আন্তর্জাতিক ভাষা। কথার কথা নয়, সত্যি সত্যিই হবে। অসম্ভব কিংবা অবিশ্বাস্য মনে হলেও একদিন তা নিশ্চয়ই হবে। সংশয়, সঙ্কট যতই থাকুক বাঙলা ভাষা অবশ্যই একদিন আন্তর্জাতিক ভাষার নমর্যাদা লাভ করবে।
এ অভিনব বার্তা তাদের মধ্যে কিছুটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া উৎপাদন করলেও অধিকাংশের মধ্যে আমি অনন্য আশাবাদ জাগ্রত হতে দেখেছি। আমি অবশ্য আমার দাবীর পক্ষে বিশ্লেষণাত্মক যুক্তি, তর্ক, দর্শন, ঐতিহাসিক ভিত্তিসহ সমুদয় হিসাব-নিকাশ তাদের সামনে উপস্থাপন করেছি। তাদের মধ্যে অস্থিরচিত্ত মানসিকতার অপরিপক্ক কেউ কেউ ধারণা করত বোধ হয় ২/১ বছরের মধ্যেই এটি সত্যে পরিণত হবে। বিষয়টি মূলত সে রকম নয়।
একটি ভাষা আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য ঐ ভাষার মধ্যে যেসব গুণাগুণ, যোগ্যতা, ঐতিহ্য ও মর্যাদা থাকা বাঞ্ছনীয় তার সবই আমাদের প্রিয় বাঙলা ভাষার মধ্যে বিদ্যমান।
এ ভাষার সমৃদ্ধ বর্ণমালা ও শব্দ ভা-ার, আভিজাত্য, আকর্ষণীয় বাচন রীতি, উত্তমরূপে ভাব প্রকাশের সহায়ক শব্দ ও বাক্য পদ্ধতি, ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষার বিধিবদ্ধ নিয়ম-কানুন, ভাষার মর্যাদা রক্ষার স্বীকৃত ঐতিহ্য ইত্যাদি সব বৈশিষ্ট্যই অত্যন্ত গর্বের সাথে ধারণ করছে বাঙলা ভাষা। তবে এর পাশাপাশি আরো যেসব বিষয়সমূহ আবশ্যক তাহলো, সংশ্লিষ্ট ভাষা রাষ্ট্রের সার্বভৌম শক্তিমত্ত্বা, সে রাষ্ট্রের প্রভাবশালী, মর্যাদাপূর্ণ, সৎ ও আন্তর্জাতিক বিশ্বে গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব, রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ জাতিগত ঐকমত্য, আন্তর্জাতিক বিশ্বের সাথে অবিতর্কিত সুসম্পর্ক এবং উক্ত মর্যাদায় উন্নীত করতে আপোষহীন প্রচেষ্টা। এ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট ভাষাভাষীর সংখ্যাগত অনুপাত, জনগোষ্ঠীর যোগ্যতা, পারদর্শিতা, আত্মবিশ্বাস, মর্যাদাবোধ, নিঃস্বার্থ দায়িত্ব বহনের ক্ষমতা, জাগরণের ঐতিহ্য ইত্যাদি অপরিহার্য সম্পূরকের ভূমিকা পালন করে।
আমার সেই বার্তায় মুগ্ধ ও এর বাস্তবায়ন প্রত্যক্ষ করার জন্য অপেক্ষমান এক ছাত্রী বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। গতকাল তার সাথে ফোনে কথা বলার সময় প্রসঙ্গত বইমেলার খবর জানতে চাইল এবং সে বলেই ফেলল, ‘স্যার ! আপনি বলতেন অচিরেই বাঙলা হবে আন্তর্জাতিক ভাষা।
কিন্তু কই ? অনেক দিন তো পার হয়ে গেল, এখনো তো কিছু হলো না। আর কতদিন লাগবে ? আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, তোমার কি বিশ্বাস হয় যে, এটা হওয়া সম্ভব ? সে উত্তরে বলল, স্যার আপনি বলেছেন, আমি ১০০% বিশ্বাস করি।
সময়ের একক সব ক্ষেত্রে একই রকম দৈর্ঘ্য প্রকাশ করে না। অফিসে বসে বন্ধুকে ফোনে বললাম যে, তুই রেডি হ আমি শীঘ্রই বের হচ্ছি। এর দৈর্ঘ্য ৫ থেকে ১০ মিনিট হতে পারে।
শীঘ্রই জাতি ক্রান্তিলগ্ন থেকে মুক্তি পাবে না। এখানে শীঘ্র এর মেয়াদ কয়েক বছর কিংবা কয়েক দশকও হতে পারে। আমার বার্তার ক্ষেত্রেও এ বাস্তবতা প্রযোজ্য। আগামী মাস কিংবা আগামী বছরেই বাঙলা আন্তর্জাতিক ভাষা হয়ে যাচ্ছে এমনটি ভাববার কোন কারণ নেই। এটি দীর্ঘ মেয়াদ সাপেক্ষ।
বাঙলা ভাষা কথিত মর্যাদায় অভিষিক্ত হতে যোগ্যতা রাখে কিন্তু তাকে সেখানে পৌঁছাতে উপযুক্ত নেতৃত্বের প্রয়োজন। প্রয়োজন আমাদের নিজেদের যোগ্যতা ও মর্যাদাকে বিশ্বের দরবারে প্রমাণ করার পাশাপাশি মা ও মায়ের ভাষার উপযুক্ত সেবক হিসেবে তার মর্যাদা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার আন্তরিক প্রচেষ্টা চালানো।
আশার কথা হলো ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখটি সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। এদিন বিশ্ববাসী শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে বাঙলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য আমাদের সাহস, ত্যাগ ও সংগ্রামী আন্দোলনের সমৃদ্ধ ইতিহাস। এটার পরিণতি কি শুধুই শূন্য।
এটা আমাদের আশাবাদ সত্যে পরিণত হওয়ার পথে এক ধাঁপ বাস্তব অগ্রগতি। এটা আমাদের ভাষা সংগ্রামের রক্তমাখা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্ববাসীর স্বীকৃতি ও শ্রদ্ধার স্বরূপ। প্রতি বছর মাতৃভাষা দিবসে তারা নিজেদের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের পাশাপাশি যে ভাষার সংগ্রামী ঐতিহ্য স্মরণ করে একই পাইপ লাইনের মাধ্যমে ভাষাটি আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভের খবর পৌঁছলে সম্ভবত তারা তা প্রত্যাখ্যান করবে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।