আমরা হেরে যাইনি। এশিয়া কাপ না জিতলেও তোমরা আমাদের হৃদয় জয় করেছ। আমরা গর্বিত দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে উন্মুক্ত হচ্ছে বহুল আলোচিত হাতিরঝিল প্রকল্প। ইতিমধ্যে এর শতকরা ৯৩ ভাগ উন্নয়ন কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের বিরুদ্ধে দায়ের করা অধিকাংশ মামলারও উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে।
প্রকল্প এলাকায় অবস্থিত বহুল আলোচিত বিজিএমইএ ভবনটিও সরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে কর্তৃপক্ষ। নতুন ভবন নির্মাণের জন্য জমি খোঁজা হচ্ছে উত্তরায়। আগামী ১৫ ডিসেম্বরই এটি উদ্বোধন করার কথা ছিল। পরদিন মহান বিজয় দিবসসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান থাকায় প্রধানমন্ত্রী ওইদিন (১৫ ডিসেম্বর) সময় দিতে না পারায় উদ্বোধনের তারিখ পেছানো হয়েছে। অচিরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটির উদ্বোধন করবেন বলে রাজউক সূত্র জানিয়েছে।
হাতিরঝিল প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হচ্ছে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, জলাবদ্ধতা ও বন্যা প্রতিরোধ, ময়লা পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, রাজধানীর যানজট নিরসন এবং নগরীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা। প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী এ এস এম রায়হানুল ফেরদৌস ইত্তেফাককে বলেন, প্রকল্পের কাজ শেষ হলে মাত্র কয়েক মিনিটেই এর গা ঘেঁষে রাস্তা দিয়ে রামপুরা থেকে কারওয়ান বাজার বা কারওয়ান বাজার থেকে অল্প সময়ে পৌঁছে যাওয়া যাবে গুলশান হয়ে বাড্ডা। এতে করে তেজগাঁও, গুলশান, বাড্ডা, রামপুরা, মৌচাক ও মগবাজারের অসহনীয় যানজট অনেকাংশে কমে আসবে। তিনি বলেন, পরিবেশ ও নান্দনিকতার দিক থেকে হাতিরঝিল ঢাকায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। হাতিরঝিলের সাথে ক্রমান্বয়ে গুলশান ও বনানী লেকের সংযোগ দেয়া হবে।
সারা বছর ঝিলের পানি স্বচ্ছ রাখার ব্যবস্থা থাকবে। ঝিলের চারদিকে ওয়াকওয়ে নির্মাণ, ওভারপাসসহ ঝিলের দুপাশে পূর্ব-পশ্চিমে সড়ক নির্মাণ করা, লেকের এপার থেকে ওপারে যাওয়ার জন্য থাকবে দৃষ্টিনন্দন সেতু, নজরকাড়া বাহারি ফোয়ারা, চমত্কার শ্বেতশুভ্র সিঁড়ি, বিনোদনের জন্য থাকবে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, শিশুপার্ক। বিশ্বমানের থিয়েটার, শরীর চর্চা কেন্দ্র, পর্যটকদের নামাজ আদায়ের জন্য থাকবে মসজিদ। পালতোলা নৌকায় নৌবিহার করার সুবিধাও থাকবে এখানে।
অথচ বছর কয়েক আগেও হাতিরঝিল ছিল পচা পানির আধার।
কিন্তু বর্তমানে এটি ঝকঝকে পানি ধারণ করছে। পাম্পের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হবে এই ঝিলে। ময়লা পানি নিষ্কাশনেরও ব্যবস্থা থাকবে এখানে। ঝিল ঘেঁষা রাস্তার পাশে বৃক্ষরাজি আর ফুলের সমারোহ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট আব্দুল মান্নান খান ইত্তেফাককে বলেন, হাতিরঝিল প্রকল্পের শত ভাগ মাস্টার প্লান বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
মাঝে মামলা-মোকদ্দমাসহ আইনি জটিলতার কারণে প্রকল্পের উন্নয়ন কাজ অনেকটা বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তবে সৃষ্ট মোকদ্দমাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে হাইকোর্টে দুটি পৃথক বেঞ্চ গঠন করা হয়েছে। উক্ত বেঞ্চ ৭৬টি মামলার মধ্যে ৭০টি মামলা নিষ্পত্তি করেছে।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ৩০২ দশমিক ৮৭২৩ একর ভূমির মধ্যে ইতিমধ্যে ২৯৯ দশমিক ৮৪৩৩ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ৪টি ব্রিজ, ৪টি ওভারপাস, ৩টি ভায়াডাক্টের কাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে।
সম্পন্ন হয়েছে শতভাগ ভূমি খনন কাজ। রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে ৯৮ ভাগ। ব্রিজ নির্মাণের কাজ হয়েছে ৯৯ ভাগ। ওভারপাসের কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৯৮ ভাগ। ফুটপাত ৮৫ ভাগ।
ওয়াকওয়ে ৬০ ভাগ। মেইন ডাইভারসন স্যুয়ারেজ ৯৮ ভাগ। লোকাল ডাইভারসন স্যুয়ারেজ ৯৫ ভাগ। বিশেষ ডাইভারসন কাঠামো ৯০ ভাগ। পানি সরবরাহ ব্যবস্থা শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে।
হাতিরঝিল প্রকল্পের আবর্জনার পরিমাণ ধরা হয়েছিল ১০ কোটি ৫৫ লাখ সিএফটি। এ পর্যন্ত পরিষ্কার করা হয়েছে ৮ কোটি ৮৫ লাখ সিএফটি। বাকি কাজগুলোও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী এলাকার পরিবেশ দূষণরোধ, জলাবদ্ধতা নিরসন, অবৈধ দখল উচ্ছেদ, ড্রেনেজ ও স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা ও পরিবেশগত উন্নয়নসহ বেশ কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে ২০০৭ সালে শুরু হয় এই প্রকল্পের বাস্তবায়নের কাজ। ওই বছরের অক্টোবরে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন দেয়া হয়।
তখন বরাদ্দ ধরা হয় এক হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা। যা ২০১০ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা। পরবর্তী সময়ে এর ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। একই সাথে সময় বৃদ্ধি করা হয় ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। এই প্রকল্পের জন্য ৩০২ দশমিক ৮৭২৩ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়।
প্রকল্পের অধিকাংশ জমিই ব্যক্তি মালিকাধীন হওয়ায় ভূমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে এই ৭৬টি মামলার সূত্রপাত হয়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হাতিরঝিল প্রকল্পে যে ৭৬টি মামলা হয়েছে তার সবগুলোরই বাদি স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত অধিবাসী ও একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বেশিরভাগ মামলা হয়েছে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে। হাতিরঝিল প্রকল্পের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত প্রায় সব মামলা একই ধরনের। তবে প্রকল্পের জমির মধ্যে ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৩৯ একর জমির জন্য ৪৮৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, বাজার মূল্যের চেয়ে কমদামে সরকার ভূমি অধিগ্রহণ করেছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রায় সব অবকাঠামোও ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে।
এ বিষয়ে উচ্ছেদ হওয়া এক পরিবারের সদস্য মিজানুর রহমান ইত্তেফাককে জানান, সরকার কর্তৃক উচ্ছেদ ও বাজার মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে ভূমি অধিগ্রহণ করার ফলে তার পরিবার মামলা করেছে।
রাজউকের চেয়ারম্যান মো. নূরুল হুদা ইত্তেফাককে বলেন, 'প্রকল্পের জন্য প্রথম দিকে যে ২৪৪ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, সেখানে ১৫০টি ব্যক্তি মালিকানাধীন অবকাঠামো ছিল। পরে জনগণের ক্ষয়ক্ষতির কথা বিবেচনা করে আমরা প্রকল্পের ম্যাপ পরিবর্তনের মাধ্যমে নিচু জায়গা নির্বাচন করে যে নকশা তৈরি করি সেখানে ৩৯টি ব্যক্তি মালিকানাধীন অবকাঠামো ভাঙ্গতে হয়।
ফলে ওই সব ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা বাদী হয়ে মামলা করেন। সঠিক মূল্যে সব ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পের বিরুদ্ধে যে ৭৬টি মামলা বিচারধীন রয়েছে তা নিষ্পত্তি করতে নানা উদ্যোগ গ্রহন করে রাজউক কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে রাজউকের আইন কর্মকর্তা রোকন-উদ-দৌল্লা ইত্তেফাককে বলেন, 'হাইকোর্টে রাজউক অধিকাংশ মামলায় জিতেছে। এখন ৬টি মামলা আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে।
সৃষ্ট মোকদ্দমাগুলো দ্রুত নিস্পত্তির লক্ষ্যে হাইকোর্টে দুটি পৃথক বেঞ্চ গঠন করা হয়েছে। উক্ত বেঞ্চ ৭৬টি মামলার মধ্যে ৭০টি মামলা নিস্পত্তি করেছে। আশা করি অবশিষ্ট ৬টি মামলার রায়ও রাজউকের পক্ষে আসবে। '
রাজউকর সদস্য (উন্নয়ন) প্রকৌশলী এম মাহবুব-উল-আলম ইত্তেফাককে বলেন, আমরা চেষ্টা করছি অবশিষ্ট মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে। এ জন্য অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
বিজিএমইএ ভবন নিয়ে জটিলতা কাটবে শিগ্রই
হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায় অবস্থিত বিজিএমইএ ভবন নিয়ে জটিলতা কাটতে শুরু করেছে। এ বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান মো. নুরুল হুদা বলেন, এই ভবনের কারণে হাতিরঝিল প্রকল্পের উন্নয়ন কাজ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতে মামলা রয়েছে। মামলার কারণে ভবনটি আপাতত ভাঙ্গা যাচ্ছে না। তবে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার আলোকে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহন করা হবে।
তিনি বলেন, অবশ্য বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ ভবনটি সরিয়ে নিতে সম্মত হয়েছেন। তারা উত্তরায় জমি চেয়েছেন। জমি খোঁজাও হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে বিজিএমইএর ভবন নিয়ে জটিলতার শিগগিরই নিরসন হবে।
হাতিরঝিল প্রকল্পের কাজ সম্পাদনের জন্য বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে রাজউককে ১ হাজার ১১৩ কোটি ৭ লাখ টাকা, এলজিইডিকে ২৭৬ কোটি টাকা, ঢাকা ওয়াসাকে ৮৬ কোটি ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
প্রকল্প সমীক্ষায় জড়িত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে ১ কোটি ৯২ লাখ ৪০ হাজার টাকা এবং বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশনকে (এসডব্লিউও) ৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যে ১৫০ কোটি টাকা জাপানের ঋণ মওকুফ অনুদানের। বাকি টাকা অর্থায়ন করছে বাংলাদেশ সরকার।
উল্লেখ্য হাতিরঝিল প্রকল্পটিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্পেশাল ওয়ার্কস অরগানাইজেশন ( এসডব্লিউও) এর পশ্চিম বিভাগের কর্মকর্তা ও সৈনিকরা মাঠ পর্যায়ে সামগ্রিকভাবে কাজের বাস্তবায়ন করছেন। রাজউক লিড অরগানাইজেশন হিসাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।