আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নীলিমা ইব্রাহিমঃ শিক্ষকতা ও সাহিত্য চর্চার এক অনন্য নাম

মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।

নীলিমা ইব্রাহিমের জন্ম ১৯২১ সালের ১১ জানুয়ারী। খুলনা জেলার বাগেরহাট মহকুমার মূলঘর গ্রামে জমিদার পরিবারে। তার পারিবারিক নাম ছিল নীলিমা রায় চৌধুরী। বাবা প্রফুল্ল রায়চৌধুরী।

মা কুসুমকুমারী দেবী। শৈশব কাটিয়েছেন খুলনায়৷ বাবা প্রফুল্ল কুমার সাহিত্য ও সঙ্গীত প্রিয় ছিলেন। বাবার পারিবারিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ছোটবেলা থেকেই নীলিমা ইব্রাহিমের মনে দাগ কাঁটে। যা পরবর্তীতে তাঁর চেতনা ও জীবন-কর্মে প্রভাব ফেলে। পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে।

তারপর পাঠশালা ও প্রাইমারী। এরপর ভর্তি হন খুলনা করনেশন গার্লস স্কুলে। এই স্কুল থেকে ১৯৩৫ সালে মাধ্যমিক পাশের পর ভর্তি হন কলকাতার বিখ্যাত ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশনে। সেখান থেকেই উচ্চমাধ্যমিক (১৯৩৭ সালে) ও অনার্স (অর্থনীতি) (১৯৪০ সালে) ডিগ্রী অর্জন করেন। ওই বছর তিনি এম.এ. অর্থনীতি নিয়ে ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

তবে গুরুতর অসুখ কারণে অর্থনীতিতে এম.এ. পড়া আর শেষ করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। এ অসুখ উচ্চমাধ্যমিক পড়াশুনাকালেও তাঁকে ভুগিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বি. টি সম্পন্ন করেন। কিন্তু এম.এ পাশের অদম্য ইচ্ছা তিনি মনে ধরে রেখেছিলেন। এরপর ১৯৪৩ সালে তিনি বাংলায় ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এবার অবশ্য এম. এ. ডিগ্রী অর্জন করতে আর কোনো সমস্য হলো না। ১৯৪৫ সালে মেয়েদের মধ্যে প্রথম তিনিই ‘বিহারীলাল মিত্র গবেষণা’ বৃত্তি অর্জন করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি.এইচ.ডি. ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৫৫ সালে পি.এইচ.ডি. করতে আসার দুসপ্তাহের মধ্যে বাংলা বিভাগের প্রফেসর আব্দুল হাইয়ের কথায় একরকম বাধ্য হয়েই বাংলা বিভাগে যোগ দেন। ১৯৫৬ সালে শুরু করে সেই দায়িত্ব তিন দশককাল পরম নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন নীলিমা ইব্রাহিম।

এর পূর্বে তিনি অর্নাস পাশের পর চাকুরী নিয়েছিলেন তাঁর নিজেরই শৈশবের স্কুলে। সেখানে খুব বেশি দিন শিক্ষকতায় তিনি ছিলেন না। এম.এ. পাশের পর তিনি শিক্ষকতায় পুরোপুরি যুক্ত হয়ে পড়েন। এসময় তিনি নিজ কলেজ ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশনে শিক্ষকতা শুরু করেন। নিজ কলেজের সবাইকে শ্রদ্ধা করলেও কখনোই অন্যায়কে মেনে নেননি।

তাই ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশনের প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার কথা পত্রিকায় লেখার কারণে কর্তৃপক্ষের রোষাণলে পড়েছিলেন বার বার। ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ইন্ডিয়ান আর্মি মেডিকেল কোরের ক্যাপ্টেন ডাঃ মোহাম্মদ ইব্রাহিমের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর নীলিমা রায় চৌধুরী হয়ে যান নীলিমা ইব্রাহিম। ১৯৪৬-৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি পুরোপুরি সংসারী হয়ে পড়েছিলেন। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ী গেন্ডারিয়ায় থাকতে শুরু করেন।

এখানেই তাদের প্রথম সন্তান খুকুর জন্ম হয়। স্বামীর চাকরির বদলির কারণে পিরোজপুর, যশোর, বরিশাল, খুলনায় যেতে হয় তাঁকে। তাদের সংসারে আরও চার মেয়ে ডলি, পলি, বাবলি ও ইতির জন্ম হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি অধ্যাপক নুরুল মোমেন, আসকার ইবনে শাইখ, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার সঙ্গে নীলিমা ইব্রাহিম যুক্ত হয়ে পড়েন নাট্যচর্চায়। এই নাট্যচর্চার ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে নবগঠিত বুলবুল একাডেমীতে ক্লাস নিয়েছেন নাটকের উপর।

এক সময় নাটক লিখেছেন তিনি। তঁর লেখা প্রথম নাটক ‘মনোনীতা’ মঞ্চস্থ হয় বুলবুল একাডেমীর ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে। তিনি ১৯৬২-৬৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘রঙ্গম’ নামের একটি নাট্য সংস্থা। তাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মুনীর চৌধুরী, রণেন কুশারী, কবি হাবিবুর রহমানসহ আরো অনেকে। তাঁর নিজের দলের জন্য তিনি শরত্‍চন্দ্রের ‘চরিত্রহীন’ নাটকের নাট্যরূপ দেন।

এ দলটি অবশ্য পরে ভেঙ্গে যায়৷ এ সময় তিনি রেডিও টেলিভিশনের জন্য প্রচুর নাটক লিখেছেন। তিনি ছিলেন শৈশবকাল থেকে ফুটবল খেলার ভক্ত। ছোটবেলায় তিনি নিজেই খেলেছেন৷ একটু বড় হয়ে কলকাতায় খেলা দেখা শুরু করেন। ঢাকায় এসেও তিনি সেটা ধরে রেখেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে তিনি প্রায় নিয়মিতই টিকিট কেটে ফুটবল খেলা উপভোগ করতেন।

তিনি রাজনীতি করতেন না। কিন্তু ষাটের দশকের ঢাকার রাজনীতির উত্তপ্ততা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেননি কখনো। শিক্ষকতা জীবনের পাশাপাশি যতটুক সম্ভব ততটুক যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ক্যাম্পাসেই ছিলেন তিনি। ২৭ মার্চ ক্যাম্পাস ছেড়ে নারিন্দায় চলে যান।

৩০ মার্চ চলে যান গ্রামে। সেখানে বসে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন। স্বাধীনতার পর প্রফেসর নীলিমা ইব্রাহিম একাত্তরের হতভাগ্য নারীদের পুনর্বাসন এবং ওয়ারবেবিদের বিদেশীগণ কর্তৃক এ্যাডাপ্ট করার সমস্যা নিয়ে দিনের পর দিন নীরবে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। এই সমস্যা মোকাবেলায় প্রফেসর নীলিমা ইব্রাহিম যার সঙ্গে কাজ করেন তিনি হলেন বিচারপতি কে এম সোবহান। একাত্তরে নির্যাতিত নারীদের অবমাননার কিছু কিছু কাহিনী তিনি লিখেছেন।

যার কয়েকটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে প্রচারিত হয়েছে। ১৯৭২ সালে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যানের আসনে বসলেন নীলিমা ইব্রাহিম। এ বিভাগের তিনজন শিক্ষক মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা মুক্তিযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। শুরু করলেন নতুন করে বিভাগ গড়ার কাজ। এ সময় উপাচার্য তাঁকে ডেকে অনুরোধ করলেন রোকেয়া হলের প্রভোস্টের দায়িত্ব দেন।

এই দায়িত্ব পাল করেছেন সাত বছর। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু একদিন ডেকে পাঠালেন তাঁকে। সরাসরি প্রস্তাব দিলেন বাংলা একাডেমির দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। এর আগে একবার বঙ্গবন্ধুর দেওয়া মন্ত্রীত্বের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। অবশেষে বাংলা একাডেমীর ডি.জি. পদে তাকে জোর করে নিয়োগ দেওয়া হয়।

শেষ পর্যন্ত তিনি চাকরি ছেড়ে দেন ১৯৭৫ সালে। তিনি মহিলা পরিষদেরও সভানেত্রী ছিলেন। জীবনের একবারে শেষ প্রান্তে এসে জাতীয় দৈনিকে কলাম/উপসম্পাদকীয় লিখে অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৯৬ সালে আজকের কাগজে ‘মাগো আমি কোথা যাবো’ শীর্ষক উপসম্পাদকীয় লিখে তত্‍কালীন সরকারের মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। এ জন্য তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা রুজু করা হয়।

অসুস্থ শরীরে কন্যার বাড়ীতে আশ্রয় নিয়ে পুলিশের গ্রেপ্তারের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। পালিয়ে থাকা অবস্থায় হাইকোর্টে সশরীরে উপস্থিত হয়ে তিনি জামিনের আবেদন করেন। মামলাটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ভাষা সৈনিক এডভোকেট গাজিউল হক। কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হন। তাত্‍ক্ষনিকভাবে তিনি নিম্ন আদালতে হাজির হলে নিম্ন আদালতের হাজার হাজার আইনজীবী আদালত কক্ষে জমায়েত হন এবং তাঁকে জামিন দেওয়া না হলে তাঁরা আদালত কক্ষ ত্যাগ করবেন না বলে জানান।

শেষ পর্যন্ত নিম্ন আদালত তাঁকে জামিন দিতে বাধ্য হয়। নীলিমা ইব্রাহিম আজীবন মানুষের শুভ ও কল্যাণ চেতনায় আস্থাশীল ছিলেন৷ মুক্তবুদ্ধি, অসামপ্রদায়িক চেতনা ও উদার মানবিকতা ছিল তাঁর জীবনদর্শন। সাহিত্যকর্মঃ গবেষণা- শরৎ প্রতিভা (১৯৬০), বাংলার কবি মধুসূদন (১৯৬১), উনবিংশ শতাব্দীর বাঙ্গালী সমাজ ও বাংলা নাটক (১৯৬৪) উত্‍স ও ধারা (১৯৭২), বেগম রোকেয়া (১৯৭৪), বাঙ্গালী মানস ও বাংলা সাহিত্য (১৯৮৭), সাহিত্য সংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ (১৯৯১)। ছোটগল্পঃ রমনা পার্কে (১৯৬৪)। উপন্যাসঃ বিশ শতকের মেয়ে (১৯৫৮), এক পথ দুই বাঁক (১৯৫৮), কেয়াবন সঞ্চারিনী (১৯৬২), বহ্নিবলয় (১৯৮৫)।

নাটকঃ দুয়ে দুয়ে চার (১৯৬৪), যে অরণ্যে আলো নেই (১৯৭৪), রোদ জ্বলা বিকাল (১৯৭৪)। কথা নাট্যঃ আমি বীরঙ্গনা বলছি (২ খন্ড, ১৯৯৬-৯৭)। অনুবাদঃ এলিনর রুজভেল্ট (১৯৪৫), কথাশিল্পী জেম্স ফেনিমোর কুপার (১৯৬৮)। ভ্রমনকাহিনীঃ বস্টনের পথে (১৯৮৯), শাহী এলাকার পথে পথে (১৯৬৩)। আত্মজীবনীঃ বিন্দু বিসর্গ (১৯৯১)।

সম্মাননাঃ কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ নীলিমা ইব্রাহিম ভূষিত হয়েছেন বহু পদক ও পুরস্কারে ৷ বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৯), জয়বাংলা পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার (১৯৮৭), লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৮৯), বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধূরী স্মৃতিপদক (১৯৯০), মুহম্মদ নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯২), অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৬), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬), বঙ্গবন্ধু পুরস্কার (১৯৯৭), শেরে বাংলা পুরস্কার (১৯৯৭), থিয়েটার সম্মননা পদক (১৯৯৭) ও একুশে পদক (২০০০)। নীলিমা ইব্রাহিম ২০০২ সালের ১৮ জুন মারা যান।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।