১৬৩৯ খৃস্টাব্দে শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র সুলতান মুহাম্মদ সুজা বাংলার শাসনকার্যে নিযুক্ত হন। দীর্ঘ ৩০ বছর পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার সাথে এদেশের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তার আমলে বিহার আলাদা একটি রাজ্যরূপে গণ্য হয়। সুলতান মুহাম্মদ সুজা বাংলায় এসে প্রথমে ঢাকা থেকে নিজামতের দপ্তর রাজমহলে নিয়ে যান। তিনি সুসজ্জিত দালান কোঠা তৈরী করে ওই এলাকাকে আরো বেশি সুসজ্জিত করে তোলেন।
কথিত আছে যে, সুলতান মুহাম্মদ সুজা রাজমহলে উপস্থিত হলে মিঃ বাটন তার সেবা করার সৌভাগ্য লাভ করেন। ঘটনাচক্রে শাহজাদার কোনো এক মহিলা কঠিন রোগে আক্রান্ত ছিলেন। মিঃ বাটনের চিকিৎসার সুখ্যাতি জানতে পেরে শাহজাদা তাঁকে ওই মহিলার চিকিৎসা করার নির্দেশ দেন। মি: বাটনের চিকিৎসায় মহিলা আরোগ্য লাভ করায় মিঃ বাটন আরো বেশি অনুগ্রহ ও অতিরিক্ত মর্যাদা লাভ করেন। এ সেবার পুরস্কারস্বরূপ শাহজাদা ইংরেজ দলকে হুগলী ও বালেশ্বরে ব্যবসা-বাণিজ্যের ভিত্তি স্থাপনের অনুমতি প্রদান করেন।
সুলতান মুহাম্মদ সুজা পিতার প্রতি শ্রদ্ধাবনত ও অনুগত থেকে ৮ বছর ধরে বাংলার শাসনভার পরিচালনা করার পর কাবুলের সুবেদার পদে নিযুক্ত হন। দু'বছর ওখানে কাটানোর পর আবার বাংলায় ফিরে আসেন। এবার ৯ বছর ধরে এদেশের শাসনকার্যে বহাল থাকেন। তিনি ঢাকায় রাজধানী স্থাপন করেন। এখনো ঢাকায় তার অনেক ইমারত আছে।
এ সময় পূর্বের চাইতেও এদেশের বহুল পরিমাণে শ্রীবৃদ্ধি হয়। অধিকাংশ কাজের উন্নতি হয়। নানা রকমের কৌশলী-কারিগর ও শিল্পী এখানে এসে বসতি স্থাপন করে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তার লাভ করে। পূর্বে অর্থাৎ ১৫৮২ খৃস্টাব্দে দেওয়ান রাজা টোডরমলের আমলে বাংলার রাজস্ব এক কোটি সাত লাখ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। সুলতান মুহাম্মদ সুজার সময়ে তা এক কোটি একত্রিশ লাখ পর্যন্ত পৌঁছে।
১৬৪৭ খৃস্টাব্দে সম্রাট শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়েন। চারজন শাহজাদা সুলতান মুহাম্মদ সুজা, দারাশিকো, সুলতান মুরাদ ও আওরঙ্গজেব সকলেই শাহী সিংহাসনে বসার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। সুলতান মুহাম্মদ সুজা বাংলা থেকে সৈন্য নিয়ে বেনারস পর্যন্ত পৌঁছেন। ওই দিকে দারাশিকো তার পুত্র সুলতান সোলায়মানকে এক পরাক্রান্ত বাহিনী নিয়ে সুজার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য পাঠান। পরাজিত হয়ে সুজা বাংলায় ফিরে আসেন।
দিল্লীতে তিন শাহজাদা পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। সকলকে পরাজিত করে এবং শাহজাহানকে বন্দি করে আওরঙ্গজেব দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন।
আওরঙ্গজেবের সিংহাসনে আরোহণ ও শ্রদ্ধেয় পিতাকে বন্দি করার খবর শুনতে পেয়ে সুলতান মুহাম্মদ সুজা অত্যন্ত চিন্তিত ও বিষণ্ণ হলেও আওরঙ্গজেবের নিকট অভিনন্দনবাণী পাঠান এবং প্রার্থনা জ্ঞাপন করেন যেন তাঁকে বাংলার শাসনকার্যে বহাল রাখা হয়। আওরঙ্গজেব তা মেনে নেননি। তাই সুলতান মুহাম্মদ সুজা অত্যন্ত রেগে এক সেনাবাহিনী নিয়ে দিল্লীর দিকে রওয়ানা হন।
কচুয়া নামক স্থানে পৌঁছলে আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনীর সম্মুখীন হন। উভয় বাহিনীর মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ হয়। শুরুতে সুজার সেনাবাহিনী জয়লাভ করে, কিন্তু পরে আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীরজুমলার সুব্যবস্থার দরুণ সুজা পরাজিত হয়ে পশ্চাদপসরণ করেন এবং বাংলার দিকে ফিরে আসেন। প্রথমে রাজমহলে, পরে ওখান থেকে টান্ডায় এসে সেনাবাহিনীকে সুবিন্যস্ত করেন। অপরদিকে মীর জুমলাও এক শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে টান্ডায় উপস্থিত হন।
আবার যুদ্ধ হয়। সুজা পরাজিত হয়ে ঢাকার দিকে পালিয়ে আসেন। মীরজুমলা তার অনুসরণ করে ঢাকা পর্যন্ত আসেন। এখানে এসে সুজা দেড় হাজারের বেশি লোক সংগ্রহ করতে পারেননি। তাই রাজত্বের আশা ত্যাগ করে বায়তুল হারাম মক্কা শরীফে গিয়ে বাকি জীবন ওখানে কাটাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে চট্টগ্রামের দিকে চলে যান।
দুর্ভাগ্যবশত আরব দেশে যাওয়ার মতো কোনো জাহাজ সংগ্রহ করতে পারেননি। শত্রু সৈন্যের অনুসরণের ভয়ে অবশেষে আরাকান রাজার আশ্রয় গ্রহণ করেন।
আরাকান রাজ প্রথমে অনেক সম্মান ও মর্যাদার সাথে তাকে গ্রহণ করেন এবং যথোপযুক্ত আতিথেয়তা প্রদর্শন করেন। কিন্তু কিছুদিন পর শয়তানের প্ররোচণায় তার সাথে দুর্ব্যবহার ও অনাদর শুরু করেন। সুজার কন্যাকে লাভ করার লোভে হতভাগা শাহজাদাকে পরিবার-পরিজনসহ ডুবিয়ে মারেন।
এই দুরাত্মা তার সম্মানহানি করতে চায়। সুজার কন্যা তা বুঝতে পেরে তীক্ষ্ণ ধারালো খড়গ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
সুলতান মুহাম্মদ সুজার সপরিবারে নিহত হওয়ার খবর আওরঙ্গজেবের নিকট পৌঁছলে ১৬৬০ খৃস্টাব্দে আওরঙ্গজেব মীরজুমলাকে মুয়াজ্জম খান খানান উপাধি দিয়ে বাংলার সুবেদার নিযুক্ত করেন। সুবেদার নিযুক্ত হয়ে মীরজুমলা আবার রাজমহল থেকে সুবেদারীর দফতর গড়ে তোলেন এবং উঁচু ইমারত ও নিত্যনতুন কলকারখানা স্থাপন করে আরো সুসজ্জিত করে তোলেন।
এ সময় কুচবিহারের রাজা প্রচুর সৈন্য-সামন্ত নিয়ে বাংলার উত্তর ভাগের অনেক এলাকা দখল করে নেন এবং ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে সেনাবাহিনী নিয়ে ঢাকার নিকট এসে পৌঁছেন।
১৬৬১ খৃস্টাব্দে তাকে উচিত শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে মীরজুমলা এক পরাক্রান্ত বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করেন। তিনি রাজার বাহিনীকে পরাজিত করে কুচবিহার পর্যন্ত অগ্রসর হন এবং সে দেশ দখল করে নেন।
কুচবিহার জয়ের পর মীরজুমলা আসাম জয় করার উদ্দেশ্যে সৈন্য নিয়ে বের হন। সে দেশ আক্রমণ করে জয় করে অনেক লুণ্ঠিত দ্রব্য, নগদ টাকাকড়ি ও মালমাত্তা লাভ করেন। কিন্তু তার সেনাবাহিনীর লোকেরা অসুস্থ হয়ে পড়ার দরুন সেখানে অবস্থান করতে না পেরে ফিরে আসেন।
পথে তিনি নিজেও অসুস্থ হন। কথিত আছে যে, মীরজুমলা অসুস্থ অবস্থায় ঢাকায় পৌঁছে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার সাথীরা কর্পুরের সিন্দুকে করে তার মৃতদেহ জন্মভূমি ইস্পাহানে নিয়ে যান।
বাংলার সুবেদারদের মধ্যে মীরজুমলা খুবই প্রসিদ্ধ। মীর জুমলার নির্মাণ কাজের জন্য এখনো তাকে সকলে স্মরণ করে।
আরাকানী লুটেরাদের প্রতিরোধ ও শাস্তি দেয়ার জন্য তিনি ঢাকার আশপাশে প্রায় এলাকায় দুর্গ নির্মাণ করেন। ওই নিদর্শনাবলী এখনো দেখতে পাওয়া যায়। যেমন নারায়ণগঞ্জের নিকট হাজীগঞ্জের মুন্সীগঞ্জের এদ্রাকপুরে, মেঘনা নদীর পূর্বে দাউদকান্দি প্রভৃতি জায়গায় তিনি দুর্গ নির্মাণ করেন। শহরের ভেতরে ও বাইরে প্রায় জায়গায় পুল ও বড় বড় সড়ক নির্মাণ করেন। পাগলার পুল ও টঙ্গীর পুল এ সময়ে তৈরি হয়।
কথিত আছে যে, টঙ্গী শাহ নামে এক ফকির টঙ্গীরপুল নির্মাণ করেন।
আরাকানী মগদের তাড়ানো ও ভয় দেখানোর জন্য মীরজুমলা বড় বড় কামান সংগ্রহ করে দুর্গ স্থাপন করেন। সবচেয়ে বড় দু'টি কামান শহরের দক্ষিণ দরজায় নদীর দিকে স্থাপন করেন। একটি কামান চকে রাখা হয়েছে। আরো বড় একটি কামান নদী ভাঙনের দরুন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
মীরজুমলার আমলে ঢাকার জনসংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পায় এবং এখানে বেশি করে লোকবসতি স্থাপন করে। নানা ধরনের বাড়ি এবং সব প্রকারের কলকারখানা চালু হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের খুব প্রসার হয় এবং সকল দেশের ব্যবসায়ীরা এখানে আগমন করেন। (সংকলি,নিষ্কাম মিত্র)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।