আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অনুবাদে অনুনাদ অথবা অবসাদে অনুবাদ

আত্মবিশ্বাসহীনতায় প্রকট হচ্ছে আত্মার দেউলিয়াত্ব, তবুও বিশ্বাস আগের মতই নিশ্চল..

শখ বা passion হিসেবে অনুবাদ কাজটাকে কেমন লাগে? অধিকাংশ উত্তরই বোধহয় নেতিবাচক আসবে, আর যারা ইতিবাচক তারাও বিষয়টিকে বলবেন এভাবে -' খুবই কঠিন একটা কাজ, সময়সাপেক্ষ তো বটেই'। অনুবাদের কাজটিকে ক্রিকেট আম্পায়ারিংয়ের থ্যাঙ্কলেস জবের সাথে তুলনা করা যেতে পারে- উপযাচক হয়ে কেউ উৎসাহ দেবেনা, নিরুৎসাহিতও করবেনা তেমন একটা। তবে কাজ শেষে এদেরই কেউ কেউ নাক সিটকাবে, কিংবা কারো কারো অর্ধবৃত্তাকার ভ্রু কোচকাতে কোচকাতে রূপ নেবে ডোরাকাটে সাপে- 'ছ্যা ছ্যা, এইটা কোন অনুবাদ হইছে! ডিকশনারী দেইখা দেইখা শব্দার্থ লেইখা রাখচো মনে হইতেছে; পইড়া তো কিছু্ই বুঝা যাইতেছেনা'। অনুবাদকের দীর্ঘদিনের নিষ্ঠা আর পরিশ্রমের কাজটি খুবই অবলীলায় একটিমাত্র বিশেষণে মূল্যায়িত হয়- 'ফালতু'। অনুবাদ বই এত বেশি পড়া হয় যে, আমিও অধিকাংশ সময়ই এইসব বিশেষণ জুড়ে দেয়াদেরই দলে, কারণ বাংলা ভাষার অনুবাদসাহিত্যের দশাকে হতশ্রী বললেও পুরো অর্থ প্রকাশ করা যাবেনা, আরও স্পেসিফিক করে বলতে হবে বিভৎস।

অনুবাদের এই দুর্দশা আসলে কেন? সম্ভবত অনুবাদ শব্দটিরই একটি যথার্থ অনুবাদ হওয়া প্রয়োজন সর্বাগ্রে। অনুবাদ বলতে যদি ভাষান্তর বোঝানো হয়, তাহলে বোধহয় অর্থটা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়, এবং 'ভাষান্তর' শব্দটিই যাবতীয় সমস্যার মূলে। কোন ভাষার একটি লেখা, সেটা যদি নেহায়েত চিনাবাদাম চিবানো নিয়েও লেখা হয়, সেই লেখাটিতেও অবচেতনভাবেও সেই ভাষাভাষি মানুষদের সংস্কৃতি, জীবনাচরণ, ভৌগলিক অবস্থান সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়। ভাষার সঙ্গে এই অপ্রত্যক্ষ বিষয়গুলোও বিষমভাবে জড়িত, তাই অনুবাদের সময় শুধুমাত্র ভাষাটা বদলে দিলে সেই লেখাটা ময়ূরের পেখম জড়ানো দাঁড়কাকের থেকে আলাদা কিছু হয়ে উঠতে পারেনা। আর শুধুমাত্র ভাষাও যদি ধরি, সেক্ষেত্রেও বক্তব্যের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।

ইংরেজি, স্প‌্যানিস, বা বাংলা যে ভাষাই বলিনা কেন, প্রত্যেকটি ভাষারই নিজস্ব ব্যাকরণ ও প্রয়োগবিধি রয়েছে। ইংলিশ মুভিতে যে শব্দগুলি খুব বেশি পরিমাণে ব্যবহৃত হয় f**k তার অন্যতম; সবসময় এটা গালি বা স্ল্যাঙ অর্থেও ব্যবহৃত হয়না, অনেকটা কথাপ্রসঙ্গেই বলা কথার মত একটা শব্দ। একইভাবে বাংলাতেও এমন ব্যবহৃত শব্দ আছে। অনুবাদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি বোধহয় সবসময় খেয়াল রাখা হয়নি। চেক প্রজাতন্ত্রের টমাসের কথা-বার্তা চেকভাষায় চেকঢঙেই হবে, কিন্তু তার কথাগুলো যদি সাহিত্যের প্রয়োজনে বাংলায় বদলে দিতে হয়, তবে তার কথার ঢঙটাও বাংলার মত হবে।

নইলে শুধু ভাষা বদলে দেয়াটা পণ্ডশ্রম হবে সর্বাংশে। অনুবাদ সাহিত্যের দৈন্যদশার আরও একটি কারণ বোধহয় সাহিত্য ও টেক্সট, এই দুটি বিষয়ের মধ্যকার সুস্পষ্ট পার্থক্যটা অনুবাদকের চোখ এড়িয়ে যায়। ধরে নিচ্ছি, ভাব-ভাষা দুটোরই একটা গ্রহণযোগ্য রূপান্তর সম্ভব হল, কিন্তু উপস্থাপনের দূর্বলতায় এই প্রয়াসটাও ব্যর্থ হয়ে যায়। একটি সাধারণ বাক্যও সাহিত্যাশ্রিত হলে তার চেহারা পাল্টে যায়, এবং গল্প-উপন্যাসে এই বাক্যের প্রাধান্যটা অস্বীকার করা অসম্ভব। সুতরাং অনুবাদককেও ভাব ও ভাষার মধ্যকার ঘনিষ্ঠতম সূত্রটা পেতে বাক্যগুলোতে কিছুটা অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে হবে।

সেটা সর্বক্ষেত্রে হযনা বলেই হয়ত জেমস জয়েস, ফ্রানজ কাফকার সাহিত্যকে বাংলায় পাঠ করতে গেলে আমাদের গলদঘর্ম দশা হয়। কাফকার ট্রায়াল এবং দ্য ক্যাসল পড়ার সেই অভিজ্ঞতা এখনো ভুলতে পারিনি, প্রায় ৫০ পৃষ্ঠা পড়ে ফেলার পরও বুঝতে পারছিলাম না ঘটনা কী হয়েছে, বা কিসের ভিত্তিতে কাহিনী গড়ে উঠেছে। প্রত্যেকটা লাইনকেই মনে হচ্ছিল আলাদা আলাদা গল্পের অংশবিশেষ। আর, টলস্টয়ের 'ওয়ার এন্ড পিসের' অনুবাদ তো এখনো শরীরে ভয় ধরিয়ে দেয়; অনেকবারের আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তার পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, অনুবাদক বিষয়বস্তুর বদলে লাইনকেই গুরুত্ব দিয়েছেন এক্ষেত্রে, তাই লাইন বাই লাইন নিখুত অনুবাদ করে কাঠামো দাঁড় করানোর পর একটি আদ্যোপান্ত ত্রুটিপূর্ণ শরীর আবিষ্কার করেছেন।

সেই তুলনায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অনুবাদ যথেষ্ট মানসম্পণ্ন, বিষয়বস্তুর যথেষ্ট গভীরে পৌছানো যায়। অন্যান্য বইগুলো কেন যে ওরকম হয়না, সে এক পরিতাপের বিষয় বটে। । । ................................................................................... ..................................................................................... বি:দ্র: চেক লেখক মিলান কুন্ডেরার একটা বই অনুবাদ শুরু করেছি বিধায় এ কয়দিন ইন্টারনেটে অনুবাদ বিষয়ক অনেক আর্টিকেল পড়তে হয়েছে বা এখনো হচ্ছে।

তারই প্রভাবে এই হঠাৎ মনে হওয়া লেখাটা "অপ্রাসঙ্গিক টাইপিং' বিভাগে লিখে ফেললাম।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.