আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সলিমুল্লাহ খান-এর অনুবাদে জন নিউসিঙ্গার-এর "ভগবান গ্রেস্টোক ও ঘুরঘুট্টি আফ্রিকা : টার্জান কেচ্ছার রাজনীতি"

স্বেচ্ছাচার না করা গেলে তারে স্বাধীনতা বলে না। স্বাধীনতা মানেই স্বেচ্ছাচারের অধিকার।

ভগবান গ্রেস্টোক ও ঘুরঘুট্টি আফ্রিকা : টার্জান কেচ্ছার রাজনীতি / জন নিউসিঙ্গার [গাঢ়] অনুবাদকের ভূমিকা [/গাঢ়] জনপ্রিয় টার্জান কাহিনী লেখক এডগার রাইস বারোস (1875-1949) পাঁড় বর্ণবাদী এবং শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী মার্কিন সাংবাদিক। সাম্রাজ্যবাদী সংস্কার, বিশেষ বলতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী সংস্কার, প্রচারে টার্জান গল্পমালা যে ভূমিকা পালন করে তা ছোট নয়। বর্তমান প্রবন্ধের মূল প্রস্তাব এই।

দুনিয়া জুড়ে টার্জান কেচ্ছার বই ও চলচ্চিত্র জনপ্রিয়। কিন্তু কেন? এ প্রশ্নের উত্তর-সন্ধানীর কর্তব্য তাই এ কাহিনীর বৈজ্ঞানিক বিচার। মনে হয় এ প্রবন্ধে সে কর্তব্য খানিক পালিত হয়েছে। প্রবন্ধের প্রথম প্রকাশ ইংরেজি 1986 সালে, লন্ডনে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক রেস অ্যান্ড ক্লাস পত্রিকার 18 বর্ষ 2 সংখ্যায়। ঐ সময় লেখক ইংলন্ডের লিচেস্টারশায়ার অঞ্চলের কোন এক কলেজে শিক্ষকতা করতেন।

লেখার শিরোনাম--'লর্ড গ্রেস্টোক অ্যান্ড ডার্কেস্ট আফ্রিকা: দি পলিটিক্স অফ টার্জান স্টোরিজ'--অক্ষরে অক্ষরে অনুবাদ করি তো দাঁড়ায় 'ভগবান গ্রেস্টোক ও ঘুরঘুট্টি আফ্রিকা : টার্জান কেচ্ছার রাজনীতি' বা কাছাকাছি কিছু। তবে গরিবের সুবিধা মনে করে তর্জমার নাম একবার রেখেছিলাম 'টারজান: বর্ণ ও উপনিবেশবাদের নয়া পুরাণ', আরবার 'ইংরেজ সভ্যতার অন্ধকার আফ্রিকা: বর্ণবাদ, পরদেশভোগদখলবাদ ও টার্জান পুরাণ'। লেখাটির তর্জমা করি খুব সম্ভব 1987-88 সালের দিকে। আহমদ ছফা সম্পাদিত সাপ্তাহিক উত্তরণ পত্রিকায় লেখাটি কিস্তিওয়ারি ছাপা হয়েছিল। তবে কোন কোন সংখ্যায় এখন মনে নাই।

হাতে কপিও নাই। সাদাত উল্লাহ খান সম্পাদিত প্রতিবুদ্ধিজীবী পত্রিকায় (ডিসেম্বর 1998) ছাপা হয় দ্বিতীয় পরিমার্জিত ভাষ্য। এই ভাষ্যই পরে 'টারজান: বর্ণ ও উপনিবেশবাদের নয়া পুরাণ' নামে যুগান্তর পত্রিকায় (21 ও 28 সেপ্টেম্বর 2001) প্রকাশ পায়। আজকের কাগজ পত্রিকায় (ঈদসংখ্যা, অক্টোবর 2006) ছাপা সর্বশেষ ভাষ্যের শিরোনাম ছিল 'ইংরেজ সভ্যতার অন্ধকার আফ্রিকা: বর্ণবাদ, পরদেশভোগদখলবাদ ও টার্জান পুরাণ'। বর্তমান পরিমার্জনা বলা যায় এ তর্জমার চতুর্থ সংস্করণ।

এই সংস্করণে ছোটখাট ভুলশোধন ছাড়াও নানান ব্যয়-পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে লেখা কোথাও খাট করা হয় নাই। উল্লেখ নিষপ্র্রয়োজন নয়, জায়গায় জায়গায় অনুচ্ছেদ বিভাজন এক-আধটা বাড়ানো হয়েছে। এক সময়--1990 দশকের গোড়ার দিকে--নিউ ইয়র্ক নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তঃপাতী স্টাটেন আইল্যান্ড কলেজে স্নাতক ও নিমস্নাতক শ্রেণীর পাঠ্য তালিকায় এই লেখাটি অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম। তখন আমি বেশ মজার মজার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করি।

আমার ছাত্রছাত্রীদের প্রায় সকলেই কোন না কোন টার্জান ছবি দেখেছেন। কিন্তু মাত্র কয়েকজন বাদে সকলেই বলেছেন টার্জানের বর্ণবাদী, পরদেশ ভোগদখলবাদী পরিচয়টা আগে তাদের জানা ছিল না। পশ্চিমা সভ্যতা ও বর্ণবাদ বিষয়ে নিউসিঙ্গার সাহেবের সিদ্ধান্তের কিছু প্রতিধ্বনি আমি শাদা ও কালো উভয় জাতির ছাত্রছাত্রীর আলোচনায় শুনেছি। বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরাও আশা করি এই নিবন্ধে কিছু ভাববার খোরাক পাবেন। এই অভাবের বাজারে আমরা অতি অল্প প্রচার করতে সমর্থ হয়েছি।

এই লেখা পুনঃপ্রকাশে কেউ আগ্রহী হলে আমরা বাধিত হব। - সলিমুল্লাহ খান --- [গাঢ়] 1 \ নরবানরের প্রবেশ [/গাঢ়] 'অত্র বাটির মালিক টার্জান। টার্জান পশু ও কৃষ্ণাঙ্গ হত্যায় অভিজ্ঞ। টার্জানের মালপত্রের অনিষ্ট করিবেক না। টার্জানের নজর পলকহীন।

' জংলি আফ্রিকার উপকূলে আপাতপরিত্যক্ত এক কেবিনের সামনে এই নোটিশ দেখতে পান হতভাগ্য অধ্যাপক আর্কিমিডিস পোর্টার, পোর্টার-তনয়া জেন আর ওঁদের সফরসঙ্গী জাহাজডুবা হতভাগার দল। নরবানরের অস্তিত্ব্ব এভাবেই প্রথম শাদা নারীপুরুষের গোচরে আনা হয় (বারোস 1912: 103)। প্রায় বিনা আয়াসেই টার্জান এই জাহাজডুবা হতভাগাদের জঙ্গলের ত্রাস থেকে বাঁচায়, বারবার। ইংরেজ অভিজাত পুরুষ উইলিয়াম সিসিল ক্লেটনকে একবার সিংহের কব্জা থেকে ছিনিয়ে গাছগাছালির ফাঁকফোকর যোগে কেবিনের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসে সে। যে রকম স্বাচ্ছন্দ্য ও দৃপ্তির সঙ্গে তিনি নিজে প্রকাশ্য দিবালোকে লন্ডনের রাজপথে পা চালাবেন, জংলি রাতের কালিমাখা অন্ধকারে এই নরবানরের সে রকমই স্বচ্ছন্দ, সে রকমই দৃপ্ত পা চালনা দেখে ভদ্রলোকের শুদ্ধ বিস্ময়ে অভিভূত হবার পালা।

জঙ্গলের কিছুতেই টার্জানের ভয় করে না। জঙ্গলের সে পরোয়ারদেগার, জঙ্গল তার খাসমহাল। তার এ জয় যন্ত্রের জোরে, বন্দুক কি বুলডোজারের দৌলতে নয়--এ জয় মানুষের বিস্মৃত অতীত আর জংলি ঔরসের ওপর বংশগতির ও বীর্যগৌরবের। আপন অন্তরের অন্ধকার আদি 'আমি' আফ্রিকার জঙ্গলমূর্তি ধরে শাদা চামড়ার সামনাসামনি দাঁড়ায়; এ আমির সামনে সে বোধ করে পরাস্ত, বিপন্ন। অন্তরের দমিত যে ভয়কে শাদা চামড়া ঐ মহাদেশের বেমালুম বিশাল অরণ্যের মানুষ ও পশুর মূর্তি দান করে অন্ধকার আফ্রিকা সেই ভয়েরই চণ্ড রূপান্তর।

তারপরও টার্জান এই কাফ্রি অন্ধকারের হৃৎপিণ্ড ভেদ করে, আপাদমস্তক কব্জা করে তার জংলি রহস্য। টার্জানমালার লাগাতার সাফল্যের, গণপুরাণ আকারে এ মালার টিকে যাওয়ার পেছনে এই অভয়মন্ত্রের ভূমিকা গুরুতর। মার্কিন বটতলার ঔপন্যাসিক চরম ডানপন্থী এডগার বারোস টার্জানমালার একনম্বর গ্রন্থ--নরবানরকুলের টার্জান--লেখা শুরু করেন 1911 সালের ডিসেম্বর মাসে। লেখা শেষ হয় পরবছর মে মাসে। লেখকের উদ্দেশ্য 'যাকে বলে কল্পনা-প্রতিভা সেই মানস পরীক্ষাগারে কৌতূহলী নিরীক্ষা চালানো': জনৈক ইংরেজ লর্ডসন্তানের, নবজাত শিশুর, 'মানস, নৈতিক ও দৈহিক বিকাশে বংশগতি, পরিবেশ, প্রতিপালনের তুলনামূলক মূল্য তলিয়ে দেখা' (পর্জেস 1976: 133, 135)।

এক নম্বরের পিছপিছ কুড়িটিরও বেশি বই লেখা হয় এই গ্রন্থমালায়। সর্বশেষ গ্রন্থের রচনাসাল 1944। অবিসম্বাদিত প্রতিষ্ঠা এই গণপাঠ্য ছহি বড় কাহিনীর। এখনো এ গ্রন্থমালার সকল গ্রন্থই সস্তা পেপারব্যাক সংস্করণে পাওয়া যায়। সাহিত্যগুণে মহৎ না হয় না হোক, এসব লেখার কিন্তু গুরুতর বিচার হওয়া উচিত।

কারণ দারুণ সফল এই অভিযান কাহিনী। দু'নম্বর কথা, এ যুগের মহাপুরাণ জঙ্গলরাজ 'নরবানরকুলের টার্জান' এ কেচ্ছারই উপহার। টার্জান পুরাণ উপনিবেশবাদের পুরাণ। এয়ুরোপীয় সাম্রাজ্যের তেজকটাল জমানায় শাদা চামড়ার সঙ্গে আফ্রিকা মহাদেশের সম্পর্কই এর মূল মাল। এই গ্রন্থমালায় পাওয়া যায় আফ্রিকায় উপনিবেশ বিস্তারের গণ-আবেদনময় ধারাবর্ণনা।

এই মালার এক নম্বর গল্পটি লেখার সময়ও আফ্রিকায় বিখ্যাত এয়ুরোপীয় লুটোপুটি খেলার স্মৃতি অমলিন। ঐ মহাদেশের বিস্তর এলাকায় তখনো শাদা পায়ের চিহ্ন পড়ে নাই। বেশি দিন আগের কথা নয়, কঙ্গোয় বেলজিয়ামের সীমাহীন নির্যাতনের বিরুদ্ধে দুনিয়াজোড়া প্রতিবাদ হয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে বেলজি বদমায়েশির কথা খোদ বারোসও তুলেছেন--এ কথা সত্য। গ্রন্থমালার শেষ গল্পের সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে, জার্মান ও জাপানিদের হাতে মুরুবি্ব পরদেশ ভোগদখলবাদী সাম্রাজ্যগোষ্ঠী আচ্ছা মার খাচ্ছে।

শেষ গল্প নাগাদ সুমাত্রায় জাপানি সৈন্যের বিরুদ্ধে টার্জানকে যুদ্ধে নামানো হয়েছে। সব মিলিয়ে দেখলে এই চক্রে আছে বিস্তর মজার জিনিস। আপাতত এই পুরাণের বিসমিল্লাহ নরবানরকুলের টার্জান দিয়েই শুরু করা যাক। গল্পের শুরু জনৈক পরদেশ ভোগদখলবাদী ব্রিটিশ কর্মকর্তা লর্ড গ্রেস্টোকের সূত্র ধরে। পশ্চিম আফ্রিকার কোন এক ব্রিটিশ উপনিবেশে কালো আদমি গোষ্ঠীর ওপর জুলুমের অভিযোগ তদন্ত উপলক্ষে তিনি মফস্বল সফর করছিলেন।

সমুদ্রে থাকতেই তাঁর জাহাজে বিদ্রোহ দেখা দেয়। তরুণী ভার্যাসহ গ্রেস্টোক আফ্রিকার উপকূলে জলবন্দী হয়ে পড়েন। মা বাবা দুজনেই প্রাণ হারালে কালা নামের একজন নারীবানরের আদরে বড় হতে থাকে ওঁদের অনাথ শিশু। শিশুর টার্জান নাম নরবানরদেরই দেয়া, মানে 'শাদা চামড়া'। শিশু বড় হয় নরবানরকুলেরই আপন, কেরচাক গোত্রের শাবক, হিসাবে।

সব মিলিয়ে তাতে আর জঙ্গলের আর আর জানোয়ারে কোন ভেদ নাই। তবু কিভাবে জানি জংলি লালনের ছাপ কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত সে অনেকটা আদিম অথচ লক্ষণে-সক্ষণে ইংরেজ ভদ্রলোকরূপে আত্মপ্রকাশ করে। পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে টার্জান। কারণ--বারোসের মতে--তার মনুষ্য জন্ম নয় বরং শিরায় বহমান রক্ত, পূর্বপুরুষের চারিয়ে দেয়া ইংরেজ আভিজাত্যের ঐতিহ্য। যখন বালকমাত্র তখনই সে গোত্রের আর সকলের অধিপতি হয়ে ওঠে (স্ট্রিট 1975: 108_109)।

আব্বাজির পরিত্যক্ত কেবিন খুঁজে পাবার পর ওখানে জমা বইয়ের সাহায্যে নিজে নিজেই ইংরেজি পড়তে লিখতে শেখে টার্জান। নরবানরের ভাষাই ওর মুখের বুলি--এ কথা হিসাবে ধরলে কাজটা (অসম্ভব যদি নাও বলি) অসাধ্যসাধনই বলতে হয়। ওকে কিছু পরিমাণ 'অজ্ঞানের অন্ধকার রাতে পথ হাতড়ে জ্ঞানের আলোকবর্তিকার দিকে আগপা আদিম মানবের রূপক' ধরে জংলি পরিবেশ ও পাশবিক লালনের ওপর বংশগতির বিজয়নিশান মনে করেই ওর বয়ান করেছেন বারোস। একটা উদাহরণ: যখন সে নরবানরকুল থেকে আলাদা হয় নাই--যখন সে 'আধুনিক ধর্ম ও রাষ্ট্রের সকল আচার অনুষ্ঠানের নিঃসন্দেহ উৎস' প্রলয়ঙ্কর, উদ্দাম, মাতাল, দমদম নৃত্যে মশগুল-সেই সময়ই তার মজ্জার ভেতরের খাঁটি ইংরেজিয়ানা মাথাচাড়া দিতে শুরু করে (বারোস 1912: 48, 52)। বংশগতি ও পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ আর জাতীয় অধঃপতনের ভয়--পীড়া শুধু টার্জানমালায় নয়, বারোসের সকল লেখাতেই হাজির।

[গাঢ়] 2 \ নরখাদক ও অন্যান্য [/গাঢ়] কালো আদমির সঙ্গে টার্জানের পয়লা মোলাকাত নরবানরকুলের টার্জান বইটির সিকিভাগ মত এগুনোর পর। তখন নৃশংস বেলজি শোষণের হাত এড়িয়ে বাঁচবার আশায় একটি গোত্র তার খাসমহালে ঠাঁই নেয়। বারোস এদের মাপলেন টার্জানের মাপে, কাঁটায় কাঁটায়: জনাপঞ্চাশ কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধা সামনে এগুচ্ছে, হাতে তাদের সরু সরু কাঠের বল্লম--মাথা অল্প আগুনে অনেকক্ষণ পোড়ানো, শক্ত--সাথে লম্বা ধনুক, বিষমাখা তীর। ডিম্বাকার ঢাল পিঠে, নাকে বিশাল বিশাল নোলক। ওদের মাথার দড়িপাকা পশম ফুঁড়ে বেরুচ্ছে রঙ বেরঙের পালকের গোছা।

কপাল জুড়ে তিনটে করে সমান্তরাল রঙিলা রেখা আর এক একটা দুধের চারপাশে তিন তিনটা কেন্দ্রমুখী বৃত্তের উল্কি। দাঁতের পাটি হলদে, থরে থরে সাজানো, একেবারে আগায় সূঁচালো। ওদের চেহারা এমনিতেই নিচু, পাশব ও জঘন্য--সামনে ঝুলে থাকা বড় বড় ঠোঁট সে চেহারা আরো জঘন্য করেছে। ওদের হাতে পড়ার দুর্ভাগ্য যাদের হয়, সেই বন্দীদের খেয়ে ফেলার আগে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি হিসাবে আগাপাস্তলা পেটানো এদের রীতি। টার্জানের মতে, এদের এ ধরনের বন্যতা বন্য পশুর বন্যতাকেও হার মানায়।

এইসব মানবপশুর সাক্ষাৎ টার্জানকে দেখানো হয়েছে 'মহাপ্রাণ আদিম মানুষের' আদলে, শিকারি ও যোদ্ধার ভূমিকায়। ঐ দুখানি চওড়া কাঁধের ওপর মনোহর মাথার অভিজাত ঠাট আর ঐ দুটি সুশ্রী, স্বচ্ছ চোখে জীবন ও বুদ্ধির আগুন নিয়ে সে সহজেই তার পুরানো বনের বিগত যেকোন যুদ্ধবাজ জনগোষ্ঠীর কুলদেবতা গণ্য হতে পারে (বারোস 1912: 64, 97)। দেখানো হয়েছে, জংলি পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণে এনেছে টার্জান--এক জাতীয় দেবদ্বিজের মত পরিবেশের ঊধের্্ব উঠেছে সে। অথচ এই একই পরিবেশের কাছে হার মেনেছে কালোরা, পরিণত হয়েছে তারই অংশে। টার্জানের ভয়ে কালোদের অন্তরাত্মাসুদ্ধ কেঁপে ওঠে।

শিকারসন্ধানী এক কালো আদমি একদিন 'কালা'কে হত্যা করে বসে। আর জঙ্গলে তার পিছু নেয় টার্জান। শেষ পর্যন্ত সে প্রথমে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে, তারপর কলিজা বরাবর ছোরা ঢুকিয়ে লোকটিকে হত্যা করে। লাশের গোশত খেতে উদ্যত টার্জান কি যেন ভেবে থমকে দাঁড়ায়: এক ঝলকে বিবমিষা তাকে ছেয়ে ফেলে ...। এই কালো আদমটির গোশত খেতে মানা--ওর জানার মধ্যে পুঁজি এটুকুই।

বহুযুগের ওপার থেকে আসা বংশগতির সহজাত প্রবৃত্তি এভাবেই অদীক্ষিত মনের জায়গা নেয়। ওর অজানা এক জগজ্জোড়া নীতি লঙ্ঘনের দায় থেকে তাকে রক্ষা করে (বারোস 1912: 72)। গ্রেস্টোক বংশের চোদ্দপুরুষের রক্তই ওকে নরমাংস ভক্ষণের হাত থেকে বাঁচায়, রক্ষা করে কাফ্রি অন্ধকারের কাছে হার মানা থেকে, তার অতলে হারিয়ে যাওয়া থেকে। টার্জানের মনুষ্যস্বভাব যে কৃষ্ণাঙ্গ মনুষ্যস্বভাব নয়, তা এভাবেই দেখানো হয়। ওদের মনুষ্যত্ব একটু নিচু পর্যায়ের।

ওরা আফ্রিকার অন্ধকারের অংশ, উঠে দাঁড়াতে অসমর্থ, নিজেদের পায়ে নিজেরা দাঁড়িয়ে তো নয়ই। জেন পোর্টারের কাজের মেয়ে এসমারেন্দা। বারোস ওকে খাড়া করেছেন গৎবাঁধা কৌতুক চরিত্র 'কালি'রূপে। শাদা সভ্যতার আশীর্বাদ যে কালোদের একটু তেলেঝোলে চাঙ্গা রেখেছে, বড় হবার আশা তারাও বা কতটা করতে পারে--সে সীমা এখানেই। মনিবের পায়রবিতে তুলনা নাই এই দাসীর।

কিন্তু নিজের থেকে খড়টি ছিঁড়ে দু'টুকরা করবে এটুকু আক্কেলও নাই। দুনিয়ার তাবৎ বিষয়েই মনিবভরসা এই বেটি। টার্জানের চোখে একজাতীয় গৃহপালিত পশু--পোষা কৃষ্ণাঙ্গ আর কি! নরবানরকুলের টার্জান শাদা চামড়ার হাতে আফ্রিকার বন্যদশা, আদি বনভূমি ও তার বাসিন্দা বিজয়েরই পাক্কা কাহিনী। জঙ্গল থেকে নিজ নিজ পথ নিজেরা কেটে বেরুচ্ছে, অন্য কারো সহায়তার মুখাপেক্ষী না হয়ে কেবল আপন চেষ্টায় চরম প্রতিকূলতার মুখেও একদল নারীপুরুষ আপন সমাজ গড়তে, বাঁচিয়ে রাখতে তৎপর--এমন জনগোষ্ঠী হিসাবে কালো মানুষের ছবি আঁকা হয় নাই। সে দিলি্ল দূর অস্ত! প্রকৃত প্রস্তাবে, আর দশ বন্যপ্রাণীর শামিল, বনের পশুপাখিই ধরে নেয়া হয়েছে তাদের।

তামামশোধের আগে এ গল্পে দেখানো হয়--ফরাসিদের প্রতিহিংসাপরায়ণ হামলায় গোত্রের সকল পুরুষ মানুষ আক্ষরিক অর্থে নিশ্চিহ্ন--যেসব নারী ও শিশুর প্রাণ রক্ষা পায় তাদের দেখা দেয় জীবিকা সংশয়। এরপর ওদের কপালে কি জুটবে সে নিয়ে লেখকের চিন্তার বালাই নাই। বারোসের পরদেশ ভোগদখলবাদী কল্পনায় ওদের জায়গা কোনখানে বুঝতে এই যথেষ্ট। 1916 ও 1917 সালে লেখা টার্জানের জঙ্গল জীবনের গল্প সংকলনে বারোস ফিরে যান টার্জানের জংলি শৈশবে। বন্যদশা থেকে নরবানরের অভু্যদয় কাহিনী এসব গল্পে তিনি আরো বাড়িয়ে, আরো বিশদ, খুঁটিনাটিসহ বলেন।

টার্জান মনুষ্যসন্তান এবং ওর মনুষ্যস্বভাব কৃষ্ণাঙ্গ মনুষ্যস্বভাবের মতন নয়, অন্যরকম। এই কথাটুকু মালুম করাবার প্রধান উপায় টার্জানের পিশাচসুলভ কৃষ্ণাঙ্গ পীড়ন--এই বইতে লেখক তা আরো খোলামেলা দেখিয়েছেন। কালোরা একবার এক নরবানর ধরে খাঁচাবন্দী করে। কালো চৌকিদার হত্যা করে নরবানর খালাস করে টার্জান। অদমিত কামনায় টইটম্বুর এক অনুচ্ছেদে এই খুনের বয়ান খুঁটিয়ে দেয়া আছে: টার্জান এক লাফে লোকটার পিঠে চড়ে বসে।

তার গলা পেঁচিয়ে ধরে ইস্পাতের আঙুল। ভয়ার্ত লোকটির ঠোঁট পর্যন্ত বেরিয়ে আসা চিৎকার স্তব্ধ করে দেয়। স্কন্ধে দেবে যায় প্রবল দাঁতের পাটি। প্রচণ্ড দু'পা দু'দিক থেকে কবন্ধ চেপে ধরে। ভয়ে আপ্লুত কৃষ্ণাঙ্গ আঁকড়ে ধরা নিঃশব্দ জিনিসটি সরাতে চেষ্টা করল।

মাটিতে আছাড় খেল, গড়াগড়ি দিল। তবু আরো চেপে এল, আরো দৃঢ় হল সেই প্রবল আঙুলের মরণমুঠো। আরো বড় হল লোকটার হা। ফোলা জিভ লাফিয়ে বেরুল। কোটর ফেটে ঠিকরে বেরুল চোখজোড়া।

অক্লান্ত অঙ্গুলিটার চাপ তখনো কিন্তু বেড়েই চলেছে। লাশ ঢুকিয়ে খাঁচা বন্ধ করে টার্জান। তারপর স্মিত হাসে। কৃষ্ণাঙ্গ মেরে টোপ বানাতে ওর বড় ভাল লাগে। মানস আধিশাস্ত্র বিচারে কী অর্থ এই হত্যাকাণ্ডের? টার্জানের জঙ্গল জীবনের গল্প বইটির বেশির ভাগই পড়তে পড়তে মনে হয় যেন কোন দারুণ ব্যাধিগ্রস্ত মনোরোগীর রোগনামচা--কোন তাড়না বারোসকে তাড়িয়ে চলেছে তা বিশেষ উপরের দৃষ্টান্তে ভয়ানক পরিষ্কার হয়ে ওঠে।

প্রাণের ভেতর একটা কিছু তিনি অনুভব করছেন যা দমন করা চাই--তিনি জানেন তাঁর মনের ভেতর এমন এক অন্ধকার যা ঝাড়া দরকার। কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের, মানে আপন অন্তরেরই অন্ধকারের কালো 'আমি'র, এই প্রায় কামোন্মাদ হত্যাকাণ্ড সাফ সাফ সেই চেষ্টাই। লেখায় বেরিয়ে আসে ভেতরের এই সংঘাত। আপন মনের বিকার তিনি চাপিয়ে দেন কালোদের ওপর। তাঁর কালোর বসবাস এখনো জঙ্গলে--শাদার অবিজিত জঙ্গলে।

সহজে ওদের পিছু ছাড়ছেন না উনি। আরেক ঘটনা। গাছে চড়ে কালো পাড়ায় গোয়েন্দাগিরি করছে টার্জান। দেখতে পায়, ব্যাটারা হাতির গোশত আর তাড়ির ভোজ দিয়েছে। ঘেন্নায় বিতৃষ্ণায় মন ফোঁস করে ওঠে ওর।

স্থির করে, হামলা চালাবে ওই গাঁয়ে। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। জেগে ছিল এক বুড়া। তাই লোকটাকে খুন করল সে। আবারো গলা পেঁচিয়ে ধরে ইস্পাতের আঙুল।

সংগ্রাম অবশ্য এবার ছোটখাটই--লোকটা একে তো বুড়া-হাবড়া, তয় আবার অতিভোজ অতিপানে আদ্ধেক সম্বিতহারা ততক্ষণে। ঠাট্টা করে লাশটা পাকের ডেগচিতে দেবে দিয়ে দেঁতো হাসে টার্জান। ধর্ষকাম আরেক ধাপ এগিয়ে নেয়া হয় আরেক গল্পে। গল্পের নাম সত্য সত্যই জঙ্গলের ঠাট্টা। সিংহ ধরার ফাঁদে যেখানে টোপ বেঁধে রাখা হয় সেখানে গাঁয়ের এক ওঝা ধরে বেঁধে দেয় টার্জান: ওঝা প্রথমে প্রাণ ভিক্ষা চাইল, পরে যাচ্ঞা করল কিছু কম নিষ্ঠুর মৃতু্য ...।

ওর অবিরাম বকবকানি নিঃশব্দে কর্মরত টার্জানকে বিরক্ত তো করলই, মনেও করিয়ে দিল ব্যাটা পরে 'বাঁচাও, বাঁচাও' চিক্কুরও পাড়বে। তাই সে খাঁচার বাইরে এসে এক মুঠা ঘাস আর এক টুকরা লাঠি জোগাড় করল। তারপর রাব্বা কেগার মুখে ঘাসটুকু পুরে, দু'পাটি দাঁতের ফাঁকে লাঠি গুঁজে কোমরের কাপড়ের দড়ির সাথে শক্ত করে বাঁধল। এখন ভাল করে চোখ উল্টিয়ে ঘামতে পারবেন ওঝামশাই। যথাসময় জ্যান্ত খাওয়া হল তাকে।

দোষী সিংহটাকে পরে কালোরা বড্ড মারধর করে। ওদের বলগাহীন নিষ্ঠুরতায় টার্জান বড় বিরক্ত: যে যন্ত্রণা দেয়ার কোন প্রয়োজন নাই সে যন্ত্রণা দেখে ওর মনে যে বিতৃষ্ণার ভাব জাগল তার উৎস--জানলে সে মনে হয় বলত--রক্তধারায়, তার রক্তে, আব্বা-আম্মার রেখে যাওয়া ব্রিটিশ ন্যায়প্রীতির বীজে (বারোস 1916-17: 22, 131, 166, 169)। যতখানি প্রাপ্য তার চেয়েও বেশি ভক্ত জুটেছে বারোসের। তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত বর্ণবাদের অভিযোগ খণ্ডনের বা লাঘবের চেষ্টা করেছেন এই ভক্তরা। যেমন রিচার্ড লুপফ সাফাই গেয়েছেন: 'তাঁর লেখায় বর্ণবাদী ভাষার দেখা সহজেই মেলে।

এ কথা অসত্য নয়। আবার একই সাথে বর্ণবাদবিরোধী ভাষার দেখাও সমানেই মেলে। ' এ দাবিতে কিছুটা সত্য আছে, তবে কোন ভাষার প্রাধান্য একচেটিয়া তাও সন্দেহাতীত স্পষ্ট। বারোসের জমানায় গৎবাঁধা (টাইপ) চরিত্রচিত্রণই ছিল যুগের দাবি--শেষ পর্যন্ত এই যুক্তির আশ্রয় নিতে বাধ্য হন তিনি। মামলা নিছক বর্ণবাদী বাঁধাবুলির নয়, টার্জানমালার অনেক গল্পের বহির্বয়ান ও উপর্যুপরি হত্যামূলক পুলকপ্রবাহের তলে তলে বহমান প্রচণ্ড, জবরদস্ত বর্ণবাদী ভাষারও (লুপফ 1968: 189_190)।

টার্জান গল্পগুচ্ছে টার্জান যাদের গোত্রপতি হয়ে বসে সেই গোত্রের নাম ওয়াজিরি। এমন কিছু তারিফযোগ্য কালো চরিত্রও তৈরি করেছেন বারোস, এ তথ্য দাখিল করেন লুপফ। তাও এমনভাবে করা, যাতে বর্ণবাদী মূল ভাবধারাটি আরো পোক্ত হয়। ওয়াজিরিদের সঙ্গে টার্জানের প্রথম সাক্ষাতের সময় তাদের দেহগঠনের ভারসাম্যে এবং শারীরিক বৈশিষ্ট্যের স্বাভাবিকতায় সে মুগ্ধ হয়-গড়পড়তা পশ্চিমা বন্যদের মত থ্যাবড়া নাক আর ভারী ঠোঁটের কোন আলামতই নাই এদের। এমনকি ওদের মেয়েরাও প্রায়শ আকর্ষণীয় (বারোস 1913: 126)।

টার্জানের অন্যতম দুশমন এস্তেবান মিরান্দা। তার চোখে 'বিবর্তনের সিঁড়িতে নরবানরদের চাইতে পশ্চিম পাড়ের কালোরা যতখানি উপরে', ওয়াজিরি গোষ্ঠী 'কালোদের চাইতে ততখানি উপরে' (বারোস 1922-23: 84)। বলা হচ্ছে ওয়াজিরিরা বুদ্ধিদীপ্ত, বিশ্বাসযোগ্য এবং সাহসী। সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য এ কথাও স্পষ্ট করা আছে-তবুও ওরা শাদার অধীন। প্রকৃত প্রস্তাবে বারোসের কাছে তারা যেটুকু মর্যাদাও বা পাচ্ছে তার কারণও এই যে ওরা স্বেচ্ছায় শাদার শ্রেষ্ঠতা এবং শাদার শাসন মেনে নিয়েছে।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক--টার্জানকে সম্রাট কি দেবতা মান্য করা ওদের অভ্যাস। হাঁটুতে ভর দিয়ে ওর সামনে গেল তারা। যারা সবচেয়ে কাছে ছিল তারা ভক্তিভরে ওর হাত পা ছুঁল (বারোস 1931: 173)। টার্জান গল্পগুচ্ছে বারোস কালো মানুষের ছবি যেভাবে আঁকেন তা থেকে উষ্ণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ জনগণ সম্পর্কে যতটা না জানা যায় তার ঢের বেশি জানা যায় খোদ বারোস সম্পর্কে এবং যে সংস্কৃতির মধ্যে তিনি বসবাস করেন সেই সংস্কৃতি সম্পর্কে--এ জিনিসটা স্পষ্ট। অপরাপর জাতি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানাবার মত কিছুই নাই পরদেশ ভোগদখলবাদী সাহিত্যের।

হিউ রিডলি বলেন: 'ইহুদি সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে ইহুদিদ্বেষী সাহিত্যের মূল্য যতটা, তৃতীয় বিশ্ব বিষয়ে জানতে পরদেশ ভোগদখলবাদী সাহিত্যের মূল্য তার বেশি নয়' (রিডলি 1983: 2_3)। [গাঢ়] 3 \ বিলুপ্ত সভ্যতা [/গাঢ়] বহুদিন আগে আফ্রিকার অন্ধকার পেটে হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন সভ্যতার ভাগ্য নিয়ে বারোস যা লিখেছেন তাতে জাতীয় অধঃপতনের বিপদ নিয়ে তাঁর অশান্তির খবর পাওয়া যায়। এর মধ্যে আছে বিলুপ্ত আটলান্টিস, ফেরায়ুনী মিশর, প্রাচীন রোম, প্রথম রিচার্ডের ক্রুসেড, ষোল শতকের পতর্ুগীজ সাম্রাজ্য এবং আরো অনেক লোমহর্ষক সভ্যতার উপনিবেশ। এসব গল্পের কোন কোনটিতে তিনি সফল ফমর্ুলার প্রাণহীন পুনরাবৃত্তি করেছেন। কোনটি আবার বেশ আবেগ আর চিন্তার জোরে লেখা।

এর মধ্যে সবচেয়ে ভাল আঁকা আটলান্টিসের শেষ উপনিবেশ, শোচনীয় ধ্বংসের শিকার 'ওপার' শহরের ছবি। টার্জান বারবার শহরটি দেখতে যায়। এই শহরে এক অভিযাত্রায় টার্জানকে জনাবিশেক গরিলামতন শাদা লোক গ্রেফতার করে সূর্যদেবের কাছে বলি দিতে উদ্যত হয়। অভিজাত পুরোহিত, সুন্দরী 'লা'র হস্তক্ষেপেই মাত্র তাঁর প্রাণ বাঁচে। এই লা-ই তাঁর কাছে পশু-মানুষের উদ্ভব আখ্যান বয়ান করে।

লা'র মতে এরা প্রাচীন আটলান্টিস জাতিরই পতিত বংশধর, পুরুষের পর পুরুষ ধরে বন্যদশায় গিয়ে কদাকার বন্যপশুর চেহারা পেয়েছে। কেউ কেউ আবার নরবানরদের সাথে মিলন করে। 'বহুযুগ আগে যে পশুর মধ্য থেকে আমাদের পূর্বপুরুষদের সম্ভাব্য উৎপত্তি খোদ সেই পশুর' পর্যায়ে গোটা জাতটার ফিরে যাওয়া নেহাত সময়ের ব্যাপার। আজতক এ পতনের গ্রাস থেকে বাঁচতে পেরেছে মেয়েরা শুধু। এখনো সুন্দর ওরা, এখনো বুদ্ধিদীপ্ত।

ওদের পতনও তবে একরকম নিশ্চিত (বারোস 1913: 173)। জাতিগত অধোগতির সবচেয়ে ভারি নাটুকে বয়ান এই জায়গায়। গর্বোদ্ধত কোন এক শাদা জাতি হাজার বছর ধরে আফ্রিকার অন্ধকারের কাছে আপাদমস্তক নতিস্বীকার করেছে, ফলে ভোগ করেছে এর ভয়াবহ যত পরিণতি। আফ্রিকা মহাদেশের এফোঁড়-ওফোঁড় সফরকালে টার্জান যত সভ্যতার দেখা পায় তার একটিও কালো নয়--তথ্যটি গুরুত্বপূর্ণ। বারোস যখন লিখছিলেন ততদিনে জিম্বাবের ধ্বংসাবশেষের কথা সবার জানা।

কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা সৃষ্টি করতে পারে--তবুও এ কথা বিশ্বাস করা বারোসের পক্ষে সম্ভব হয় নাই। বাস্তবিক এক গল্পে তিনি টার্জানকে এমন এক দেশে নিয়ে আসেন যেখানে কৃষ্ণাঙ্গ জাতির শাসক কোন এক গরিলা গোত্র। দাসপ্রথার জিঞ্জির থেকে খালাস করে তাদের ওপর একজন শাদা রাজা বসিয়ে দেয় টার্জান (বারোস 1922-23)। বারোস বর্ণিত বিলুপ্ত সভ্যতার ফিরিস্তির অন্দরে সবচেয়ে জঘন্য কাগি সভ্যতা। কৃষ্ণাঙ্গ মর্দানারীর এই জাতি কয়েক বংশ ধরে নিজেদের চুটিয়ে শাদা বানাবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

সফল হচ্ছে। বন্দীদের মধ্যে বেছে বেছে শুধু শাদা পুরুষদের সঙ্গেই মিলিত হয় এরা। আর ছেলেমেয়ে কালো হলেই মেরে ফেলে। নোংরা বর্ণবাদী লিঙ্গপন্থী এই ফ্যান্টাসির চরিত্র স্ট্যানলি উড কোন এক মর্দানারীর প্রেমে পড়ে। বন্দীদের একজন তার প্রেমিকাকে 'নিগ্রো মাগি' বলে গাল পেড়েছে।

তাই সে বন্দী ধরে পেটায়। অথচ একটু পরই টার্জানের কানে কানে বলে সে--'যতই ভালবাসি, মাগির গায়ের রক্ত তবুও নিগ্রো'--'ওদের সবার রক্তই'। সবকিছু শেষতক ভালয় ভালয় শেষ হয়। জানা যায়, এ 'মাগি' আর কেউ নয়, খোদ ভগবান (লর্ড) ও ভগবতী (লেডি) মাউন্টফোর্ডের বহুদিন আগে হারানো কন্যা। (বারোস 1936-37: 74)।

শাদা তো শাদাই। তায় বাড়তি, তোফা উচ্চবংশেরও! [গাঢ়] 4 \ সাম্রাজ্যের বূ্যহে [/গাঢ়] ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিবিধ চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় টার্জানও নিজ কর্তব্য পালনে এগিয়ে গেছে: সর্বাগ্রে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান চ্যালেঞ্জের সামনে, তারপর দুই যুদ্ধের মাঝখানে কমিউনিস্ট গোয়েন্দাদের বিরুদ্ধে আর সর্বশেষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানিদের মোকাবিলায়। আন্তর্জাতিক রাজনীতিওয়ারি নিজ মনগড়া ভাষ্য প্রচারের বাহনস্বরূপ টার্জান কেচ্ছা বলার লোভ দমন করতে পারেন নাই বারোস। ভয়পীড়াজাত ঘৃণার সঘন প্রচার আর পশ্চিমা সভ্যতার সম্মুখে উদ্ভূত বিপদবিরোধী চেতাবনী তাঁর এই কেচ্ছাকাহিনী। 1949 সালের ডিসেম্বর মাসে ওঁর তিরোধান না ঘটলে আমাদের হয়তো দেখতে হত টার্জান কেমন প্রাণমনদেহে জড়িয়ে পড়েছে ঠাণ্ডাযুদ্ধে, মাউমাউদের বিরুদ্ধে লড়ছে কেনিয়ার অরণ্যে, ভিয়েতনামের ধানক্ষেতে ভিয়েতকঙের মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছে আর সান্দিনিস্তার মোকাবিলায় লড়ছে নিকারাগুয়ার বনে ও জঙ্গলে।

টার্জান প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল তখনই, যখন জার্মান সেনাবাহিনীর এক শাখা পূর্ব আফ্রিকায় ওর খামারবাড়ি ধ্বংস এবং ওর কালো কামলাদের পাইকারি নিধন করে আর (তার সে সময়ের ধারণা অনুযায়ী) খুন করে জেনকে। এভাবে 'সে সময়'--1914 সালের শরৎকালে--'জার্মান সভ্যতার গৌরবোজ্জ্বল আলো যেভাবে বেলজিয়ামের ওপর পড়েছে রাতের অন্ধকারে ... এমনকি ঘুরঘুট্টি অন্ধকার আফ্রিকাতেও সেই আলোর প্রতিফলন শুরু হয়েছে তেমনি'। খুন কা বদলা খুনের কসম খায় টার্জান। দুনিয়ার যত বস্তু জার্মান সবটার ওপর নরবানরের ঘৃণা। এই ঘৃণার এশতেহার লেখায় প্রতিভার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন বারোস: ওর বিশাল দুঃখের যন্ত্রণা আরেক আবেগের জন্ম দেয়।

ধীরে ধীরে সে আবেগ এমনই খাঁটি, এমনই আস্ত যে মনে হত সঙ্গীর মত পাশে পাশে হাঁটছে। ঐ আবেগের নাম ঘৃণা--জার্মানি ও জার্মান, জীবিত কি মৃত, সব কিছুকেই ঘৃণা। সে আবেগ তাঁর মনে অনেকখানি স্বস্তি ও শান্তি নিয়ে এল। কারণ এতে তার মন উন্নত হল। তখন থেকে এমনটা হয়েছে আরো হাজার হাজার, বেশুমার মন (বারোস 1919-20: 7, 12, 30)।

পূর্ব আফ্রিকায় জার্মান সৈন্যদের উত্যক্ত করতে শুরু করে সে। একবার একটি জার্মান সৈন্য খেতে দেয় এক অনাহারী সিংহকে। তাতে অবশ্য প্রতিশোধ পূর্ণ হয় না। লাখ লাখ জার্মান সৈন্য এখনো প্রাণে বেঁচে রয়েছে--জীবনের বাদবাকি ক'টি দিন টার্জানকে সুখে মাতোয়ারা রাখতে এ বার্তাই কাফি। কালো আদমির ওপর জার্মান নৃশংসতার কথা ফলাও করে বলেছেন বারোস।

এ নৃশংসতার বীজ, তাঁর মতে, জার্মান কুলটুরেই (Kultur) নিহিত। অবশ্য একবার টার্জান যখন দেখে একদল কালা একটা শাদা মেয়ে বন্দী করেছে তখন কালো কতলের হাত নিশপিশ থামাতে পারে না বেচারা। কালো খুনে বেচারার বিশেষ আনন্দ, খুনখেলায় দিন দিন সে হয়ে উঠেছে বড় পারদর্শী। দলের সর্বশেষ কালো মানুষটিকেও সে হত্যা করে, তারপর ধড়খসা মাথা এক গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেয় পথের ওপর। কালোদের প্রাণপাখি ভয়ে খাঁচাছাড়া।

বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না অবশ্য সে ভয়। কারণ নাবালক শিশুসম নিগ্রো জাতিরও এক গুণ এই যে দুঃখকষ্টের ছায়া বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না ওদের মনে। আধঘন্টা না যেতেই কাটামাথার কথা সকলে ভুলে বসে। তাই--সবার যাতে মনে পড়ে--মাথা থেকে ছিঁড়ে নেয়া ধড় রাস্তার ওপর ফেলে রাখে টার্জান। কালোর হাতে বন্দী শাদা মেয়েটি জাতে জার্মান।

টার্জানের দোটানাটা বেশ মজার। যত ঘৃণার পাত্রীই হোক সে জার্মান নারী। টার্জান বুঝতে পারে ওকে 'নিচু কালো জাতের হাতে জিম্মি' রেখে যেতে তো সে পারে না। ওর অবিরাম ভাবনা: বেচারিকে 'ধুম ধাড়াক্কা মার দিচ্ছে বেদিল নিগ্রো মাগিদল। ' অতএব উদ্ধার অভিযান ছাড়া পথ নাই (বারোস 1919-20: 84, 88)।

কায়জারি জার্মানির শেষ পরাজয়ের পর মাথাচাড়া দেয় নতুন আরেক হুমকি--আরো বড় বিপদের কারণ তার ভেতর। আফ্রিকায় যুদ্ধ ও বিপ্লব ঘটাবার মতলবে কমিউনিস্ট গোয়েন্দা অভিযান শুরু হয়, দেহাতি মনস্তত্ত্বে মহাপারদশর্ী টার্জানই ওদের পথের বড় কাঁটা। ওপার শহরের সোনাদানা লুটের বাসনায় অভিযান পরিকল্পনা করে কমিউনিস্টরা। এই লুটের সোনা দিয়েই ওরা অভিযানের অস্ত্র ও অর্থ জোগান দেবে। অভিযানের উদ্দেশ্য ফরাসিদেশ ও ইতালির মধ্যে যুদ্ধ উসকে দেয়া।

এয়ুরোপীয় শক্তিজোট একবার পরস্পর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক। তখন উত্তর আফ্রিকাবীরা বিদেশি শাসনের জোয়াল ফেলে দেবার আর গোটা তল্লাটে স্বশাসিত সোভিয়েত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মর্যাদায় ধর্মযুদ্ধসম অভু্যত্থান ঘটাবে। কমিউনিস্ট নেতা পিটার জুয়েরি অবশ্য, মুখে আওড়ালেও, কমিউনিস্ট আদর্শ অন্তরে এক ফোঁটাও বিশ্বাস করে না। ওর আসল মতলব ওপারের সোনাদানা হাত করা, আফ্রিকার সম্রাট হওয়া, ক্ষমতা দখল করা। এ দুনিয়ার সুখ-শান্তি ধ্বংস করার লোভে কমিউনিস্টরা যে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে, নির্দয়চিত্ত টার্জানের হাতে তার সর্বনাশ।

কমিউনিস্ট নাশকতার গল্পের তলে তলে কার্যকর বিশ্বাসটি এই: নিজ বলে শ্বেতাঙ্গ শাসন উৎখাত করতে সমর্থ নয় কৃষ্ণাঙ্গসমাজ। কৃষ্ণাঙ্গদের যেকোন বিপ্লবী আন্দোলনের নেতৃত্ব শাদার হাতেই থাকছে। জুয়েরি গয়রহ টার্জানের হাতে মার খেয়ে শেষ হয়ে গেল। ওদের অনুসারীরা অসহায় হয়ে পড়ল। ওদের শুদ্ধ ঘরে ফেরার তাগাদা।

শাদা প্রভুর নির্দেশরিক্ত আর আশ্রয়বঞ্চিত কালোরা বড্ড একা বড্ড অসহায় বোধ করে। বেশ স্বস্তিদায়ক বিশ্বাস, সন্দেহ কি (বারোস 1930-31: 36, 186, 190)! বারোসের লালখুরি এমনই সফল যে এ কেচ্ছার আরেক খণ্ড ছাপতে বেশিদিন দেরি করবার দরকার হয় না। এ খণ্ডে দেখা যায় লিয়ন স্টাবুচ নামধারী এক গোয়েন্দাকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছেন খোদ স্টালিন--আফ্রিকা ঢুড়ে খুঁজে বার করে টার্জান হত্যাই ওর চাকরি। প্রাসঙ্গিক বিপদ প্রসঙ্গ টেনে স্টাবুচকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন তিনি: তোমার পথের কাঁটার ক্ষমতা কখনো ছোট করে দেখো না। তোমার কথা মত হতে পারে নরবানর বৈ নয় সে, কিন্তু মনে রেখো এক সুসংগঠিত লাল অভিযান সম্পূর্ণ ফৌত করে ছেড়েছে সে-ই।

তা না ঘটলে সে অভিযান আবিসিনিয়ায় আর মিসরে অনেক উদ্দেশ্য পূরণে সমর্থ হত ...। আমরা আর এক অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছি, কমরেড, এ কথা বলতে বাধা নাই। কিন্তু পথের কাঁটাটি সরানো হয়েছে তোমার কাছে এই মর্মে রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত অভিযান বন্ধ থাকবে। কমিউনিস্টদের নিকৃষ্টতম অপরাধীরূপে আঁকা হল আরো একবার। স্টাবুচ জোট বাঁধে ডোমিনিক কাপিয়েত্রো নামের জনৈক ইতালি কমিউনিস্টের সঙ্গে।

এই ডোমিনিক আবার একই সঙ্গে আবিসিনিয়ায় তৎপর একদল দাস-ব্যবসায়ীর সর্দার। ওদের হাতে বন্দী একটি শাদা মহিলার দখল নিয়ে দুজনে হাতাহাতির উপক্রম হয়। কাপিয়েত্রো প্রস্তাব করে ফয়সালা হোক তাসে। বাজিতে কাপ্রিয়েত্রোর জিত হয়। কিন্তু স্টাবুচ তাকে খুন করে।

এমনধারা কাপুরুষোচিত অপরাধবৃত্তির কাছে টার্জান হেরে যাবে! হতেই পারে না। স্টাবুচ শেষমেষ কোণঠাসা হয় আর টার্জান মজাসে খেলতে খেলতে তীরের ওপর তীর ছুঁড়ে ফোপড়া করে দেয় ওর বুক। ইচ্ছা করেই যন্ত্রণা এমন দীর্ঘ করা। মৃতপ্রায় স্টাবুচ যখন 'মরণ আজাবে আর ভয়ে কিলবিল করছে' মাত্র তখনই তাঁকে হত্যা করে টার্জান। আফ্রিকায় বিপ্লব চেতানোর স্টালিনি কোশেস আপাতত এখানেই খতম (বারোস 1931-32: 12, 171)।

1941 সাল নাগাদ বারোসের বাস হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে। পার্ল হর্বারে জাপানি হামলা নিজ বাগানে বসে নিজ চোখেই দেখতে পান ভদ্রলোক। প্রশান্ত মহাসাগরের যুদ্ধ চলাকালে তিনি ছিলেন সমর এজাজতপ্রাপ্ত সরকারি সাংবাদিক। টার্জানমালার শেষ কেতাব টার্জান ও বিদেশী বাহিনী এই অভিজ্ঞতার ছাপ বহন করছে। এ গল্পে সুমাত্রায় জ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.