ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট নামে অভিহিত বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বাংলাদেশ অংশে পাঁচ হাজার ৭৭১ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবন এখন সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অবহেলা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং একশ্রেণীর মানুষের লোভ-লালসার শিকার হয়ে প্রায় বিপর্যস্ত। লবণমুক্ত বা সুপেয় পানির অভাবে সুন্দরবনের বাসিন্দা—প্রাণীকুল মারা যাচ্ছে। এসব উপদ্রবকে ছাড়িয়ে নতুন করে হুমকির কবলে পড়েছে সুন্দরবন।
২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড ও ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশনের (এনটিপিসি) সঙ্গে সুন্দরবনের সীমান্ত থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে বাগেরহাটের রামপাল উপজেলায় এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উত্পাদনক্ষমতাসম্পন্ন একটি কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনে চুক্তি হয়। এ জন্য কৃষি ও চিংড়ি চাষের আওতাভুক্ত এক হাজার ৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ করে বিদ্যুত্ প্ল্যান্ট নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে।
পরিবেশ গবেষকেরা বলছেন, সুন্দরবনের এত কাছে এই বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপিত হলে ভবিষ্যতে আমাদের অহংকার ও বিশ্বঐতিহ্যের সুন্দরবনের অবশ্যই ক্ষতি হবে। পরিবেশের ওপর প্রভাব মূল্যায়নকারী গোষ্ঠী (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট) তাদের স্টাডি রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের জন্য বিভিন্ন ভারী যন্ত্রাংশ ও সরঞ্জাম প্রকল্প এলাকায় বিশাল যান্ত্রিক নৌযানযোগে নেওয়ার সময় উদ্ভূত উচ্চমার্গের শব্দমাত্রা, আলোকচ্ছটা এবং বর্জ্য নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা যদি বন্য প্রাণীর অবাধ বিচরণের অনুকূল না থাকে, তাহলে সুন্দরবনের প্রতিবেশ হুমকির মুখে পড়বে এবং বন্য প্রাণী, বিশেষত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, কুমির ও ডলফিনদের জীবন সংশয়, এমনকি বিলুপ্তিও ঘটতে পারে। এ ছাড়া গ্যাসের দূষণের কারণে সুন্দরবনের অনন্য সম্পদ প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গরান, গেওয়া ও কেওড়াগাছ বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। নির্মাণকাজ চালানোর সময় অতিরিক্ত নৌযান চলাচল এবং ড্রেজিংয়ের সময় মাছের চলাচলের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি হবে এবং চিংড়ি মাছের প্রজনন বাধা পাবে।
২০০৬ সালে সুন্দরবন ভ্রমণের সময় আমি দেখেছি, জেলেরা হাজার হাজার নৌকা নিয়ে শেলা নদী ও সাগরের মোহনায় জাল বিছিয়ে বসে আছে চিংড়ির পোনা ধরার জন্য।
ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্টের স্টাডি রিপোর্ট অনুযায়ী, এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এই বিদ্যুেকন্দ্র চালু হওয়ার পর এই কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন ১৪২ টন সালফার ডাই-অক্সাইড এবং ৮৫ টন নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড উিক্ষপ্ত হবে। এই দুটো গ্যাস নিঃসরণ হওয়ার ফলে সুন্দরবনের আশপাশ এলাকায় এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। সমীক্ষা দল নিরাপদ অবস্থানে থেকে স্টাডি রিপোর্টে ১৯৯৭ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের উল্লেখ করে সুন্দরবনকে গ্রামীণ ও আবাসিক এলাকা বলে অভিহিত করেছেন। এই নিরিখে এই মাত্রার গ্যাসদূষণ সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর হবে না বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু সুন্দরবনকে কি আবাসিক এলাকা বলে চিহ্নিত করা যায়? ইআইএ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমান অবস্থায় সুন্দরবনের আশপাশ বা চৌহদ্দির মধ্যে সালফার ডাই-অক্সাইডের মাত্রা প্রতি কিউবিক মিটারে ৮ থেকে ১০ মাইক্রোগ্রাম।
এক হিসাবে বলা হয়েছে, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গড়ে ২৪ ঘণ্টায় এই গ্যাস নিঃসরণের সর্বোচ্চ মাত্রা প্রতি কিউবিক মিটারে ৫৩ দশমিক ৪ মাইক্রোগ্রাম হতে পারে। সুন্দরবনকে আবাসিক এলাকা বিবেচনা করলে, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ১৯৯৭ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে আবাসিক এলাকার জন্য এই মাত্রা প্রতি কিউবিক মিটারে ৮০ মাইক্রোগ্রাম। সে ক্ষেত্রে প্রতি কিউবিক মিটারে ৫৩ দশমিক ৪ মাইক্রোগ্রাম মাত্রার সালফার ডাই-অক্সাইড গ্যাস সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর হবে না। কিন্তু কোনো মানদণ্ড, বিবেচনা ও যুক্তিতে সুন্দরবনকে আবাসিক এলাকা হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। এই প্রকল্পে প্রতিদিন কয়লা ধোয়ার জন্য ২৫ হাজার কিউবিক মিটার স্বচ্ছ পানি ভূগর্ভস্থ স্তর থেকে উত্তোলন করতে হবে।
২৫ বছর এই প্রকল্পের আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছে, সুতরাং ২৫ বছর প্রতিদিন এই পরিমাণ পানি উত্তোলনের কাজটি চালিয়ে যেতে হবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এর পরিণতিতে সুন্দরবন অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাবে। ফলে এই অঞ্চলে বিশুদ্ধ বা সুপেয় পানির ঘাটতি দেখা দেবে।
ইআইএ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, এই বিদ্যুেকন্দ্র চালু হওয়ার পর সুন্দরবন এলাকায় নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্বের মাত্রা প্রতি কিউবিক মিটারে ১৬ মাইক্রোগ্রাম থেকে বেড়ে ৫১ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রামে পৌঁছাবে। ১৯৯৭ সালের পরিবেশ আইন অনুযায়ী, এটা নিরাপদ মাত্রা।
সুন্দরবনকে আবাসিক এবং রুরাল অর্থাত্ গ্রামীণ এলাকা অভিহিত করে পরিবেশগতভাবে নাজুক ও বিপন্ন সুন্দরবন এলাকার জন্য ছাড়পত্র কি এভাবে দেওয়া ঠিক হবে? ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্বঐতিহ্যমণ্ডিত এই ‘রামসার সাইট’ এলাকা কেন এতটা অবহেলা ও উপেক্ষার শিকার হচ্ছে? ১৯৯৭ সালের পরিবেশ আইনে পরিবেশগতভাবে চরম সংকটাপন্ন এলাকার জন্য নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইডের সর্বোচ্চ মাত্রা প্রতি কিউবিক মিটারে ৩০ মাইক্রোগ্রাম নির্ধারিত হয়েছে।
সুন্দরবন আবাসিক এলাকা ঠিকই, কিন্তু সেটা বন্য প্রাণীদের জন্য। সুন্দরবন অঞ্চলে ভাসমান গ্যাসের ঘনীভূত মেঘ থেকে অ্যাসিড বৃষ্টিও হতে পারে। জানা গেছে, এই বিদ্যুত্ প্ল্যান্টে ইন্দোনেশিয়া বা অস্ট্রেলিয়া কিংবা সাউথ আফ্রিকা থেকে আমদানি করা ৪ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন টন কয়লা প্রতিবছর পোড়ানো হবে, যা থেকে বছরে শূন্য দশমিক ৯৪ মিলিয়ন বা ৯ দশমিক ৪ লাখ টন ছাই এবং পাঁচ লাখ টন তরল বর্জ্য নিঃসৃত হবে। তরলবর্জ্যের শেষ গন্তব্যস্থল হবে পশুর নদ কিংবা সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত শেলা নদী ও অসংখ্য খাঁড়ি বা মূল নদীর দুই পাশ দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট খাল।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে এই প্ল্যান্ট থেকে নিঃসৃত ছাই নিয়ে। এই ছাইয়ের ৮০ শতাংশ থাকবে উড়ন্ত বা ভাসমান। এই ভাসমান ছাইতে পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পদার্থ, যেমন সিসা, পারদ, নিকেল, বেরিলিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম ইত্যাদি ভারী ধাতব কণা মিশ্রিত থাকবে। এগুলো উড়ে সুন্দরবনের জল-জঙ্গলের ওপর পড়তে থাকবে। তাহলে অবস্থাটা কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, একবার চিন্তা করে দেখা যেতে পারে।
প্রকল্প তৈরির কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, ছাই ব্যবস্থাপনার কাজটি শতভাগ সুষ্ঠু ও ত্রুটিমুক্ত রাখার প্রয়াস চলবে। ইআইএ ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্টে এটা স্বীকার করা হয়েছে যে খুব সুষ্ঠু ছাই-ব্যবস্থাপনা সত্ত্বেও ভারী ধাতু মিশ্রিত কিছু ছাই থেকে যেতে পারে, যা সুন্দরবনের মতো বিপন্ন, নাজুক ও স্পর্শকাতর এলাকার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। আর দুর্ঘটনাজনিত কারণে এই ব্যবস্থাপনার কাজ বিকল হয়ে গেলে সুন্দরবন এলাকাজুড়ে জল-জঙ্গল ও সন্নিহিত কৃষিক্ষেত্রে এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এসব আশঙ্কা ও বিপদের কথা বিবেচনা করে প্রস্তাবিত রামপাল বিদ্যুেকন্দ্রটি সুন্দরবনের সীমানা থেকে অন্তত ২৫ কিলোমিটার দূরে সরিয়ে নেওয়া কি যায় না?
উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে এক হাজার ২৩০ মেগাওয়াট উত্পাদনক্ষমতাসম্পন্ন ‘ফায়েট কয়লাভিত্তিক’ বিদ্যুেকন্দ্র চালু করা হয়। সে সময় এই বিদ্যুেকন্দ্র ওই এলাকার পরিবেশ, বিশেষভাবে ‘পেকান বনাঞ্চলের’ কোনো ক্ষতি করবে না—এমনটাই বলা হয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে এই বিদ্যুেকন্দ্র এক হাজার ৬৯০ মেগাওয়াটে উন্নীত করা হয়। ফায়েট বিদ্যুেকন্দ্র থেকে বছরে ৩০ হাজার টন সালফার ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ ঘটে। ৩০ বছর পর বিপদটা লক্ষ করা গেল। ওই এলাকার হাজার হাজার পেকান, এলম এবং ওকগাছ মারা যাচ্ছে। মোদ্দা কথা হলো, ফায়েট বিদ্যুেকন্দ্র থেকে বছরে নিঃসৃত ৩০ হাজার টন সালফার ডাই-অক্সাইডের প্রভাবে টেক্সাস হাইওয়ের ৪৮ কিলোমিটার বিস্তৃত অঞ্চলে গাছগাছালি শুকিয়ে যাচ্ছে, যেটা মৃত্যুর লক্ষণ।
তাহলে যে বিদ্যুেকন্দ্র থেকে প্রতিদিন ১৪২ টন সালফার ডাই-অক্সাইড নির্গত হবে, সেই কেন্দ্রের সন্নিহিত এলাকায় বনরাজির কী অবস্থা হতে পারে?
বিদ্যুত্ প্ল্যান্ট থেকে শুধু সুন্দরী, গরান, কেওড়া, গেওয়া ও গোলপাতার গাছই ধ্বংস হবে না, এর প্রভাবে সমগ্র সুন্দরবনের প্রাণীদের খাদ্যশৃঙ্খলও ভেঙে পড়বে। অর্থাত্ যদি কেওড়াগাছ না থাকে, তাহলে হরিণ বাঁচবে না আর হরিণ না থাকলে বাঘের খাদ্যে টান পড়বে। তাই এখন যে কয়টা বাঘ আছে, সেগুলো খাদ্য না পেয়ে ভারতীয় অংশের সুন্দরবনে চলে যাবে কিংবা বিলুপ্ত হবে। একটা হিসাব পাওয়া গেছে, এই বিদ্যুেকন্দ্র চালানোর জন্য পশুর নদী থেকে প্রতি ঘণ্টায় নয় হাজার ১৫০ কিউবিক মিটার পানি উত্তোলন করা হবে এবং প্রতি ঘণ্টায় পাঁচ হাজার ১৫০ কিউবিক মিটার ব্যবহূত পানি ছেড়ে দেওয়া হবে নদীতে। পানি টেনে নেওয়া এবং ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে এই পার্থক্যের ফলে এলাকার যে পরিবেশগত পরিবর্তন আসবে, তাতে সুন্দরবন অঞ্চলে লবণাক্ততা আরও বেড়ে যাবে।
এ ছাড়া পরিবর্তন আসবে পলি জমা হওয়া এবং নদীর জোয়ার-ভাটার প্রকৃতিতে। পৃথিবীর সর্বত্র কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় শর্ত হলো: শূন্য ডিসচার্জ অর্থাত্ বর্জ্য কিংবা দূষিত তরল বা পানি বাইরে নিকাশ করা যাবে না। এনটিপিসি কোম্পানি ভারতের ছত্তিশগড়ের কুকুরদা তাপবিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণকাজে এই নীতি অবলম্বন করছে।
আসাদ উল্লাহ খান: পরিবেশবিদ এবং বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক।
aukhandk@gmail.com।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।