আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আইভি রহমান

মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।

আইভি রহমানঃ নারী আন্দোলন ও মহিলা আওয়ামী লীগ সংগঠিত করণের অন্যতম রূপকার বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই রাজনীতিতে আবির্ভাব আইভি ও জিল্লুর রহমানের। সারাজীবন নিষ্ঠা আর সততার সঙ্গে, নিঃস্বার্থভাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতির বাস্তবায়নে এই দুই সৈনিক নিরালসভাবে কাজ করেছেন। ক্ষমতায় থেকে কখনো ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি। আদর্শ বিচ্যুত হননি।

বরং দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন গভীর আস্থা ও বিশ্বাসের। আইভি ও জিল্লুর রহমান _বাংলাদেশের দুই প্রজন্মের, দুই প্রধানমন্ত্রীর অপার স্নেহ ও গভীর আস্থা এবং ভালোবাসার সান্নিধ্য পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সুসময়, দুঃসময়ের বহু ঘটনার সঙ্গী ছিলেন আইভি রহমান। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতা-কর্মীর প্রিয় মানুষ ও নেত্রী ছিলেন। তিনি আমৃত্যু এ দেশের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলন এবং মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ে লড়াই করে গেছেন।

আইভি রহমানের জন্ম ১৯৪৪ সালের ০১ ডিসেম্বর। কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব থানায়। তাঁর পিতা মরহুম অধ্যক্ষ জালাল উদ্দীন আহমেদ ও মাতা বেগম হাসিনা বানু। পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর প্রাইমারী, হাইস্কুল ও কলেজ।

কলেজের পড়াশুনা শেষ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বাংলায় বি এ (অনার্স) ডিগ্রী অর্জন করেন। তাঁর সহধর্মিনী ছিলেন মোঃ জিল্লুর রহমান। জিল্লুর রহমান বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি। তাঁদেরে পারিবারিক জীবন ছিল খুবই সুখের।

তাঁদের পরিবারে ৩ টি সন্তানের জন্ম হয়। ১ পুত্র ও ২ কন্যা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আইভি রহমান ছাত্রজীবন থেকেই গণতন্ত্র ও মানুষের মুক্তির সংগ্রামে যুক্ত হন। ১৯৬২ সালে আইয়ুব সরকারের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন একজন সংগঠক হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। সেপ্টেম্বর মাসে শরীফ শিক্ষা কমিশন বিরুদ্ধে যে লড়াকু ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে, সেই আন্দোলনেও তিনি সংগঠক ও নেত্রীত্বের ভূমিকা পালন করেন।

১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে তিনি একজন নেতা হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকাকালীন তিনি মহিলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাংগঠনিক সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আইভি রহমান বীরোচিত ভূমিকা পালন করেন। এ সময় তিনি ঢাকা শহরে নির্বাচনের সাংগঠনিক কাজে মহিলা আওয়ামী লীগের কর্মীদের সংগঠিত করেন।

তাঁদের নিয়ে ওই নির্বাচনে শহরের প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বেগম সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে তিনি রাইফেল ও ফাস্ট-এইড ট্রেনিং নেন। অন্যান্য মহিলা কর্মীদের সংগঠিত করে ট্রেনিং দেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুজিব নগর সরকারের অধীনে ভারতে বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পগুলোতে কানাডীয়ান ইউনাইটারী মিশন এবং রামকৃষ্ণ মিশনের সহায়তায় খাবার, ঔষধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করতেন। তাছাড়াও তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল, উদ্যম ও অনুপ্রেরণা সৃষ্টির জন্য তিনি জয়বাংলা রেডিওতে নিয়মিত বিপ্লবীকন্ঠে কথিকা পাঠ করতেন।

যা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড পরিমানে উৎসাহ যোগাত। মহান মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে অর্থাৎ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বেচছাসেবী নারী সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা সমিতি সংগঠিত হয়। মহিলা সমিতি পুনর্গঠনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন রাখেন। আমৃত্যু তিনি এ সমিতির উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ নারীবর্ষ উদযাপন কমিটি গঠিত হয়।

তিনি ছিলেন এর একজন উদ্যোক্তা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়। স্বাভাবিকভাবে নয়, অস্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হয়। রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, সাম্রাজ্যবাদী চক্র ও মিরজাফরের বংশধরগোষ্ঠী(মোস্তাক গংরা)। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মীদের ওপর অত্যাচার ও নিপীড়ন।

এ অত্যাচার থেকে কমিউনিস্টরাও মুক্ত ছিলেন না। এ সময় তিনি দৃঢ়তার সাথে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৮ সালে আইভি রহমানকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মহিলা বিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। এ সময় তিনি দেশের প্রত্যন্ত জেলাগুলোতেও মহিলাদের সংগঠিত করার জন্য কাজ শুরু করেন। তাঁর ত্যাগ, অবদান ও গতিশীল নেতৃত্বের কারণে সারা দেশে মহিলাকর্মীর সংখ্যা ব্যাপক পরিমানে বৃদ্ধি পায়।

যার ফলশ্রুতিতে ১৯৮০ সালে তাঁকে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত করা হয়। উভয় ক্ষেত্রে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনকালে তিনি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ এবং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচচার ও সাহসী ভূমিকা রাখেনন। বেগম আইভি রহমান স্কুল জীবনে মুকুল ফৌজ, গার্লস গাইডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমাজসেবামুলক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত হন। বাংলার অনগ্রসর নারীকে সমাজকে রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিকভাবে উদ্বুদ্ধ এবং সচেতন করে গড়ে তোলার জন্য তিনি আজীন সংগ্রাম করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন এ দেশে একজন অগ্রগামী সৈনিক।

সর্বক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীর অধিকার আদায়ে লড়েছেন আপোষহীনভাবে। নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত সময়কালে তিনি জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নারী উন্নয়নে জাতীয় নারী নীতিমালা ও কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করে। এই নীতিমালা প্রণয়নে তাঁর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এ সময় তিনি আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতা হিসেবে নারী অধিকার ও নারী উন্নয়নে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন৷।

তাছাড়া ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন বিরোধী আইন প্রণয়নে আইভি রহমান অনবদ্য অবদান রাখেন। নারী সংগঠন ও মানবাধিকার সংগঠনের মতামতের প্রতি ছিল তার অকুন্ঠ সমর্থন। জাতীয় যৌতুক প্রতিরোধ সমিতি, এসিড সার্ভাইভার্স ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ ফ্যামিলি প্ল্যানিং এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও স্বেচছাসেবী সংগঠনের কর্মকাণ্ডে তিনি জড়িত ছিলেন। বাংলাদেশ অন্ধকল্যাণ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আইভি রহমান বাংলাদেশ মহিলা সমবায় সমিতির চেয়্যারম্যানসহ আরও অনেক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নারী অধিকার সচেতনে আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল এলায়েন্স অব উইমেন’ এর সম্মানিত সদস্য ছিলেন।

‘ইন্টারন্যাশনাল এলায়েন্স অব উইমেন’ এর স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি The American Biographic Institute USA কর্তৃক Woman of the year ২০০০ নির্বাচিত হন। ২০০১-২০০৪ সালে তিনি মহিলা সমিতির সদস্য হিসেবে আন্তর্জাতিক সংস্থা The Associated Country Women of the World (ACWW) এর সেন্ট্রাল এন্ড সাউথ এশিয়ার এরিয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। আইভি রহমান ২০০৩ সালে বাংলাদেশ মহিলা সমিতির উদ্যোগে ঢাকায় একটি আন্তঃএশিয়া কনফারেন্স আয়োজনে নেতৃত্ব দেনএর পাশাপাশি দেশে ও বিদেশে তিনি বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। সমাজসেবা/জনসেবা ক্ষেত্রে অনন্য ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখার জন্য বেগম আইভি রহমান-কে স্বাধীনতা পুরস্কার-২০০৯ (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। আইভি রহমান দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও জনগণের অধিকার পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে সক্রিয় থাকা অবস্থায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস বিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হন।

ঘটনাস্থলে তাঁর দু’টি পা ছিন্নভিন্ন হয়ে ছিটকে যায়। চিকিৎসার জন্য প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তাঁকে স্থানান্তর করা হয়। ৫৭ ঘন্টা মৃত্যুর সাথে লড়াই করে ২৪ আগস্ট রাত ২ টায় তিনি মারা যান।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.