আমি সব সময় আমার ভিতরের আমিকে খোজি আমাদের এই লেখা কেবল শাহবাগের আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে নিবেদন করলাম। তাঁরা কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে দেশব্যাপী জাগরণ সৃষ্টি করেছেন। এখন এই অদম্য তরুণদের সামনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অন্তত ৩০ জন যুদ্ধাপরাধীর দণ্ডের তথ্য হাজির করব। এই দণ্ডিতরা সম্ভবত কাদের মোল্লার চেয়ে কম মারাত্মক অপরাধী। কিন্তু এ দেশেরই আদালত তাঁদের দালাল-যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে শাস্তি দিয়েছিলেন।
সে সময় যাবজ্জীবনের মেয়াদ ছিল ২০ বছর। কিন্তু কতজন দণ্ডিত, কে কত সাজা ভোগ করেছেন, তা জানা যায় না।
এমনকি ফাঁসির হুকুমও কারও কারও হয়েছিল। অবাক হব না, যদি তদন্তে দেখা যায় যে কোনো ফাঁসির আসামি আজও বেঁচে থাকেন। জনতার দাবির মুখে একজন কাদের মোল্লার জন্য মন্ত্রিসভা দ্রুত আপিলের বিধান সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।
সংসদ আইন করতে যাচ্ছে। এই যখন রাষ্ট্রের বাস্তবতা, তখন তরুণ আন্দোলনকারীরা মুজিবের আমলে যেসব যুদ্ধাপরাধী দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাঁদের বিষয়ে একেবারে নীরব থাকবেন, সেটা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
আমাদের সন্দেহ কম জোরালো নয় যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী এখনো বহাল তবিয়তে আছেন। তাঁরা আমাদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমাদের ধারণা, তাঁদের মধ্যে এমনও কেউ থাকতে পারেন, যাঁদের শুধু আইন অনুযায়ী জেলে ভরে রাখা যাবে, নতুন করে কোনো বিচার লাগবে না।
কল্পনা করতে দ্বিধা নেই যে তেমন দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে ফাঁসির আসামিও বেঁচে থাকতে পারেন। হয়তো তাঁর জন্য আপিলও লাগবে না।
তাহলে চিন্তা করুন তো, আমরা কেমন দেশে আছি, যেখানে পঁচাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে যাবজ্জীবন ও ফাঁসির হুকুম হয়েছিল, অথচ আইনের চোখে পলাতক! এখন তাঁদের ব্যাপারে একটা খবর পর্যন্ত নিতে আমাদের চেষ্টা নেই। কিন্তু যাঁর ফাঁসি হয়নি, তাঁর জন্য আমরা কফিন বানিয়ে রাখছি। ঘরে না ফেরার পণ করছি।
আপিল বিভাগকে চাপ দিচ্ছি। মওদুদ আহমদদের ইঙ্গিত করার সুযোগ দিচ্ছি, ট্রাইব্যুনালের রায় কেউ মানেন না।
২০০৯ সালে এই কলামে আমরা বিষয়টির অবতারণা করেছিলাম। লিখেছিলাম, একটি মিথ ভেঙে যাক। কিন্তু বুঝলাম, আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতারা এবং তাঁদের তস্য মিত্ররা সম্ভবত বিষয়টি চেপে থাকাটাকেই শ্রেয় মনে করেছেন।
এর মাহাত্ম্য বুঝতে আমাদের কষ্ট হয় না। কারণ, তাঁরা পারতপক্ষে এমন কিছু ছুঁয়ে দেখেন না, এমন কিছু নিয়ে মাথা ঘামান না, যা তাঁদের রাজনৈতিক মুনাফা কিংবা সস্তা বাহবা কুড়ানোর সুযোগ না দেয়। গ্ল্যামার বা চটক না থাকলে আইনের শাসনে তাঁদের ভীষণ অরুচি। শাহবাগ আন্দোলনের প্রথম ১০ দিন বিএনপির নেতাদের টক শোতে কম দেখা গেছে। এখন বিএনপিকেও দৃশ্যত অবস্থান বদলাতে হচ্ছে।
এই বিষয়ে বিএনপির প্রথম বৈঠক হলো ১২ ফেব্রুয়ারি। বৈঠকে যখন বলা হলো, তারা কি মিত্র জামায়াতের বিরুদ্ধে মুখ খুলবে? দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াই নাকি উল্টো বলছেন, ‘আপনারা বলেন না কেন, বলেননি কেন?’ এর মানে, এখন তিনিও বাহবা নিতে রাজি।
চোখ বুজে এটা কল্পনা করতে ভালো লাগে যে প্রজন্ম চত্বরের জনতা বাহাত্তর থেকে চলে আসা বাংলাদেশের একনায়কতান্ত্রিক সংবিধানের গণতন্ত্রায়ণের দাবিতে মোমবাতি জ্বালিয়েছেন। কিন্তু আপাতত তা বাস্তব নয়। তবে এই মুহূর্তের বাস্তবতা এটাই যে তারা ফাঁসির দাবিতে উচ্চকিত।
শাসক দলটির ক্ষতি এটাই যে জনতা তাদের আটকে দিয়েছে। আঁতাতের চিন্তা থাকলেও এখন তা তাদের পরিহার করতে হবে। কিন্তু সবকিছু সত্ত্বেও আওয়ামী লীগই এমন দল, যাদের কাছে আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কিংবা ধর্মের অপব্যবহার রোধে বিএনপির চেয়ে ভালো কিছু আশা করতে পারি। কিন্তু এটা যেন আমরা ভুলি না যে দুই দলই আইনের শাসনে বিশ্বাসী নয়। এর প্রমাণ দিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে ফাঁকির গল্পটা বলছি।
কয়েক দিন আগে বিবিসির এক আলোচনায় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বিএনপির সমালোচনা করে বলছিলেন যে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে বিচার বাতিল করেছিলেন এবং রাজাকারদের ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমরা তখন কান খাড়া করি। কারণ, ওই আলোচনায় শাহবাগ আন্দোলনের একজন তারকা ব্লগার এবং বিএনপির সাবেক মন্ত্রী হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ ছিলেন। সেখানে বিএনপির নেতাকে ‘তুই রাজাকার’ও বলতে শুনলাম। এমনকি তিনি এটাও বললেন যে বিএনপি ক্ষমতায় গিয়েও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চালিয়ে যাবে।
কিন্তু দেশের মানুষ এটা বিশ্বাস করবে না যে মেজর হাফিজের কথায় বিএনপির প্রকৃত দলীয় অবস্থানের প্রতিফলন ঘটেছে। মতিয়া চৌধুরী যখন বলছিলেন যে খালেদা জিয়া ময়মনসিংহের জনসভায় নিজামীদের যুদ্ধাপরাধী বলে মনেই করেন না, তখন হাফিজ প্রতিবাদ করেননি। কিন্তু আমরা কান খাড়া করেছিলাম এ কারণে যে মেজর হাফিজের মতো একজন মুক্তিযোদ্ধা মতিয়া চৌধুরীর বিচার বাতিল এবং জেল থেকে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে কী বলেন। কিন্তু তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি।
তখনো দেশে সংবিধান আসেনি।
এ সময় দালাল আইন পাস হয়। ১৯৭৩ সালের আইনটিকে সুরক্ষা দিতে গিয়ে বাহাত্তরের দালাল আইনটিও সংবিধানের ৪৭(৩) অনুচ্ছেদে সুরক্ষা পায়। কিন্তু দালাল আইনটি ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর বাতিল হয়। এটি বাতিল করেন রাষ্ট্রপতি সায়েম। জিয়াউর রহমান তখনো নেপথ্যের নায়ক।
সুতরাং বিএনপির মুক্তিযোদ্ধারা বলতে পারেন যে জিয়াউর রহমান এটা বাতিল করেননি। ২০০৯ সালের ৩০ মার্চ আমরা লিখেছিলাম, প্রস্তাবিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল ‘একটি বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই কোনো অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে তাঁরা দণ্ড বা খালাস দেবেন। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের দায়ে যাঁদের দণ্ড ইতিমধ্যে হয়ে গেছে, তাঁদের কী হবে? এই দণ্ডিত ব্যক্তিরা কোন জাদুমন্ত্রবলে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন, তা আমাদের জানতে হবে। ’
সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকা একজন আইনবিদ আমাদের নিবন্ধটি প্রকাশের পর আগ্রহ দেখালেন। আমাদের ক্লিপিং দিতে বললেন।
জানালেন, তিনি এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন। প্রসিকিউশন টিমের একজন সদস্যও আমাদের লেখার যৌক্তিকতা স্বীকার করলেন। কিন্তু নিট ফল শূন্য।
১৯৭৫ সালে সায়েমের করা বাতিল আইনটির মাত্র দুটি ধারা ছিল। প্রথমটি বলেছে, পিও ৮ বাতিল করা হলো।
দ্বিতীয়টি বলেছে, ‘এই আইন বাতিলের আগে যাঁদের নামে যেকোনো আদালতে বা কর্তৃপক্ষের সামনে মামলার কার্যক্রমবিষয়ক যা-ই চলতে থাকুক না কেন, তা আর সামনে এগোবে না। যেখানে যে অবস্থায় যা আছে, তা মৃত্যুমুখে পতিত হবে। ’
কিন্তু এই গল্পের এখানে শেষ নয়। শুরু।
স্বাধীনতার পর যুদ্ধাপরাধের দায়ে ৩৭ হাজার ব্যক্তিকে আটক করা হয়।
কারাগার ভরে যায়। এ অবস্থায় যাঁদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল না, তাঁদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। প্রেসনোট বলেছিল, যাঁদের বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ ইত্যাদির নির্দিষ্ট অভিযোগ থাকবে, তাঁদের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে মামলা দায়ের করা হবে। সেদিক থেকে ১৯৭৩ সালের আইনে ট্রাইব্যুনাল গঠনের ধারাবাহিকতাও আছে। ওই ঘোষণার পরে প্রায় ৩৭ হাজার লোকের মধ্যে প্রায় ২৬ হাজার ছাড়া পান।
কারাগারে ও পলাতক অবস্থায় থাকেন প্রায় ১১ হাজার। এই ১১ হাজারের মধ্য থেকে ৭৫২ জন আদালতে দণ্ডিত হয়েছিলেন।
আমরা উল্লিখিত নিবন্ধে লিখেছিলাম, ‘এখন আমাদের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করতে গিয়ে এই ৭৫২ জনের বৃত্তান্ত জানতে হবে। এই উপাখ্যান আজও অপ্রকাশিত ও অনালোচিত। ’ পঁচাত্তরে সায়েমের বিতর্কিত কাজগুলোর পেছনে যদি জেনারেল জিয়ার হাত থাকে, তাহলে দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের জেলে রাখার সিদ্ধান্তের পেছনেও জিয়াউর রহমানের হাত ছিল বলে ধরে নিতে হবে।
অন্তত বিএনপির মুক্তিযুদ্ধপন্থী অংশটি এই বিষয়ের ফায়দা নিতে পারে।
দণ্ডিতরা যাতে বের না হতে পারেন, সে জন্য বাতিল আইনে বলা হয়, ‘যারা দালাল আইনে ইতিমধ্যে দণ্ডিত হয়েছে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে আপিল করেছে, তাদের ক্ষেত্রে এই বাতিল অধ্যাদেশ প্রযোজ্য হবে না। ’
এমনকি সেখানে নির্দিষ্টভাবে ১৮৯৭ সালের জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্টের ছয় দফা দিয়ে পোক্ত রক্ষাকবচ সৃষ্টি করা হয়েছে। এর অর্থ হলো, দালাল আইনে দণ্ডিতদের ক্ষেত্রে বাতিল আইন এমনভাবে প্রযোজ্য হবে, যাতে ধরে নিতে হবে বাতিল আইন কখনো জারিই করা হয়নি। আর বাস্তবে আমরা কী দেখি? মিডিয়ায় কি এসব ছাপা হয়?
এটা একটা মস্ত বড় প্রহসন।
আওয়ামী লীগ ঢালাও সমালোচনা করে। বিএনপি হজম করে। গতকাল ফোন করি মেজর হাফিজকে। কেন আপনারা হজম করেন? বললেন, ‘আমি তো জানতাম না। ’ বলি, কেন বলেন না যে জিয়াউর রহমান যদি ছেড়ে দিয়ে ভুল করেন, তাহলে আওয়ামী লীগ তা শুধরে নিচ্ছে না কেন? দণ্ডিতরা কী করে জেল থেকে বেরোল, সেটা তারা তদন্ত করছে না কেন?
মতিয়া চৌধুরী বিবিসিকে বললেন, আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেনি।
কারণ, তখন তাদের দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা ছিল না। এটা নাকচ না করেও বলা যায়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগের দণ্ডিতদের খুঁজে বের করতে সরকারে থাকাই যথেষ্ট ছিল।
শাহবাগের আন্দোলনকারী জনতাকে বলি, আপনারা এ ব্যাপারেও সরকারকে চাপ দিন। আইন ও সংবিধানসম্মত দাবি তুলুন। আইন, আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা মানাসাপেক্ষ দাবিগুলো সামনে আনুন, যা নিয়ে বাড়ি ফিরেও আন্দোলন চালাতে পারবেন।
আওয়াজ তুলুন: দণ্ডিত ওই ৭৫২ জন কে কীভাবে মুক্ত বলে গণ্য হলেন? কারাগার থেকে কে কীভাবে বেরিয়ে গেলেন? ঢাকা ল রিপোর্ট ডিএলআরের পাতা উল্টান। সুপ্রিম কোর্টের মহাফেজখানায় যান, এ-সংক্রান্ত বহু রায় এবং নথিপত্রের হদিস পাবেন। আমরা প্রায় ৩০ দণ্ডিত রাজাকারের আমলানামা দেখলাম। এর কোথাও চোখে পড়েনি যে উচ্চ আদালত কাউকে বেকসুর খালাস দিয়েছিলেন।
তাহলে তাঁরা কে কোথায় আছেন, তা খুঁজে বের করা দরকার।
১৯৭২ সালের দালাল আইনটি পুনরায় সংবিধানে প্রতিস্থাপন করেছে বর্তমান সরকার। তাহলে সেই আইনে দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের জেলে ভরতে বাধা কোথায়? চলমান আন্দোলনের সঙ্গে এই দাবিও যুক্ত হতে পারে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
আগের দণ্ডিত রাজাকারদেরও খুঁজে বের করুন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।