আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাঙ্গামাটি ভ্রমণ: পূর্বাপরকথা

আদর্শটাকে আপাতত তালাবন্ধ করে রেখেছি
পাহাড় থেকে তোলা কাপ্তাই লেকের ছবি বাংলাদেশের যে কয়জন মানুষকে মাঝে মাঝে হিংসা করি বিপ্লবদা, আমাদের বিপ্লব রহমান, তাঁদের একজন। সেই পাকিস্তান আমল থেকে এখন পর্যন্ত নানা ধরনের উপায় বা কৌশল বের করে, মস্তিষ্কের সকল উর্বরতা খরচ করে ক্ষুদ্রজাতিসত্ত্বা ও বাঙালিদের পরস্পরের কাছ থেকে পৃথক করা হয়েছে। শুধু পৃথকই নয়, শত্রু পর্যন্ত বানানো হয়েছে। পার্বত্য শান্তিচুক্তি হওয়ার পর ক্ষুদ্রজাতিসত্ত্বাগুলোর অধিকাংশের সাথে শত্রুতা দূর করা গেলেও একটা অংশের সাথে বৈরিতা এখনও রয়ে গেছে। এসব শত্রুতার পেছনে দোষ কাদের, কোথায় কোথায় সমস্যা ছিলো সেই আলোচনায় যাচ্ছি না- তবে রাঙ্গামাটি শহরে গিয়ে অপরিচিত একজন মানুষের মুখে যখন বিপ্লবদার নাম ও প্রশংসা শুনি, তখন গর্বই হয়।

শিক্ষিত আদিবাসি সমাজের একটি অংশ যেখানে এখনও গড়পড়তা বাঙালিদের সম্পর্কে বিরূপ ধারণা করে; শান্তিচুক্তিকে একনিষ্ঠভাবে সমর্থন করলেও যখন কালচারাল দিক দিয়ে বাঙালিদের হুমকি মনে করে, মনোজগতে বাঙালিদের প্রতি অবিশ্বাসটা থেকেই যায়, তখন বিপ্লবদার প্রতি তাঁদের বিশ্বাস ও ভালোবাসা আমাকে হিংসায়িত না করে পারে না। পাহাড়ি আদিবাসি ও বাঙালিদের পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভালোবাসা যখন দ্বিমুখী ও সর্বজনীন হবে, একমাত্র তখনই এই হিংসাটা থাকবে না। ২. ঈদে বাড়ি যাওয়া নিয়ে সচলায়তনে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম। বড় ছুটিতে আমরা সবাই দলবেঁধে ঢাকা থেকে বাড়িতে যাই, সেখানে গিয়ে ছুটি উপভোগ করি। এমনিতেই আমাদের দেশের পরিবহন ব্যবস্থা খুব একটা সুবিধার না; ঈদ বা এরকম বড় ছুটিতে সবাই একসাথে ঢাকার বাইরে গেলে সেই ব্যবস্থার উপর মারাত্মক চাপ পড়ে।

এ অবস্থায় অ্যাকসিডেন্ট স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হয়, সিট পেতে ভোগান্তি হয়, এছাড়া নানা ঝুটঝামেলা তো আছেই। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, এই আসা-যাওয়াটা দ্বিমুখী হওয়া উচিত। যাদের সামর্থ্য বা সুবিধা আছে, তাঁরা তাদের বাবা-মা বা পরিবারের অন্য সদস্যদের ঢাকায় নিয়ে আসতে পারেন, কিংবা কোথাও বেড়াতে যেতে পারেন। পর্যটক হিসেবে আমাদের তেমন একটা সুনাম নেই। এই সুযোগে অভ্যন্তরীণ পর্যটন শিল্পটাকেও বিকশিত করা যেতে পারে।

আজকাল অবশ্য এ ধারাটা আস্তে আস্তে বদলাচ্ছে। কক্সবাজার-বান্দরবানে তো শুনলাম এবার প্রচুর ভিড় হয়েছে। তার মানে মানুষজনের একটা অংশ বড় ছুটিছাটায় বাড়ি না গিয়ে ঘুরতে বেরুচ্ছে। আমার কাছে এটাকে ভালো লক্ষণ বলেই মনে হয়। তবে অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো বেশ কিছু জায়গা থাকলেও আমরা অধিকাংশই ছুটি কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন বা বান্দরবানের মতো জায়গাগুলোতে।

ফলে যে উদ্দেশ্যে বেড়ানো, সেটা অনেকক্ষেত্রেই ব্যাহত হয়। এমনকি বেড়ানোটাতেও তখন আস্তে আস্তে ভোগান্তির উপাদানগুলো যুক্ত হতে থাকে। ঈদের বন্ধে অন্যদের মতো আমিও বাড়ি যাই, প্রতিবারই নানান যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে। গত কুরবানির ঈদে বাড়ি যাওয়ার সময় মাত্র ২০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে আমাকে ১৭ ঘণ্টা বাসে বসে থাকতে হয়েছিলো। টেলিভিশনে দেখি অনেকেই বলেন, তারা বাড়ি গিয়ে প্রিয়জনদের মুখ দেখে রাস্তার সব কষ্ট ভুলে যান।

আমার পক্ষে সেটা সম্ভব না। যে কষ্ট সহ্য করতে হয়, বাড়িতে গিয়ে প্রিয়জনদের মুখ দেখে সেই কষ্ট ও যন্ত্রণাগুলো ভুলে যাওয়ার মতো মহামানব হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। তাই সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ঈদের সময় আর বাড়ি যাবো না। প্রয়োজনে ঈদের আগে বা পরে যাবো, কিন্তু এই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারবো না। এতে কিছু জিনিস মিস করবো হয়তো, বন্ধুবান্ধব যাদের সাথে ঈদের সময় ছাড়া দেখা হয় না, তাদের সাথে দেখা হবে না; ঈদ উপলক্ষে নানা আয়োজন হয়, সেগুলো মিস করবো- সবচেয়ে বড় কথা, ঈদে দলবেধে বাড়ি যাওয়ার মতো একটা ট্র্যাডিশনকে মিস করবো।

ফলে সিদ্ধান্ত নিলাম, ঈদের ছুটিতে অন্য কোথাও ঘুরতে যাবো। সিনিয়র এক বন্ধুর সাথে মিলে পরামর্শ করলাম রাঙ্গামাটি যাওয়ার। কক্সবাজার ও বান্দরবানে প্রচুর ভিড় হয়, এ সময় সেখানে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। এর আগে লাউয়াছড়া যাওয়ার একটা প্রোগ্রাম ছিলো, সেটা ক্যানসেল হয়েছে। তাছাড়া এর আগে কখনও রাঙ্গামাটি না যাওয়ায় আমার বন্ধুরও বেশ উৎসাহ ছিলো।

ফলে পনের দিন আগেই টিকিট করে, হোটেল রুম বুক করে রাখা হয়। ৩. আমি ঘুরতে ভালোবাসি। কেন? জানি না। কোথাও থেকে ঘুরে আসার পর বেশ খানিকটা নির্ভার হই। তাছাড়া আত্মপ্রেমে মগ্ন থাকায় দিনে দিনে নাগরিক হয়ে উঠছি কেবল, ঘুরতে গেলে টের পাই নাগরিকতার বাইরেও একটা জীবন আছে- যে জীবনে জন্ম হয়েছিলো আমার।

সুতরাং ঘুরতে যাওয়ার কোনো সুযোগ আমি সহজে মিস করি না, বরং নানা ছুতোয় উপলক্ষ তৈরি করি। রাঙ্গামাটি আমার তেমনই একটা উপলক্ষের শিকার। ৪. পাহাড়ের প্রতি আমার খুব একটা আগ্রহ ছিলো না। ছোটবেলা থেকে এক ধরনের ভয় নিয়েই বেড়ে উঠছিলাম। গারো পাহাড় থেকে পড়ে মানুষ মারা গিয়েছে শুনে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম একবার।

পাহাড়ে শান্তিবাহিনীর সাথে সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের খবর শুনতে শুনতে বড় হয়েছি; জেনেছি পার্বত্য চট্টগ্রামের কথা, পাহাড়ি আদিবাসিদের জীবনাচরণ ও বঞ্চনার কথা। কোনো এক বিকেলে সাবেক প্রেমিকার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ হওয়ার পর নানান কিছু ভাবতে ভাবতে একটা পাহাড়ের কথাও ভাবছিলাম- চূড়ায় একা একটা ঘর বেধে বাকি জীবনটা পার করে দিতে পারবো। বিরহজনিত সেই ভাবনা বেশিদিন টিকে নি, তবে একটা পাহাড় কেনার স্বপ্ন তৈরি হয় মনে। এর কিছুদিন পর দৈনিক সমকালের সাহিত্য পত্রিকা কালের খেয়ার তৎকালীন সম্পাদক শহীদুল ইসলাম রিপন (এখন বোধহয় একুশে টিভিতে আছেন) কী কারণে যেন আমাকে একটা পাহাড় কিনে দেওয়ার কথা নিজে থেকেই বলেন। সেটা আর হয় নি, রিপন ভাইয়ের সাথে সম্পর্কের সরলতা থাকে নি, কিন্তু পাহাড় কেনার ইচ্ছেটাকে তিনি আমার মধ্যে স্থায়ী করে দিয়ে গেছেন।

এর কিছুদিন পরই বেরিয়ে পড়ি পাহাড়ে, বান্দরবানে। অসম্ভব মুগ্ধতায় তখন আবিষ্কার করেছি- পাহাড়কে স্পর্শ করা যায়, কিন্তু এর বিশালতায় নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া যায় না। ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য বিশালতার একটা ছায়া আমার দরকার ছিলো তখন। আর এভাবেই শুরু হলো পাহাড়ের প্রতি আমার ভালোবাসার ক্ষণগুলো... (চলবে)
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।