আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রবাসের ঈদ, ঈদের পরবাস



প্রবাসের ঈদ, ঈদের পরবাস ফকির ইলিয়াস =============================== প্রবাসে ঈদের আনন্দ মানেই হচ্ছে এক ধরনের তীব্র শূন্যতা। কথাটি সব প্রবাসীই স্বীকার করবেন একবাক্যে। তার কারণ হচ্ছে, ঈদের দিনটি এলেই এক ধরনের নস্টালজিয়া মনটাকে ভারি করে তোলে। ফেলে আসা সেই শহর, সেই আড্ডা, সেই মধুর স্মৃতি, মা-মাতৃভূমির টান বুকের পাঁজরে দোল খেয়ে যায়। আহা! সোনার আলোয় ভরা সেই দিনগুলো ...।

প্রবাসে ঈদের অভিজ্ঞতা আমার প্রায় আড়াই যুগের। বিদেশের বিভিন্ন দেশে ঈদ করতে গিয়ে যে সত্যটি খুব ঘনিষ্ঠভাবে প্রত্যক্ষ করেছি তা হচ্ছে, প্রবাসে একজন বাঙালির অপর বাঙালির ঘনিষ্ঠ স্বজন। তা পরিচিত হোক অথবা অপরিচিত। বিদেশে আমার প্রথম ঈদের অভিজ্ঞতা স্থির রেখেছে বেদনা ভারাক্রান্ত মনে। মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে ঈদের আনন্দই আলাদা।

পবিত্র রমজান মাস এলেই রোজার আমেজে মেতে ওঠে পুরো নগরী। ধর্মপ্রাণ মানুষের উপাসনা, ইফতারির বাহারি আয়োজন সৃষ্টি করে একটি ভাবগম্ভীর পরিবেশের। ঢাকা , দুবাই কিংবা দোহা’র মতো শহরগুলোতে রমজানের বিকালের প্রতিটি দিনই যেন হয়ে ওঠে উৎসবের দিন। তারপর আসে ঈদ। ঈদের বাজার।

আনন্দের সেই প্রতীক্ষিত দিন। ইউরোপ-আমেরিকায় সেই আবহের ভিন্নতা স্পষ্ট। তার কারণ হচ্ছে, এখানে ঈদ একটি সম্প্রদায়ের উৎসব। আমেরিকায় ঈদ করতে গিয়ে সেই শূন্যতা আরও তীব্রভাবে অনুভব করেছি । ‘ব্যাচেলর’ জীবনে প্রবাসে ঈদ মানে নিজে রান্না করে খাওয়া।

নামাজ আদায় করে এসে আহার পর্ব সেরেই হয়তো ঘুম­ না হয় আড্ডা দেয়া। অবশ্য এই ধকল থেকে মুক্তি পেতে আমি পরপর ক’বছর দেশে চলে যেতাম রমজানের শেষ সপ্তাহেই। আবার বিদেশে ফিরে আসতাম ঈদুল আজহার পর। প্রিয়তমা স্ত্রী এবং বড় মেয়েকে নিয়ে প্রবাসে একটি ঈদ উৎসব হয়, আমার , যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে। সিলেটী জামাইদের বিশেষ একটি কদর আছে প্রবাসে।

সে সত্যটি প্রথম অনুধাবন করতে পারি লন্ডনে স্ত্রী-কন্যাসহ এসে। প্রথম দু’সপ্তাহ ঈদের দাওয়াত খেতে খেতেই চলে যায় আমার সেবার। লন্ডনে বাঙালিদের অভিবাসন গড়ে উঠেছে প্রায় পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে। সে হিসেবে লন্ডনে ঈদ করতে গিয়ে স্বদেশের অভাব সামান্য হলেও পূরণ হওয়া সম্ভব­ তা অস্বীকার করার উপায় নেই এখন আর। মনে পড়ছে, সে বছর লন্ডনে ঈদ উপলক্ষে টেমস নদীতে একটি নৌবিহারের আয়োজন করা হয়েছিল ফ্যামিলি গেট টুগেদার হিসেবে।

সপরিবারে নিউইয়র্কে স্খায়ী নিবাস গড়ার পর এই নগরীটি গড়ে উঠেছে আমাদের দ্বিতীয় নিবাস। নিউইয়র্কে ক্রমবর্ধমান বাঙালি অভিবাসনের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ধর্মীয় কালচারও। সিলেটের জিন্দাবাজার কিংবা ঢাকার নবাবপুর রোডের স্টাইলে এখানে এখন তৈরি হচ্ছে ইফতারি। ভারতীয়-বাংলাদেশী বিপণি বিতানগুলো ঈদ উপলক্ষে সজ্জিত হচ্ছে আলোকসজ্জায়। জমজমাট ঈদের বাজার।

নিউইয়র্কের বাঙালি পোশাক বিক্রেতারা পণ্য ক্রয়ে ছুটে যাচ্ছেন বোম্বেতে। দশ হাজার ডলারের লেহেঙ্গার সংবাদ নিয়েও সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে বাংলা সাপ্তাহিকের পাতায়। যুক্তরাষ্ট্রে ঈদ নিয়ে প্রধান দু:খবোধটি হচ্ছে একই দিনে ঈদ করতে না পারা। চাঁদ দেখার মারপ্যাঁচে বাঙালি উলামারা প্রতি বছর দু’দিনে রোজা শুরু করেন। ঈদও করেন দু’দিনে।

নিউইয়র্কের স্কুল-কলেজগুলোতে এখন হাজার হাজার বাঙালি অভিবাসী শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে। মুসলমানরা দু’দিনে ঈদ করার কারণে পাবলিক স্কুলগুলো ছুটি মঞ্জুর করতে নানা প্রশ্ন করছে। বোর্ড অব এডুকেশনও এ নিয়ে নানা প্রশ্নের অবতারণা করেছে ইতিমধ্যেই। ধর্মীয় তমদ্দুন, কালচার চর্চায়ও যে কর্তৃত্ব খাটানো যায়, তাই প্রমাণ করেছেন মুসলমান উলামারা প্রবাসে। চাঁদ দেখা নিয়ে মতৈক্যে পৌঁছতে পারেন না তারা কোনবারই।

অথচ যুক্তরাষ্ট্রের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট বলে দিতে পারেন চাঁদ কোথায়, কখন জন্ম নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে এর জন্মক্ষণ, সময়, তারিখ ইত্যাদি। এসবে বিশ্বাস নেই মুসলমান ওলামাদের। তাই প্রতি বছরই বিতর্ক হয়। বিভক্তি হয়।

দু’দিনে অনুষ্ঠিত হয় ঈদের নামাজ। ঈদে , প্রবাসের অনেক সংগঠনই বাংলাদেশে দুঃস্থদের মাঝে উপহার বিতরনের ব্যবস্থা করেন। সংহতি প্রকাশ করেন মানবতার প্রতি। গেল কবছর থেকেই ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউসে ইফতার পার্টির আয়োজন হচ্ছে। এবছরও বাহারী ইফতার পার্টি দিয়েছেন প্রসিডেন্ট বারাক ওবামা।

এই আয়োজন খুবই আশাব্যন্জক। প্রবাসে তরুণ প্রজন্মের মাঝে ঈদের আনন্দ মূলতঃ আমাদের ধর্মীয়,জাতীয় ঐতিহ্যের শিকড়ই বপন করে যাচ্ছে। এই চেতনা ধরে রাখতে সকল অভিবাবককেই সচেষ্ট হতে হবে। আবারও বলি, সংসার, স্বজন নিয়ে নিউইয়র্কের অভিবাস জীবনে ঈদ কেটে যায়। যে শিশু যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নিয়েছে­ এটাই তার জন্মভূমি।

কিন্তু আমারও একটি জন্মভূমি ছিল। ছিল সবুজ ছায়া ঘেরা পথ ধরে আমার হেঁটে যাওয়ার স্মৃতি। আমার শৈশব রোমন্থন। ঈদ আসে। মাকে মনে পড়ে।

মাতৃভূমিকে মনে পড়ে। মনে হয়, ওই মাটির কাছে আমার ঋণ অনেক। পারিনি, কিছুই শোধ করতে পারিনি। # ---------------------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ। ঢাকা ।

২০ সেপ্টেম্বর ২০০৯ রোববার প্রকাশিত

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।