আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পল্টন, বই কেনা আর আমার মার্ক টোয়েন হবার গল্প

...ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাচিয়া,সদাই ভাবনা, যা কিছু পায়, হারায়ে যায়, না মানে স্বান্তনা...
ছোটবেলা থেকেই আমার প্রিয় শখ গুলোর একটা হলো বই পড়া। তাই বলে আমাকে জ্ঞানের সমুদ্র ভাবলে ভুল হবে। আমার আগ্রহ ছিলো সব রকমের গল্পের বইতে। তিন গোয়েন্দা, ফেলুদা, টেনিদা, কাকাবাবু, টিনটিন এমনকি চাচা চৌধুরী পর্যন্ত। দিনের বেশীর ভাগ সময় কাটতো তাই ফেলুদা তোপসের সাথে মগনলালের পিছনে তাড়া করে, না হলে কিশোর পাশার সাথে গোলমেলে ঘড়ির রহস্য ভেদ করে।

বই পড়ার পাশাপাশি আর একটা শখ ছিলো, সেটা হলো বই জমানো। স্কুলে পড়ি, এতো বই কেনার টাকা কই পাবো? তাই একমাত্র সম্বল ছিলো পুরোনো বই কেনা। ঢাকার পুরানা পল্টন, নীলক্ষেত আর সদরঘাটে পুরোনো বই পাওয়া যায়। টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে কিংবা রিক্সাভাড়ার টাকা বাঁচিয়ে তাই প্রতি সপ্তাহে চলে যেতাম এসব জায়গায়। পুরনা পল্টনটা বাসার কাছে হওয়াতে এখানটাতেই বেশী যাওয়া হতো।

একবারের কথা বলি। তখন ক্লাশ এইটে পড়ি। বেশ কিছু টাকা জমিয়েছি। আমাদের বাসা তখন ফকিরেপুল এলাকায়। অসহযোগ আন্দোলন চলছে।

বিএনপি বিরোধী দল ছাড়াই একা নির্বাচন করে সংসদে বসেছে। আর বিরোধী দল সব এক হয়ে জ্বালাও পোড়াও করছে। দৈনিক বাংলায় প্রতিদিন টিয়ার গ্যাস ছোড়া হচ্ছে আর আমরা বাসায় বসে হাঁপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে টিভি দেখছি। কারন স্কুল কলেজ সব বন্ধ। এর মাঝে একদিন মনে হলো সব কিছু শান্ত।

মিছিল টিছিল নাই। তাই জমানো টাকা নিয়ে রওনা হলাম পুরনা পল্টনের বইয়ের ডিপোতে। আমার সাথে সবসময়ই কোন না কোন বন্ধু জুটে যেতো। সব ক্লাশেই আমার সাথে চলার জন্য একজন খুব ভালো বন্ধু থাকতো। ক্লাশ এইটে ছিলো তারেক।

আমি বাসা থেকে বের হয়ে তারেককে নিয়ে হেটে চলে এলাম পুরনা পল্টনে। এই বই দেখি সেই বই দেখি। খুব হিসাব করে কয়েকটা বই কিনলাম। সব মিলিয়ে জমিয়েছি পঞ্চাশ টাকা। দরাদরি করে পাঁচটার মতো বই পাওয়া যাবে।

তাই খুব হিসাব করে কিনতে হবে। বই খুঁজতে খুঁজতে তোপখানার মোড় পর্যন্ত চলে এসেছি। খুব কাছ দিয়ে কয়েকটা মিছিল গেলো। খালেদার চামড়া তুলে নেবো আমরা টাইপের শ্লোগান দিতে দিতে। তখন সব মিছিলেরই এটা একটা কমন শ্লোগান।

খালেদা আর হাসিনার চামড়ার গুনগত মান মনে হয় খুব ভালো। কেননা সব সময় দেখি এদের চামড়া তোলার জন্য সবাই খুব উৎসুক থাকে। যদিও সেই চামড়া তোলার পর সেটা দিয়ে ঠিক কি করা হবে সে বিষয়ে কিছুই বলা হয় না। মিছিল খুব একটা স্বাভবিক ব্যাপার তখন। তোপখানার কাছাকাছি একটা দোকানে পৌছানোর পর দেখি একটা হুড়াহুড়ি লাগলো।

দোকানদার চিৎকার করে বললো ভাইজান ভাগেন। আমি কিছুই বুঝলাম না। পায়ের কাছে সিলিন্ডার টাইপ কিছু একটা এসে পড়লো। সেখান থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। আমি পেছন ফিরে দিলাম দৌড়।

আশে পাশে সবাই দেখলাম দৌড়ুচ্ছে। তারেক খুব লম্বা। সে দৌড়ে আমাকে ছাড়িয়ে গেলো। রাস্তার উপর বই পত্র সব ছড়াছড়ি। তরমুজের কিছু দোকান ছিলো।

সব লন্ড ভন্ড। রাস্তা ভর্তি তরমুজ পড়ে আছে। পেছনে গুলির শব্দ। আমি তখনো দৌড়াচ্ছি। কোন পথ থেকে কোন পথে গেছি জানি না।

এক সময় দেখলাম আমি মতিঝিল পৌঁছে গেছি। আশে পাশে কোথাও তারেককে খুঁজে পেলাম না। পড়ে অবশ্য জেনেছিলাম সে একটা দোকানে মধ্যে লুকিয়ে ছিলো। আর আমি মতিঝিলের মোড়ে টেনিদা সমগ্র নিয়ে দাড়িয়ে রইলাম। সেদিনের পর পুরো ঢাকায় কারফিউ জারি করা হয়েছিলো অনির্দিষ্ট দিনের জন্য।

তাতে আমার কি? আমি ঘরে বসে তখন আয়েস করে টেনিদা সমগ্র পড়ছি। পুরনা পল্টন নিয়ে আর একটা ঘটনা বলি। ক্লাশের বই পড়ার ব্যাপারে আমার বরাবরই অনিচ্ছা। তবে পাঠ্যবইয়ের একটা লাইন খুবই মনে ধরলো। বই চুরি করা নাকি ঠিক চুরি করা নয়।

মার্ক টোয়েন নামে এক বিশাল বড় মানুষ সেটা বলে গিয়েছেন। এই লাইনটা পড়ে আমার মাথায় ঢুকলো, তাহলে তো আমি বই চুরি করলে কোন সমস্যা নাই। আমি তো চাইলেই পুরনা পল্টন থেকে একটা দুইটা বই গাপ করে দিতে পারি। যেই বুদ্ধি সেই কাজ। তখন ক্লাশ নাইনে পড়ি।

আমার সাথে সবসময় থাকে মাসুম। তো আমি মাসুমকে নিয়ে একদফা পুরনা পল্টন ঘুরে এলাম। আর চুরি করে নিয়ে নিয়ে এলাম তিনটা বই। বন্ধু মহলে তখন আমরা পুরা হিরো। একবার চুরি করে সাহস বেড়ে গেলো।

দু’দিন পর আবার গেলাম। এবার আরো বেশী বেপরোয়া। একটা বই কিনি তো তিনটা চুরি করি। কিছু বই মাসুমের হাতে চালান করে দিয়ে আমি মাত্র টিনটিনের একটা বই নিজের কেনা বইয়ের ফাঁকে চালান করতে যাবো এমন সময় পাশের দোকানী ছুটে এলো। কাহিনী হলো, পাশের দোকান থেকে মাত্র ফেলুদার যত কান্ড কাঠমুন্ডুতে বইটা চুরি করে মাসুমকে দিয়েছে আর সে সেটা একদম বাইরে রেখে ঐ দোকানীর সামনেই দাড়িয়ে আছে।

দোকানী তো বিশাল চিৎকার চেচামেচি জুড়ে দিলো। আমরা নাকি তার স্টল থেকে বই চুরি করেছি। কাহিনী তো সত্যই। এখন কি করি। আশে পাশে লোক জমে গেলো।

আমি গলা উচিয়ে বলা শুরু করলাম ‘মোটেও না। আমি এই বই চাচামিয়ার কাছে থেকে কিনেছি। ‘ ঐখানে এক চাচা মিয়া ছিলো। তার কাছ থেকে আমি অনেক বই কিনতাম। তাই বলে দিলাম তার নাম।

দোকানী তো বিশ্বাসই করে না। বললো, ‘চলেন তাইলে চাচা মিয়ার কাছে। ‘ আমার হাত ধরে টেনে সে চাচামিয়ার দোকানে নিয়ে গেলো। আমার কপাল এমনই খারাপ যে সেই দিন চাচা মিয়া দোকানই খুলে নি। ব্যাস পুরা হাতে নাতে ধরা।

আমার একটা সমস্যা হলো বিপদে পড়লে মাথা গরম হয়ে যায়। আর চিৎকার শুরু করি। আমি তখন বললাম আমি এই বই নীলক্ষেত থেকে কিনে এনেছি। দোকানীরা কিছুতেই বিশ্বাস করবে না। তোপখানার মোড়ে মোটামুটি একটা বিশাল ভিড় লেগে গেলো।

আমি আঁড় চোখে দেখলাম তিনজন পুলিশ আসছে। মাসুমের দেখলাম মুখ টুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে। আমি জোড় চিৎকার করা শুরু করলাম। এই দোকানী একটা পুরান বই আমাকে গছাতে চেয়েছিলো । আমি নেই নি বলে সে আমার নামে মিথ্যা বলছে।

এই কাহিনী বানালাম। যদিও কাহিনীটা নিজের কাছেই রুপকথার গল্প মনে হলো। এর মাঝে ভীড়ের মধ্যে এক কম বয়সী দেখলাম আমার পক্ষ নিলো। মনে হয় ইউনিভার্সিটিতি পড়ে। সেও বলতে শুরু করলো ।

‘আসলেই এই সব দোকানদারদের কোন নীতি নাই। এরা ছোট ছোট পোলাপারনদের কাছে বেশী দামে বই বেঁচে। ‘ ইত্যাদি ইত্যাদী। আমি তো হাতে চাঁদ পেলাম। আমার চিৎকার আরো বেড়ে গেলো।

এই দোকানী আগে কোনদিন আমাকে ঠকিয়েছে, আগে কোনদিন আমোকে ছেড়া বই দিয়েছে সব ফিরিস্তি শুরু করলাম উৎসাহ পেয়ে। ভীড়ের মাঝে দেখলাম জনমতও আমার পক্ষে আসছে। অবশেষে সবাই মিলে দোকানদারকে খুব বকাঝকা করলো। আমার তখন খারাপ লাগা শুরু হলো। কিন্তু তখন আর কিই ই বা করতে পারি।

ডজন খানেক চুরি করা বই আর মনের মাঝে তীব্র অপরাধ বোধ নিয়ে ফিরে এলাম ঘরে। এরপর যতবারই পল্টনের ঐ জায়গাটা দিয়ে গেছি মাথা সেই দোকানদার কে খোঁজার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পাই নি। যদি কোনদিন পাই অবশ্যই তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবো। হোক না দশ টাকার বই।

হোক না তখন আমি ছোট মানুষ। কিন্তু আমি তারকাছে দশ হাজারগুণ ছোট হয়ে গেছি মানুষ হিসেবে। মার্ক টোয়েনের কথা মনে হয় সবসময় সত্যি নয়।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.