এডিট করুন
তখন অনেক ছোট। প্রতি বৃহস্পতিবার (সম্ভবত) আমাদের এলাকা ছাইড়া কিছুটা দূরে, সখীপুরে হাট বসত। পুরা গ্রাম্য হাটের চেহারা পাওয়া যাইত সেখানে। আমি বাপের সাথে যাইতাম। পুরা সপ্তাহের কিছু কিছু বাজার কইরা নিয়া আসত বাবা।
আমি সঙ্গী হিসাবে যাইতাম। মাঝে মাঝে আমাদের ক্ষেতের ধান, বাদাম ইত্যাদি বিক্রি করতে যাইতাম। সারা মাঠ ভরা কালিজিরা ধানের সৌন্দর্য যে দেখছে সে জানে ইহা কি বস্তু। ধান কাইটা গরুর গাড়ী ভইরা ধান নিয়া আসা হইত আমাদের কারখানায়। একতলা উচা ধানের গাদার উপর বইসা আসতাম।
মজাই ছিল আলাদা। মাঝে মাঝে শিলা বৃষ্টি পইড়া ধানে চিটা লাইগা যাইত। সেইবার লস যাইত। ধানের চিটা এক মারাত্মক জিনিস। খেড় ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না।
পুরা মাথায় হাত অবস্থা। আবার কখনও বাদাম হইত ক্ষেতে। বাদাম ক্ষেতের গন্ধ আমার বিশেষ পছন্দ। বাদাম ভর্তাও আমার অতি প্রিয়। মারে যদি বলতাম, মা বাদাম ভর্তা খামু তবে কইত, বাদাম ছিলা দে।
লোভে পইড়া, বাদাম ছিলার মত কষ্টকর কাজও করতাম। একগাদা বাদাম ছিলতাম, যাতে বেশী কইরা ভর্তা হয়। কিন্তু মা সামান্য ভর্তা বানাইয়া দিত আর কইত, পেট ব্যাথা করব। গুল্লি মারি পেট ব্যাথার, চিল্লাফাল্লা করতাম, তবুও মার মন গলত না। বাদাম ভর্তার সাথে আরেকটা ভর্তা আমার বিশেষ প্রিয়।
সেইটা হইল কালীজিরা ভর্তা। পাটায় ভর্তা বাইটা বানানির পর পাটায় লাইগা থাকা অংশটুকু ভাত দিয়া মাখাইয়া খাইতে সবচেয়ে বেশী মজা। এইটা অবশ্য পাটায় বাটা সব ভর্তার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তো আমি বইসা থাকতাম কখন পাটায় মাখা কালীজিরা ভর্তার ভাতটুকু মা মুখে তুইলা দিব।
ধান আইনা আমাগোর কারখানার বড় চুলায় সিদ্ধ করা হইত।
সিদ্ধ ধানের গন্ধ আমার অতি পরিচিত। সিদ্ধ করার পর কারখানার ছাদে শুকাইতে দেওয়া হইত আরেকবার। মা, কাজের লোকরা পা দিয়া মাঝে মাঝে ধান নাড়াইয়া দিত। আমিও শখের বসে পা চালাইতাম ধানের মধ্যে। ফলে ধান সব উলটা পালটা হইয়া এইদিক ঐদিক ছড়াইয়া পড়ত।
কামের থিকা আকাম হইত বেশী। তা ধান শুকানির পর ছালায় ভরা হইত ধান। ছালা বা বস্তা আছিল দুই রকমের। পাটের ছালাই আছিল বেশী। আর কিছু আছিল প্লাষ্টিকের ছালা।
ঐগুলা ছিল আসলে ফ্যাক্টরীর জন্য আনা চিনির বস্তা। বস্তা ভইরা অটোরিক্সা ভাড়া কইরা ধান নিয়া যাওয়া হইত সখীপুরের হাটে। বেপারীর কাছে মনদরে বিক্রি করা হইত। আমার বাপে কয়, আমি নাকি হাটে গিয়া তিন ব্যাকা দিয়া খাড়াইয়া থাকতাম। পুরাই বেক্কল আছিলাম।
হাটে বাপে একদিকে ধান বেচত তার কর্মচারীগোরে নিয়া, আরেকদিকে আমি থাকতাম হাট ঘুইরা দেখনের ধান্দায়। একটু ফাক পাইলেই বাইর হইয়া যাইতাম। জিলাপী বেচত কয়েক দোকানে। সিঙ্গারা আছিল এক টেকা পিছ। ঝালমুড়ি পাওয়া যাইত, চানাচুর মাখা পাওয়া যাইত, এক টেকায় অনেকগুলা।
আমি বাপের কাছে আবদার ধরতাম এইগুলার কোন একটা কিনা দেওনের লাইগা। বহুত কওয়ার পর কিনা দিত। মাঝে মাঝে গরু ছাগল বিক্রি হয় যেইখানে সেইখানে যাইতাম। কালা কালা ছাগল, হলুদ হলুদ ভেড়া আর কালা, লাল, সাদা, ময়লা সাদা গরুর এক বিশাল বাজার আছিল তহন। তহন সাধারন সাপ্তাহিক হাটে যে পরিমান ছাগল ভেড়া পাওয়া যাইত এহনকার ঈদের হাটেও তা পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ।
কোকাকোলার বোতল আছিল ছয় টেকা না সাত টেকা জানি। এই জিনিসটা আমার ছোটবেলায় আছিল স্বর্গের অমৃতের মতন। বছরে ২৫০ মিলি একটা বা দুইটা কোকের বোতল খাইতে পারতাম কিনা সন্দেহ। আমারে এক বোতল কিনা দিলে আমার ছোটবইনরেও এক বোতল কিনা দিতে হইত। তখনকার দিনে চৌদ্দ টেকা আসলেই বেশী আছিল আমার বাবা মার লিগা।
পানি মিশাইয়া মিশাইয়া কোক খাইতাম। যতটা দীর্ঘায়িত করা যায় আর কি এই অমৃত পান! দেড় দুই ঘন্টা ধইরা ২৫৯ মিলি কোক খাইতাম। হাটে যাওয়ার পিছনে এই কোকের লোভও কাজ করত বৈকি! মাঝে মাঝে বাবা নিজে যাইত না হাটে। কোন কর্মচারীরে পাঠাইয়া দিত জিনিস বিক্রি করার লাইগা। আমিও ওর লগে যাইতাম।
মা কইয়া দিত খেয়াল রাখবি কততে বিক্রি করে। আমি খেয়াল রাখতাম। বেচারারা ধরা খাইত। আমারে মাঝে মাঝে কোক ঘুষ দিত বেচারারা। তাও কাম হইত না।
আমি চুপে চুপে মারে গিয়া সব কইয়া দিতাম। আসলে এক বেক্কইল্লা টাইপের সৎ আছিলাম। চুরি চামারি, বাটপারি করতাম না। এই কারনে পোলাপানে আমারে ক্রিকেট খেলায় সবসময় খাতায় স্কোর লেখতে দিত। বিপক্ষ পক্ষও আমারে দারুন বিশ্বাস করত।
একদিন নিজের দলের নিদারুণ প্ররোচনায় সততা বিসর্জন দিলাম। আর কত সৎ থাকা যায়! ছাইড়া দিলাম স্কোর লেহা।
হাটের আবশ্যকীয় বিষয় হইল এর রোদ। কাঠফাটা রোদ পড়ে। ছাতি একটা আবশ্যকীয় বস্তু।
সেই পুরান আমলের মজবুত কাঠের ডান্ডার কালা কাপড়ের ছাতি। এহনকার লুতুপুতু ফ্যাশনেবল ছাতি না। হেই ছাতি দিয়া এহনকার ছাতিরে এক বাড়ি দিলেই শেষ! "আলমের ১ নং ছাতা। রোদ বৃষ্টিতে সুরক্ষা। "
হাট শেষ করতে করতে বেলা পইড়া যাইত।
সারি বাধা সব কাচা বাজারের দোকানের ডালা গুটানি হইত। গরু লইয়া গরুর ব্যাপারী ভাগা দিত। ধান যেইডি বেচা হইছে তো হইছে, আর বাকীডি নিয়া বাড়ীত ফেরত আইতাম। আমার লাভ আছিল, জিলাপা, মুড়ি, সিঙ্গারা বা এইজাতীয় কিছু একটা। বাসায় আইতে আইতে অন্ধকার নাইমা যাইত।
পা না ধুইয়াই বিছানায় গিয়া শুইয়া পড়তাম। মায়ে টাইনা উঠাইতো, "যা পা ধুইয়া আয়। " সহজ সরল পর্যবেক্ষক জীবন। শুধু দেইখা যাইতাম। অংশগ্রহন করতে ইচ্ছা হইত কিন্তু পারতাম না ছোড ছিলাম বইলা।
এহন আর সেই সুযোগ নাই। হাটের আগের জোশ কইমা গেছে। মাঝে মাঝে আমাগোর এলাকায় সেই ছোটবেলার মত রোদ নামে, দুপুরের দিকে। আমি দেখলেই চিনতে পারি। আমার পরিবেশ স্মৃতি তীব্র।
গন্ধ স্মৃতিও তীব্র। গন্ধ শুকলেই কইতে পারি যে এইডা একটা ফ্লাট বাড়ী আর এইডা একটা কারখানা। তা যহনই সেই পরিবেশ বা রোদ দেহি সোজা রাস্তায় নাইমা যাই। মনে পড়ে ছোটবেলার সেই গান। হাওয়া হাওয়া ও হাওয়া দিস্কো দিওয়ানা, পাতলা পায়খানা......... ( আলী ভাইয়ের লন্ড্রীতে বাজাইতো গানড়া, উনি বেশ ইস্মার্ট আছিলেন, সবসময় ইন করা আর নায়কগোর মত একটা ওয়েষ্ট কোট জাতীয় কিছু পইরা থাকতেন)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।