পড়ি, লিখি ও গান শুনি, আড্ডা দেই..
মা আঁচলের মাঝে পেচিয়ে বুকে জড়িয়ে রেখেছে তার শিশুটিকে। ফ্যালফ্যাল করে কখনো তার মুখের দিকে ,কখনো এদিক সেদিক তাকাচ্ছে । নাওয়া-খাওয়া ফেলে যতক্ষন পাচ্ছে তার সব টুকু সময় দিতে চায় তাকে। বার বার গালে-কপালে চুমো দিয়ে আদর করছে। যেন এটাই হবে শেষ আদর ।
কেউ এসে নিয়ে যাবে তার বুকের মানিক চিরদিনের মতো। তারপর শুন্য কলিজাটা আঁচড়ে মরবে । আবারো বুকফাটা আর্তনাদ চেপে চলবে গুজরান।
এভাবে বার বার বিক্রি হচ্ছে লক্ষির (৩৫) নাড়িছেঁড়া ধন! যাকে প্রায় ১ বছর ধরে নিজের অস্তিত্বের সাথে মিশিয়ে লালন করেছে । অবশ্য ৯ মাস ১০ দিন মায়ের পেটেই ছিল নিরাপদে, আদরে-সোহাগে,বাকিটা সময় হারানোর শঙ্কা নিয়ে বুকে।
পেটে থাকতেই সিদ্ধান্ত হয়ে ছিল মেয়ে হলে বেচে দেয়ার। তবু লক্ষি মনে মনে প্রতিদিন প্রার্থনা করেছে, লুকিয়ে লুকিয়ে উপোস পেটের চাল দু’মুঠো মান্যতও করেছে, যাতে এবার ছেলেই হয়! স্বামীকে কখনো বলার সাহস হয়নি। যদিও স্বামী গজেন (৪৭) আগেই বলে রেখেছে ‘ বেটা (ছেলে) হইলে নেইস, বুড়া কালে তোক দেইখবে। বেটির (মেয়ে) মায়া করিস না, ভালো কোন মানুষ নিবার আসলে দিমো। ভাতে কাপড়ে বাঁচি থাইকপে।
সাথে হামরাও কিছু পামো। ’
নিজের নিয়তির কথা ভেবে স্বামীর কথা মেনে নিয়েছিল লক্ষি। তাই লক্ষি মায়া বাড়াতে চায় নি। কিন্তু মায়ের মন.....। আর কতবার এভাবে বুক খালি হবে তার? কোন প্রতিবাদ করার সাহসও নেই।
এইতো দু’বছর আগে তার আরেক সন্তান চার মাসের বৈশাখীকে মাত্র চারশত টাকা ও একটি শাড়ির বিনিময়ে তুলে দিয়েছিলেন নি:সন্তান নরসুন্দর বাবুলের কাছে। সেবার ও লক্ষি কান্নাকাটি করে, নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলো। কিন্তু স্বামীর হুঙ্কারাদেশে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তুু ভুলে যেতে পারে নি। আজও ঐ বয়সি কোনো শিশুর কান্না শুনলে ছুটে যায় সেদিকে।
নিজের সন্তান ভেবে কোলে তুলে জড়িয়ে ধরে আদর করে। পরে বুঝতে পেরে ছিন্ন আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে ফিরে আসে।
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার চৌবাড়ি পয়রাডাঙ্গা গ্রামে লক্ষির বাড়ি। স্বামী রিক্সাচালক গজেন বর্মন । যিনি অভাবের তাড়নায় আগেই বিক্রি করে দিয়েছেন তার ৩ মেয়েকে।
আবারো জন্ম নেয়া মেয়েশিশুটিকে বিক্রি করতে যাচ্ছেন। মেয়ে সন্তান জন্ম দেয়ায় বার বার সন্তানহারা হয়ে মা লক্ষি প্রায় নির্বাক,বিহ্বল। কিন্তু অভাব আর ছেলে সন্তান প্রত্যাশি স্বামীর মুখের উপর কথা বলার সাহস তার নেই। এইতো দুই দিন আগে তবুও ভয়ে ভয়ে বলেছে, “এই ছাওয়াটা বেচেন না, মুই(আমি) ভিক্ষা করি হইলেও বড় করিম (করব)। ” গজেন গর্জে ওঠে দা দিয়ে কোপাতে গিয়েছে শিশুটিকে।
লক্ষি চিৎকার করে বলেছে ,“মোর ছাওয়ার দরকার নাই, তোমরা বেচে দ্যাও। ”
লক্ষির পূর্বপূরুষেরা ছিল পরাশ্রিত। নানা-নানী, মা সবাই জেলার নেওয়াশী ইউনিয়নে এক ধনী বাড়ীতে কাজের লোক হিসাবেই থাকতেন। সেই বাড়িতেই লক্ষির জন্ম । আর কাজের মধ্যে বেড়ে ওঠা।
তারপর বিয়ে হয় পাশের গ্রামের রিক্সা চালক অমলের সাথে। অমল ঢাকায় রিক্সা চালাতেন। লক্ষি যখন দুই কন্যা সন্তানের মা তখন তার স্বামী ধর্মান্তরিত হয়ে এক মুসলমান নারীকে বিয়ে করেন। মা -বাবা আগেই মারা গেছেন । আর আশ্রয়দাতা পরিবারটি বসবাসের জন্য ভারতে চলে যায়।
সন্তান সহ দাঁড়ানোর কোন স্থান খুঁজে না পেয়ে অবশেষে একটুকরো আশ্রয় ও একটুখানি নিরাপত্তার আশায় গজেন বর্মনকে বিয়ে করেন। গজেনও পেশায় রিক্সাচালক। তার নিজের বসতভিটাও নেই। দুরসস্পর্কের এক আত্মিয়ের বাড়িতে থাকে। লক্ষির নিরাপত্তার ঘরে আশ্রয় মেলেনি তার দুই মেয়ে কল্পনা ও প্রতিমার।
তখন কল্পনার বয়স চার তখন গজেন ধনাই নামের এক ব্যক্তির কাছে বেচে দেন তাকে। প্রতিমা তখন ২ বছরের এক মুসলমান তাকে নিয়ে গেছে। এর বেশী জানে না লক্ষি। কোথায় আছে, কেমন আছে, বেচে আছে না , মরে গেছে কিছুই জানে না।
তাই কোনো অচেনা মানুষ বাড়ির দিকে আসতে দেখলে লক্ষি বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে তার সন্তানকে।
ভাবে, এই বুঝি তার বুক খালি করে দিয়ে যাবে কেউ। এমন অনিবার্য আশঙ্কায় কাটে তার প্রহর। লক্ষির জিরজিরে ছনের ঘরটির বেড়ার ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট ফুটে ওঠে দারিদ্রতার মাত্রা। মায়ের মমতা এ দারিদ্রতার শক্তির কাছে বড় অসহায়। এই মমতা বিক্রি করে তাদের পেটে অন্ন যায় , পরনে বস্ত্র।
তারপর আবারো চলে সন্তান জন্মে র আয়োজন।
লক্ষি বলে, “মুই(আমি) পোড়া কপালী , ভগবান মোক(আমাকে) একটা বেটাও না দিয়া খালি(শুধু) বেটি দেয়। মোর স্বামী বেটি ছাওয়া (সন্তান) চায় না ,তাই বেচে দেয়। মুই দিবার না চাইলে মোকেও তাড়ে (তাড়িয়ে) দিবার চায়। ছাওয়াকো মারি ফেলবার চায়।
গেরামের সবায় মোক পাষাণ কয় , সংসার ছাড়ি যাবার কয় । মোর তো যাবার কোন জাগা নাই, কোটে যাঙ (কোথায় যাব)। ”
গজেনের কাছে জানতে চাইলে বলে, “অভাবের কারনে মুই ছাওয়া অন্য মানুষক দিচোং (দিয়েছি)। কিন্তু বেচি দেং (দেই) নাই, তারা খুশি হয়া যা দিছে তাকে নিচং (নিয়েছি)। হামার পেটে চলে না , বেটি মানুষ করি বিয়ে দিমো কেমন করি?
প্রতিবেশী বাবলু, সুখচরণ, মিনতি , মালঞ্চ সহ অনেকে এসেছেন তার বাড়িতে।
ভেবেছেন হয়তো কিনতে এসেছেন কোন গ্রাহক। তারা সকলে বলেন, গজেন খুব অভাবী মানুষ। লক্ষি নিজের ও মেয়ে দুটির নিরাপত্তার জন্য গজেনকে বিয়ে করেন। কিন্তু বিয়ের পর গজেন মেয়ে দুটিকে বিক্রি করে দেয়। পরে গজেনের ঘরে আবারো একটি মেয়ে হলে তাকেও বিক্রি করেন।
এবারো মেয়ে হওয়ায় বিক্রির চেষ্টা করছে। অনিমেষ গজেনের মামাতো ভাই। তিনি বলেন, “পারলে, কিছু করেন। গজেন খুব তাড়াতাড়ি বচ্চাটাকে বিক্রি করবে বলে ঠিক করেছে। ”
পয়রাডাঙ্গা এলাকার কাউন্সিলর শহিদুল ইসলাম এ ব্যাপারে বলেন,“অভাবের কারনে গজেন তার মেয়ে সন্তানদের বিভিন্ন লোকের হাতে তুলে দিয়েছেন তবে বিক্রি করার ব্যাপারটি তিনি জানেন না।
” তিনি আরো বলেন, “পৌরসভা পরিবারটিকে বিভিন্ন সহযোগিতা করে থাকে। ” এ ব্যাপারে জেলার বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মি রওশন আরা চৌধুরী বলেন,“শুধু অর্থনৈতিক কারণ নয়, গজেনকে মানষিক বিকারগস্থ বলে মনে হয়। ”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।