এক
২১ মার্চ, ২০০৪।
ভোর হতে অনেক দেরী
বড় বোনের ডাকে ঘুম ভাঙে। উঠতে ইচ্ছে করছেনা। আবার যেতে ও হবে। বোনের কড়া হুঙ্কার - যা।
তার মুখের দিকে তাকানো যায় না। আতঙ্ক, ভয়, দু্িশ্চন্তার ছাপ স্পষ্ট।
কী ঘটতে যাচ্ছে মাথায় আসছে না। আজ পরীক্ষা ।
রাত ১২ টায় বাসায় ফিরে পড়তে বসেছিলাম।
ক্লান্ত, অবসন্ন মস্তিষ্ক সহ্য করেনি। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
সিঁড়ি বেয়ে নিচে জানলাম। আজম আলী গেট খুলল। মহা বিরক্ত সে।
গত তিন মাসে রাতে-মাঝরাতে-শেষ রাতে গেট খুলে যচ্ছে। একদিনও বিরক্ত হয়নি। আজ অন্যচিত্র। আজ কিছু ঘটবে জানলে হয়তো এমন করত না। ওর বা দোষ কী! আমিও কী জনতাম!
দুই
রাতের এসময়ের র্যাং কিন স্ট্রীট অনেক নিশ্চুপ।
গাড়ি-ঘোড়া নেই। পুলিশ ফাঁড়ির সামনে দুইজন কনস্টেবল মাত্র। সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে আমার দিকে।
শীতের শেষ। তারপরেও শীত লাগছে।
এ মুহূর্তে রিকশা দরকার। মোবাইল বেজেই চলছে। ছোট-বোনের ফোন। ভারী কণ্ঠে সে যা শুনাল তা আমার চিন্তার মধ্যে ছিল না এতক্ষণ। আমার এখনই যাওয়া উচিত।
পরলে উড়ে উড়ে যাই।
রিকশা পাই না। আজ কোন কিছুই যেন আমার পক্ষে নয়।
দুদিন কোমায় থাকার পর গতকাল বিকেলে জ্ঞান এসেছে বাবার। কথা বলেছেন।
হেসেছেন। আমাদের এক বুক আশা-পূরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবেন বাবা। বাড়ী ফিরে আসবেন। আমাদের ভাই-বোনদের কত পরিকল্পনা-বাবাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ী যাব। দাদা-দাদীর কবর জিয়ারত করার অনেক ইচ্ছে বাবার।
অনেকক্ষণ পরে জয় কালী মন্দির মোড়ে একটি রিকশা পাই।
চলতে থাকে ঢাকা।
সর্বশেষ ডায়ালাইসিস সাকসেসফুল হওয়ার পর দ্বিতীয় জীবন পেয়েছিলেন। কথা বলতেন খুব। ব্যবসা সম্পর্কে উবহড়ঁংঃৎধঃরড়হ দিতেন আমায়।
বলতেন ঢ়ৎড়ঢ়বৎঃু নিয়ে কথা।
মাঝে মাঝে বসড়ঃরড়হধষ হতেন খুব। আমার দুহাত ধরে একদিন বলেছিলেন: ওদরেকে দেখো!
মা- কেঁদেছিলেন খুব একথা শুনে। আমি শুনতে চাইন ঐ কথা। সুস্থ হয়ে গেছে।
এসব আবার কী কথা!
গতরাতে চোখে চোখে রেখেছেন আমায়। আসতে দিতে চাননি। ফাঁকি দিয়ে চলে এসেছিলাম। গত কয়েকদিন আসিনি। হাসপাতালই আমার বাড়ী।
আমার গতকাল পরীক্ষা ছিল। আজও আছে। আর আজই আমার শেষ পরীক্ষা।
বাবা আমায় শাসন করেননি কখনো। অথচ তাঁকে শাসন করার দায়িত্ব আমারই।
কারো কথাই শুনেন না। ওষুধ খেতে চান না। শুনেন শুধু আমার কথা। আবার তাঁর জন্য নির্ধারিত ৫০০ মি: লি: এর অতিরিক্ত পানি আমিই তাঁকে দেই। পানির জন্য তাঁর হাহাকার আমাকে কারবালার কথাই মনে করিয়ে দিত।
তিন
বারডেম হাসপাতাল।
লিফট বন্ধ।
দেঁড়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে আট তলায় উঠি।
আমার বোন ও মায়ের কান্না। হাহাকার।
“পালস নেই। প্রেসার লো। পা বরফ হয়ে গেছে। ”
দেঁড়ে গিয়ে একটা হাত ধরলাম। শীতার্ত করুণ হাত বাবার।
তিনি আরো এক হাত বাড়িয়ে দিলেন আমায়। তাকালেন আমার দিকে। আমি কয়েকবার ডাকলাম। কথা বলতে পারছেন না। আমর দিকে তাকিয়ে আছেন।
অনেক প্রশান্তি তাঁর মুখে।
ফজরের আযান শুরু হয়েছে। আমি কালেমা পড়ছি। বাবা আমার পরম সুখে চলে যাচ্ছেÑযাচ্ছেন অসীমের পথে।
চার
বাবা চলে গেছেন অনেকদিন।
নবাবপুর রোড কিংবা তার আশে পাশে তাঁকে দেখা যায় না সত্যি। কিন্তু তাঁর নিজ হাতে স্থাপিত প্রতিকৃতিটি শোরুমে রয়ে গেছে আজও।
পাঁচ
সময়ের আবর্তে ঘূর্ণায়মান জীবনের চাকা।
আমায় চলার পথের সর্বক্ষণিক উৎসাহ আমার বাবা।
স্মৃতিতে তিনি অমলিন।
এখনো অনেক ভোরে তাঁর ডাক যেন শুনতে পাই। ঘুম ভেঙ্গে যায়। বারান্দায় গিয়ে তাকাই এদিক-ওদিক-র্যাংকিন স্ট্রীট, হেয়ার স্ট্রীট, লারমিনি স্ট্রীট। ঝাপসা হয়ে আসে চোখ। মনে হয় ঐ তো কেউ মর্ণিং ওয়াক করতে করতে এগিয়ে চলেছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।