এক
গত ২৭ আগস্ট ২০০৯ ছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৩৩ তম মৃত্যু বার্ষিকী। ১৯৪১ সারের ২৬ নভেম্বর দৈনিক নবযুগ পত্রিকায় প্রকাশিত কবির ''শ্রমিক মজুর'' কবিতার মাধ্যমে ক'দিন বিলম্বে সেই দিন টিকে স্মরণ করছি।
ভদ্র সমাজে শ্রমিকরে কথা ‘কমকি’ গানের মত
ভব্যের মত মোরা নহি নাকি সু-সভ্য সংযত।
আচারে পোশাকে আমাদরে নাই ভদ্রের মত চাল,
চাল চুলা নাই , দারিদ্রে দুখে নাচার ও নাজেহাল।
আমাদরে বাসা আমাদরে ভাষা নিত্য নোংরা, দাদা !
তবুও বলিব, বাহিরে আমরা নোংরা , ভিতরে সাদা !
ভিতরের কালি ঢাকিতে তোমরা পরো হ্যাট, প্যান্ট ,কোট,
শ্রমিকেরে যারা গরু বরে , মোরা তাদের বলি '' হি-গোট'!
দুই
নুরুল ইসলাম বিএসসি নামের সাথে সচেতন পাঠক মাত্রই পরিচিত।
তিনি শুধূ আওয়ামী লীগের টিকেটে চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত জাতীয় সাংসদ সদস্য নন। তিনি একাধারে দেশের শীষ স্থানীয় শিল্পপতি , বিভিন্ন জাতিয় দৈনিকের একজন নিয়মিত কলাম লেখক এবং বিভিন্ন সেমিনার- সিম্পোজিয়ামে বিদ্বগ্ধ আলোচক।
ঢাকাবাসী হিসাবে আমাদের প্রাণ যানজটের কবলে ওষ্ঠগত। সকলেই প্রতি দিনের এই দূর্ভোগ থেকে পরিত্রানের পথ খুজছি। যানজটের কারণ হিসাবে সকলের মোটামুটি কমবেশি ধারনা রয়েছে।
গত ২৭ আগস্ট ২০০৯ দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় নুরুল ইসলাম বিএস সি সাহেবের 'যানজট নিরসন প্রসঙ্গে' শীর্ষক কলামে যানজটল সংক্রান্ত একজন সাংসদ সদস্যে ভাবনা জানবার জন্য লেখাটিতে চোখবুলাতে গিয়ে স্তম্ভিত না হয়ে পারলাম না।
সমাজের উচু তালার নিচু মনের মানুষেরা খেটে কাওয়া মানুষদের সম্পর্ক যে কি নোংরা চিন্তা /ধারণা পোষন করে , তার প্রমাণ জনাব বিএসি সাহেবের 'যানজট নিরসন প্রসঙ্গে' শীর্ষক কলাম। তার এই কলামা বিশাল এক প্রশ্নের মুখ মুখি দাড় করিযে দেয় , তিনি কি সাধারন মানুষের প্রতিনিধি, না সমাজের বিশেষ শ্রেনীর।
Click This Link
তিন
তিনি তার কলামে যানজটের প্রধান কারণ হিসাবে রিক্সা কে চিহ্নিত করেছেন; এটা অবাক হবার মত কিছু নয়। এ ধারণা টি নিত্য গাড়ি ব্যবহারকারীদের অনেকেই মনে করেন ।
যে কেউ ঢাকা শহরের যানজট বিষয়ে কথা বললে স্বাভাবিক ভাবে রাজপথে রিক্সার মত ধীরগতি সম্পন্ন যানবাহনের অবস্থানের বির্তক এসে যায়। কিন্তু আসুন জনাব বিএস সি রিক্ষা প্রসঙ্গে কিভাবে কি ভাষায় উপস্থাপন করেছেন জানা যাক।
''এবার আসা যাক রিকশা প্রসঙ্গে। অনেকে বলেন, রিকশা পরিবেশবান্ধব এবং গরিবের যানবাহন। আসলে কি তাই? রিকশা যিনি চালান তিনি গরিব কিন্তু যিনি চড়েন? এক কিলোমিটার রাস্তা যেতে লাগে ২০ টাকা।
এটা গরিবের বাহন হল? পরিবেশবান্ধব? রিকশার জন্য যানজটে পড়ে গাড়িগুলোর যে ফুয়েল জ্বলছে ওগুলো কি পরিবেশ দূষণ করছে না? রিকশা শ্রমিকরা যেখানে বসবাস করেন, ওখানকার পরিবেশ কি এরা দূষিত করছে না?
কথা উঠতে পারে, এরা বেকার হলে সমস্যা আরও তীব্রতর হবে। আন্দোলন হবে। বিরোধী দল সুযোগ নেবে। ''
লক্ষ্য করুণ রিক্সাওয়ালারার মত খেটে খাওয়া মানুষরা শহরে বসবাস করা যোগ্য নয়। কারণ তারা আমাদের তথাকথিত জৌলুসপূণৃ নগরের পরিবেশ দূষিত করে।
''যেখানে গ্রাম-গঞ্জে এখন কৃষিক্ষেতে কাজ করার শ্রমিক পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও ১৫০-২০০ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। অথচ একজন রিকশা শ্রমিক দৈনিক ২০০ টাকা আয় করে কিনা সন্দেহ। প্রকৃত ঘটনা, একজন রিকশা শ্রমিক যখন গ্রামে ছিলেন, সামাজিক রীতি-নীতি মেনে চলতেন। আত্মীয়-স্বজন ও লোকচক্ষুর ভয়ে বিয়ে শাদিতে সংযমের পরিচয় দিতে বাধ্য হতেন।
কিন্তু যেই মাত্র শহরে পা রাখেন, সামাজিক বন্ধনমুক্ত পরিবেশে এসে, একটার জায়গায় দুই তিনটা বিয়ে করে, ডজন ডজন সন্তান উৎপাদন করে, ত্রিশ চল্লিশ বছর বয়সে অকর্মণ্য হয়ে, দেশের ওপর ডজন ডজন ছেলেমেয়ের ভার চাপিয়ে দিয়ে, ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে নেমে পড়েন। প্রায় ক্ষেত্রে স্ত্রীও পরিত্যক্ত হয়ে বাসায় বাসায় ঝিয়ের চাকরি করতে বাধ্য হন। আমার কথার একটু গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করলে পরিষ্কার হবে, পৃথিবীর কোন বড় শহরে রিকশা নেই। যাদের ছিল এরাও রিকশার প্রচলন উঠিয়ে দিয়ে শহরকে যানজটমুক্ত করেছে। ''
জনাব বি এস সি সাহেব এই কথার জবার দিতেও তাঁর প্রতি ঘ্যান্নায় গাঁ রি রি করছে।
তবুও কিছু কথা না বললেই নয়। কারণ সমাজ সাদা আস্তিনের অনেকেই মনে মনে এ ধরণের ধারণা পোষন করেন।
১। ফসলের মৌসুমে গায়ে কৃষি কাজের লোক পাওয়া যায় না অধিক মুজুরি দিযেও। এটা একটি একপেশে সত্য।
তিন ফসলী গ্রামেও সারা বছরের কৃষি মজুরের কর্ম দিন মোট মিলিয়ে ১০০ দিনের ও কম। এই ক'দিনের মুজুরী দিযে স্ত্রী-পরিবার নিয়ে কি ৩৬৫ দিনের পেট চলে , সে কবর আমরা নগর বাসি ভব্য সমাজ রাখি না।
আমার এক পরিচিত রিক্সাচালকের সাথে এ বিষয়ে কাথা হযেছে। তার গাযে ক্ষুদ্র এক খন্ড কৃষি জমিও আছে যা তার স্ত্রী মজুরের মাধ্যমে দেখা শুনা করে। কেন সে নিজে ফসলী জমিতে নিজে মজুর দিয়ে খরচ কমায় না, এই প্রসঙ্গে জবাব হল,'ক্ষুদ্র জমির ফসলে দুই তিন মাসের বেশি খোরাকী জোটে না।
রিক্সাই তার সংসারের মূল অবলম্বণ। কিস্তু, ঢাকায় রিক্সা চালাতে আগ্রহী লোকের সংখ্যা রিক্সার তুলনায় অনেক বেশি। সে যদি ফসল মৌসুমে রিক্সা ছেড়ে ফসল তুলতে যায় , তবে মহাজন রিক্সা অন্যের হাতে দিয়ে দিবে, ফিরে এসে তার সহজে আর রিক্সা মিলবে না। '
২। সমাজের কোন শ্রেনীর লোকেরা পোশাকের মত স্ত্রী কিংবা গাল ফ্রেন্ড বদলান সেটা সকলের ভাল জানা।
পরিবার প্রতি সন্তান সংখ্যা কৃষিজীবি না শ্রমিক পরিবারে বেশি এটা বিচার করে দেখা প্রয়োজন। গরিব মানুষের অধিক সন্তান হলেই তা জাতি বোঝা আর প্রধান মন্ত্রীর কন্যার তৃতীয় সন্তান জাতীয় সম্পদ।
চার
জনাব বি এস সি অনুরোধ করেছেন তাঁর কথার গভীরে যাওয়ার জন্য। ''আমার কথার একটু গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করলে পরিষ্কার হবে''। আমাদের জাতীয় জীবনের সকল সংকট ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্ঠিকারী শাসক শ্রেণীর এক সাধারণ প্রবণতা এই যে তাঁরা সদা সচেষ্ট থাকেন সকল সংকট- সমস্যার দায়ভার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ঘাড়ে চাপি দেওয়া।
মাসের পর মাস বেতন -ভাতা বঞ্চিত গার্মেন্ট শ্রমিক যখন ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর হয়ে প্রতিবাদী হয়ে উঠে , আমরা ভব্যরা তখন আমাদের শান্তি ভঙ্গের দায়ে এই সব নিরান্ন শ্রমিকদের অভিসম্পাত করি। ঠিক তেমনি ভাবে আমাদের ভব্য সমাজের একজন হর্তাকর্তা জনাব বিএস সি বক্তবের এই সত্য পুনঃঅনুধাবণ করতে বেশি গভীরে প্রবেশের প্রয়োজন হয় না এবং এতে জনাব বি এস সি সাহেবের শ্রেনী চরিত্র পরিষ্কারতর হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।