বড় হওয়া বড় ভাল। তার চেয়ে বড় ভাল, ভাল হওয়া।
আমার ছেলের বয়স মাত্র সাড়ে তিন বছর। কিছুদিন আগে ওকে ভর্তি করেছি একটা ইংলিস মিডিয়াম স্কুলে। মার কাছে শুনেছি,আমাদেরকে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল পাঁচ বছর পেরিয়ে যাবার পর ।
সে হিসেবে এখনকার বাচ্চারা একটু আগেভাগেই স্কুলে যায়, কেও কেও ভালো করে কথা শেখার আগেই। জানিনা এটা বাড়াবাড়ি কিনা, কিন্তু বুঝতে পারি এই ছোট্ট বাচ্চাগুলো সত্যিই অন্যরকম, অনেক স্মাট, যেন বয়োসের চেয়ে কিছুটা বড়।
অন্যরকম ওদের স্কুল গুলোও এবং টিচারেরা। আমাদের সময়ের চেয়ে একেবারেই আলাদা , ফুটফুটে ছোট্ট বাচ্চাগুলোর মতোই স্মাট। বাচ্চাগুলো গাড়ি করে স্কুলে যায়, ইউনিফর্ম পরা সিকিউরিটি গার্ড খুলে দেয় সে গাড়ির দরজা, আয়ারা সযত্নে হাত ধরে পৌছে দেয় ক্লাস রুমে।
সেই ক্লাস রুমের দেয়াল গুলোতে আঁকা থাকে রঙিন ছবি - ঘাস, ফুল , পাখি, বেড়াল ছানা আরো কতো কি! টিচারেরা পরম যত্নে পড়াটাকে খেলা বানিয়ে দেয় ওদের জন্য। পুরো বছর ওদের কি শেখানো হবে তা বছরের শুরুতেই ঠিক করা হয় আর টিচারদের দেয়া নোটে বাবা-মাও জানতে পারে প্রতদিন কি শিখছে ওরা। সত্যিকারের যত্নে, আদরে, সন্মানে ওদের আনন্দময় বড় হওয়া সত্যিই ভালো লাগে আমার, আর সেই সাথে মনে পরে আমার ফেলে আসা স্কুলের কথা, আর সে সব টিচারদের কথা যাদের একমাত্র ব্রত ছিল আমাদের পিটিয়ে মানুষ করা, সম্ভবত তাদের চোখে আমরা মানুষ ছিলাম না বলেই।
এখনো মনে পরে সে সব শেয়াল পন্ডিতদের, আর বেশ হাসি পায় শেষমেষ মানুষ হতে পেরেছি বলে ( আমাদের স্কুলে অনেক ভালো টিচারও ছিলেন। এ লেখা তাদের নিয়ে নই)----------------------
জ্বীনের বাদশা: মাথাই গোল টুপি আর বিখ্যাত ছাগল দাড়ি।
পায়ের গোড়ালির উপরে ঝুলে থাকা ঢিলেঢুলা সাদা পাজামা আর হাতে তৈরি টেট্রন কাপড়ের একরঙা পকেট লাগানো পান্জাবি, এই ছিল হাফেজ স্যারের প্রতিদেনের পোষাক। ক্লাসে ঢুকতেন তিনফুট লম্বা তেলতেলে বেতের লাঠি হাতে। ঢুকেই সেটা দিয়ে সজোরে চটাং করে মারতেন টেবিলের উপর। সাথে সাথেই আমরা সবাই মেরুদন্ড সোজা করে ফেলতাম, যতক্ষন না পযন্ত তার সেদিনের মেজাজ বুঝতে পারতাম।
হাফেজ স্যারের মেজাজ ছিল দু-রকমের।
নাখোশ মেজাজ আর খোশ মেজাজ । নাখোশ মানেই আমাদের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। ক্লাসে ঢুকেই ধরতেন উল্টাপাল্টা অদ্ভুদ ট্যানশ্লেসন। হুংকার ছেড়ে বলতেন ইংরেজী করতে " আমি বাবার সহিত গরু লইয়া মাঠে চাষ করিতে যাইতেছিলাম, পথি মধ্য হঠাৎ গরু হাত থেকে দড়ি ছিড়িয়া পালাইয়া গেলো "। এরকম লম্বা আর আজগুবি বাক্যোর ইংরেজি স্বভাবতই কেও করতে পারতো না।
বিনিময়ে শুরু হতো গনহারে পিটুনি, আর তা চলতো উনি হাপিয়ে না ওঠা পর্যন্ত।
খোশ মেজাজের দিনে উনি শরু করতেন আষাঢ়ে গল্প। চেয়ারে পা তুলে বসে আয়েশ করে পান চিবুতে চিবুতে শুরু করতেন গল্প বলা। তার একটা বিখ্যাত আর জনপ্রিয় গল্প ছিল এরকম " বুঝলি, তোরা তো আজকাল ক্রিকেট খেলিস, আমরাও খেলতাম একসময়। একদিন খেলা শুরু হয়েছে সকালে , জংগলের মাঝখানে এক মাঠে।
আমি করছিলাম ব্যাটিং । ঢিলা বল পেয়ে মারলাম এক ছক্কা। বল চলে গেলো জংগলে। আমি রান নেয়া শরু করলাম। বলতো আর খুঁজে পাওয়া যাইনা।
ফিল্ডাররা বল খুঁজছে , এই ফাঁকে শ-দুই রান করে বাড়ি যেয়ে ভাত খেয়ে এলাম। তারপর শুরু করলাম আবার রান নেয়া। সন্ধা হয়ে গেলো কিন্তু বল খুজে পাওয়া গেলনা। আর সেই ফাঁকে আমি পাঁচটা সেন্চুরি করে ফেল্লাম। বুঝেছিস?"
কথিত ছিল হাফেজ স্যার জ্বীন পুষতেন।
দুষ্ট জ্বীন গুলোকে ভরে রাখতেন কাঁচের বোতোলে। সে কারনেই আমরা তার নাম রেখেছিলাম জ্বীনের বাদশা।
বান্ডু স্যার : ইসলাম ধর্ম পড়াতেন। উচ্চতাই ছিলেন খুব বেশী হলে সাড়ে চার ফুট। সম্ভবত সে কারনেই তার নাম রাখা হয়েছিল বান্ডু স্যার।
থুতনিতে ছিল ফুরফুরে অল্প কিছু দাড়ী আর মুখময় বসন্তের দাগ। পরতেন পান্জাবী, হাটুর উপরে ওঠানো পাজামা আর পাম্পসু। ক্লাসে ডুকতেন ডাস্টার হাতে, আর সেটাতেই ছিল আমাদের ভয়। কোন কারনে রেগে গেলে কাঠের তৈরি শক্ত ডাস্টার ছুড়ে মারতেন আমাদের দিকে। ধর্ম বইয়ের কোন দোয়া কেও একটু ভুল বললে অথবা লিখলেই প্রচন্ড রেগে গিয়ে এক হাতে কান চেপে ধরতেন আর অন্য হাতে ডাস্টার দিয়ে দমাদম বসাতেন পিঠের উপর।
সেই সাথে চিৎকার করেতন " সুরা বানাইয়া, বানাইয়া ল্যাখো "। ঠিক মনে পরেনা এরকম আমার সাথে কখনো হয়েছিল কিনা।
যতদুর মনে পরে বান্ডু স্যারের বাড়ী ছিল নোয়াখালি। মাঝে মাঝে তিনি ছোট একটা হাই তুলে নোয়াখালির ভাষাই বলতেন " বুজলি আল্লাই তরেও ফাডাইছে আমারেও ফাডাইছে" ( "ফাডাইছে" পাঠিয়েছে বুঝতে হবে)।
নসু স্যার: নাক থেকে নসু।
সারাটা বছর এ স্যারের ঠান্ডা লেগে থাকতো। ক্লাসে এসেই শুরু করতেন ছাদ ফাটানো হাঁচি। হাতে একটা রুমাল রাখতেন সবসময় । তার ফর্সা নাকটাকে সেটা দিয়ে ঘষে ঘষে একেবারে লাল করে ফেলতেন। আর এ কারনেই লাল নাকের এ স্যারের নাম হয়ে গিয়েছিল "নসু স্যার"।
নসু স্যার বাংলা পড়াতেন। ক্লাসে ডুকেই কোন ছাত্র কে ডেকে সেদিনের পাঠ্য পড়তে দিয়ে ঘুমিয়ে যেতেন তিনি। কখনো কখনো আমরা তার নাক ডাকার শব্দও শুনতে পেতাম।
হাফইয়ারর্লি পরিক্ষার খাতা দেখাবার সময় তিনি ঢুকতেন ছড়ি হাতে। খাতা দেবার সময় সবাইকে কমবেশী মারতেন ।
এমনকি ফাস্ট বয়কেও মার খেতে হতো- কেন সবচেয়ে বেশী নম্বর পেয়েছে এ জবাব দিতে না পারার অপরাধে।
এ লেখা শেষ করার পর একটু দুঃখই হচ্ছে, আমাদের সন্তানেরা এরকম অদ্ভুত আর মজার টিচার কখনো পাবেনা বলে ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।