সহজ আলোয় দেখা...
[ অনেকদিন ধরে গল্পটার কাহিনী মাথায় ঘুরছিল, লিখতে বসলে দেখি আগাতে পারছিনা তেমন। এক প্যারা, দুই প্যারে লিখি, কি রকম এক ধরণের অস্বস্তি চেপে বসে। লেখা আর আগায় না। এ ধরণের উদ্ভট একটা গল্প কীভাবে মাথায় এলো এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। সমস্যা হলো, লিখতে গেলে নার্ভের উপর অনেক চাপ পড়ে।
লেখাটা শেষ করে একটু স্বস্তি বোধ করছি, কাহিনীটা মাথার ভেতর আর ঘুর ঘুর করবে না বলে। লেখার পর কেন জানি, আবার পড়ে দেখার ইচ্ছা হচ্ছে না। ভুল-ত্রুটি থাকলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ থাকলো। ]
এক
বাড়িটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ময়ফুল। এতো সুন্দর বাড়ি এর আগে কখনো দেখেনি সে।
আগের দিনের রাজা বাদশাহরা হয়ত এরকম বাড়িতে থাকত। অনেকখানি জায়গা নিয়ে শহরের অদূরে সমুদ্র পারের এই প্রাসাদপোম বাড়িটার সামনে পরিপাটি বাগান, বাঁধানো পুকুর, সবকিছুতে যত্নের ছাপ। শেষ বিকেলের আলোয় স্বপ্নদৃশ্যের মতো মনে হয় ময়ফুলের।
অনেকক্ষণ ধরে বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ময়ফুল। যদিও এখানে আজ সে সম্মানিত আমন্ত্রিত অতিথি, তবুও ভেতরে ঢুকতে ইতস্তত করছে।
প্রকান্ড এই বাড়িটার সামনে নিজেকে অনেক ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে।
সমস্যা হলো সদর দরজার আশেপাশে কোথাও কোনো কলিংবেল দেখা যাচ্ছে না। আরও কতোক্ষণ এইরকম ইতস্তত দাঁড়িয়ে থাকতো ময়ফুল বলা মুশকিল, তবে মিনিট খানেকের মাথায় দরজা খুলে দেখা দিলেন মাঝবয়েসী হাসি-খুশী চেহারার একজন ভদ্রলোক।
“কেমন আছো ময়ফুল মিয়া?” করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে দেন ভদ্রলোক, “আমি আরিফ। ”
ময়ফুল এসেছে এই আরিফ সাহেবের কাছেই।
অনেক নামকরা লোক নাকি, দেশে-বিদেশে সবাই চেনে তাঁকে। ময়ফুল অবশ্যি ভেবেছিল উনি হয়ত বয়স্ক কেউ হবেন, কিন্তু দেখতে যথেষ্ট যুবকই মনে হচ্ছে।
“আমি ভালো আছি স্যার। ”, একটু হাসার চেষ্টা করে হাত মেলালো সে।
“তুমি বলে বলেছি বলে আবার মন খারাপ করোনিতো, বয়েসে তুমি আমার ছোটভাইর মতই হবে।
স্যার-টার বলার দরকার নেই, আরিফ ভাই বলতে পারো। ”
“জ্বি মাইন্ড করি নাই। ”
“গুড। এসো, এসো, ভেতরে এসো। ”
দুই
“আমারে কি মেরে ফেলবেন, স্যার?”
এতোক্ষণ ধরে আরিফ সাহেব যা বললেন, তার বেশির ভাগ কথাই বোঝেনি ময়ফুল।
যতটুকু বুঝেছে, তাতে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে এখন। নিজের ধারণা সত্যি না মিথ্যে তার একটা বিহিত না হওয়া দরকার ছিলো। একটা তীব্র অস্বস্তি চেপে ধরেছিলো ময়ফুলকে। প্রশ্নটা করে সে একটু হালকা বোধ করলো সে।
অবশ্য সময়টা এইরকম ভয়ঙ্কর কথাবার্তা বলার জন্যে যে খুব উপযোগী না।
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ। ময়ফুল বসে আছে বারান্দায়। পাশে আরিফ সাহেব। দু’জনের হাতে কফির মগ। প্রচুর খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে।
দেশী-বিদেশী আইটেম ছিল। রান্না করেছেন আরিফ সাহেব। নিজের খাবার তিনি নিজেই রান্না করেন। কিন্তু তার রান্না এতো ভালো ময়ফুলের ধারণা ছিল না। বেশী খাওয়ার কারণে হালকা ঝিমুনি চলে এসেছিল।
আরিফ সাহেব নিজে থেকেই কফি বানালেন, নিজের জন্যে এক কাপ, ময়ফুলের জন্যে এক কাপ। কফি নিয়ে তারা চলে এলো বারান্দায়। আরিফ সাহেবের বারান্দাটাও বিশাল। সুন্দর বসার জায়গা আছে। রাতের বেলা বসলে সমুদ্রের ঢেউয়ের ফসফরাস মাখানো মলিন আলো দেখা যায়।
সাথে সমুদ্রের গর্জনের আর মাতাল হাওয়া ময়ফুলের ঝিমুনিটাকে স্বপ্নালু করে তুলেছিলো।
কথাবার্তা খুবই সাধারণ বিষয় নিয়ে শুরু হয়েছিলো। আরিফ সাহেব জিজ্ঞেস করছিলেন, ময়ফুলের বাবা-মা বেঁচে আছে কিনা, সে বিয়ে করেছে কিনা। এভাবে কখন যে তাকে এখানে নিয়ে আসার প্রসঙ্গটা উঠলো, ময়ফুল খেয়াল করেনি। খানিকটা শুনার পর মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছে।
ঘোরটা ভেঙ্গে গেলো চট করেই। এরপর পেয়ে বসলো তীব্র আতংক।
ময়ফুলের কাছ থেকে এরকম কোনো প্রশ্ন আশা করেননি আরিফ। তিনি একটু ধাক্কার মতো খেলেন বোঝা গেল। কারণ প্রশ্নটা শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন।
“দেখো ময়ফুল, আমি চাইলে পুরো ব্যাপারটা আড়াল করে রাখতে পারতাম। আমার সেরকম ইচ্ছা ছিল না। যা বলার, যা করার তা সরাসরি আমি বলে নেব। এরপর বাকীটা তোমার ইচ্ছা। তুমি চাইলে ফিরে যেতে পারো।
” একটু থামলেন আরিফ সাহেব। “ইন ফ্যাক্ট, তোমার আগে আরো একজন এসেছিলো। সে শেষ পর্যন্ত সাহস করেনি। হয়ত তুমিও করবে না। দ্যাটস ফাইন।
বাট আই মাস্ট সে দ্য ফ্যাক্ট। ”
“বিষয়টা বুঝায়ে বলার জন্য ধন্যবাদ স্যার। আমার প্রশ্নটা যদি একটু ক্লিয়ার করে বলতেন, ভালো হতো। ”
“তোমার প্রশ্নের সহজ উত্তর হচ্ছে, না, আমি তোমাকে মেরে ফেলছিনা। তবে কিছু ঝুঁকি আছে বটে।
আমার মনে হচ্ছে তুমি ব্যাপারটা বোঝোনি পুরোটা। আমি আরো সহজ করে বলার চেষ্টা করছি। ” বলে আরিফ সাহেব এবার একটু নড়ে-চড়ে বসলেন, বোঝা যাচ্ছে একটু আগের ধাক্কাটা সামলে উঠেছেন তিনি।
“অসুখ বা দুর্ঘটনার কারণে মানুষ অনেক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এই জ্ঞান হারানোটা কখনো কখনো মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যায়।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে কমা। তুমি কি এই রকম অবস্থার কথা কখনো শুনেছো?”
“হ্যাঁ, অসুখে পড়ে আমার এক চাচীর এই রকম হয়েছিলো। পরে উনি আর ফেরত আসেন নাই। ”
“আচ্ছা। আমি দীর্ঘদিন এমন একটা ওষুধ বানানোর চেষ্টা করেছি যাতে একজন মানুষকে সেই কমা অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনা যায়।
প্রথম দিকে আমার নিজের কাছেই কাজটা খুব অসম্ভব মনে হয়ে ছিলো। একটা সময় এটা সম্ভবের দিকে যেতে থাকে। কিছুদিন আগে ল্যাবরটরিতে ওষুধটার কার্যকরিতা সফলভাবে পরীক্ষা করতে সক্ষম হয়েছি ইঁদুরের উপর। কিন্তু খুবই সামান্য হলেও কিছু ঝুঁকি থাকতে পারে এটা মানব শরীরে প্রয়োগের ক্ষেত্রে। এই ঝুঁকির বিষয়টা পরীক্ষা করার জন্যে আমার দরকার একজন মানুষ।
” এইটুকু বলে ময়ফুলের দিকে তাকালেন আরিফ সাহেব। “তোমাকে আর এক কাপ কফি দেবো ময়ফুল?”
“জ্বী না। ঘুম কেটে গেছে। ”
“কেটে যাবারই কথা!”, বলে হা হা করে হাসলেন আরিফ সাহেব। মানুষটার হাসি দেখে তাকে খুব নিষ্ঠুর বা খারাপ মানুষ মনে হচ্ছে না ময়ফুলের।
“ভয়ের কিছু নেই ময়ফুল। ক্ষতির সম্ভাবনা খুব সামান্য না হলে কোনো মানুষের উপর পরীক্ষা করার কথা ভাবতাম না। একজন অন্ধ মানুষ কারো সাহায্য নিয়ে রাস্তা পার হলে যতটুকু ঝুঁকি থাকে, এখানে ঝুঁকিটা তার চাইতে একটু বেশী। ” একটু গম্ভীর হয়ে বললেন আরিফ সাহেব। “এধরণের ওষুধের কথা সবাইকে জানানোর আগে আমাকে এর সবধরণের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হবে।
পরীক্ষাটা সফল হলে সাড়া পৃথিবীতে বিশাল সাড়া পড়ে যাবে। অনেক মানুষের উপকার হবে। সমস্যা হলো আইনগত কিছু ঝামেলার কারণে সবাইকে জানিয়ে পরীক্ষাটা করতে পারবো না। এই জন্যেই তোমার মতো কারো সাহায্য দরকার আমার। ”
অনেকক্ষণ কারো মুখে কোনো কথা নেই।
আধাঁরের ভেতর সমুদ্রের গর্জন কিরকম যেন ভৌতিক মনে হয় ময়ফুলের।
“আমি জানি তোমার অনেক টাকার প্রয়োজন ময়ফুল। ”, মৌনতা ভাঙ্গেন আরিফ সাহেব। “আমি মানুষ খারাপ না। আমি তোমাকে ঠকাবো না।
সারা জীবনে তোমার যেন টাকা-পয়সার কোনো সমস্যা যেন না হয়, আমি তোমাকে সে ব্যবস্থা করে দেব। চাইলে তুমি সময় নিতে পারো এই প্রস্তাবে রাজী হবে কিনা ভেবে দেখার জন্য। যতদিন ইচ্ছা থাকো, ঘুরো, ফিরো কোনো সমস্যা নেই। তুমি আমাকে কতটুকু বিশ্বাস করতে পেরেছো জানিনা, আমি তোমাকে বিশ্বাস করলাম। ”
ময়ফুলের মুখে কোনো কথা ফোটে না।
মাথা নীচু করে বসে থাকে।
তিন
ময়ফুলের খুব কাছে আরিফ সাহেব বসে আছেন। তার সামনে রাজ্যের যন্ত্রপাতি আর ডিসপ্লে মনিটর। ময়ফুলের শরীরে লাগানো নানা তার আর ডিভাইসগুলো মনিটরে জানান দিচ্ছে তার শরীরের রক্ত-চলাচল, শ্বাস-প্রশ্বাস, যাবতীয় কিছুর রিডিং। ময়ফুলের একবার ইচ্ছা করলো, আরিফ সাহেবকে জিজ্ঞেস করে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর জিজ্ঞেস করা হয় না।
সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত গভীর হচ্ছে আস্তে আস্তে। একটু পরেই অন্ধকারের জগতে হারিয়ে যাবে ময়ফুল। আরিফ সাহেব বলেছেন, ভোরের দিকে তার জ্ঞান ফিরে আসবে। ভোরের দিকে ময়ফুলের জ্ঞান ফিরে আসা যতটা না জরুরী ময়ফুলের জন্যে, তার চাইতে বেশী জরুরী আরিফ সাহেবের জন্যে।
প্রতিদিন সকালে উনি চিরতার রস খান, এটা নাকি তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। আরিফ সাহেব জানেন না, তার আজকের চিরতার রসে বিষ মেশানো আছে। আরিফ সাহেবের কথা মতো সে যদি না ফিরে আসে, তাহলে শুধু একা একা ওপারের জগতে যেতে চায় না ময়ফুল।
ময়ফুল শুয়ে আছে একটা নরম সাদা বিছানায়। ঘরের মধ্যে আলো অনেক কম, কিন্তু আলো আধাঁরি বলা যায় না।
প্রায় নিস্তদ্ধ এই ঘরটাতে আরামদায়ক শীতলতা পরিবেশটাকে কীরকম আশ্চর্য গম্ভীর করে তুলেছে। মৃত্যুর জন্যে কি খুব আদর্শ আয়োজন বলা যায়? আদর্শ কিনা ময়ফুল জানে না, কিন্তু গভীর একটি নিদ্রার জন্যে তার শরীর যেন প্রস্তুতি নিচ্ছে। চোখের পাতা ভারী ভারী হয়ে আসছে। শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কী রকম আলসে আর শ্লথ হয়ে যাচ্ছে। ওষুধের কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কারণে এমন হচ্ছে কিনা বুঝতে পারছে না সে।
প্রগাঢ় নিদ্রায় তলিয়ে যেতে যেতে ময়ফুল টের পেল, আরিফ সাহেব তার একটা হাত আলতো করে ধরে রেখেছেন। তার স্পর্শে আছে এক ধরণের ভরসা, নিশ্চয়তা। আরেকটা হাত দিয়ে তিনি হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন ময়ফুলের কপালে। আরিফ সাহেবের ঝাপসা অবয়বের দিকে ময়ফুলের কাছে সত্যি সত্যি মনে হয় তার বড় ভাই তাকিয়ে আছে তার দিকে প্রবল মমতা নিয়ে। বড় আসময়ে সে বুঝতে পারে এই মানুষটিকে নিয়ে যা কিছু সন্দেহ করেছে সে, তা ছিল ভুল।
এই পৃথিবীতে সে ঠিকই ফিরে আসবে আবার। ময়ফুলের প্রায় অবচেতন মন প্রার্থনা করতে থাকে সে যেন ঠিক সময়ে ফিরে আসে। এতো বড় একজন মানুষ তার মতো একজন অতি সাধারণ একজনকে যে পরিমাণ বিশ্বাস আর মমতা দেখিয়েছে, তার কিছুটা হলেও সে যেন ফেরত দিতে পারে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।