যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
আবারও রোজা শুরু হয়ে গেলো,গতবছর ভেবেছিলাম রোজা নিয়ে স্মৃতিগুলোকে বেঁধে রাখবো ব্লগে, পারিনি। দু'পর্ব লিখতেই থেমে গিয়েছিলো সব, এবার দেখি কতটুকু টানা যায়। ত্রিশ পেরুনোর পর স্মৃতির ভান্ডারেও মরচের টের পাচ্ছি যখন তখন, তার ওপর রোজার উপোস, জানিনা মরচে পড়া ভান্ডার থেকে কতটুকু উঠিয়ে আনা যাবে, তাও যা মাথায় আসে তাইতো লিখতে হবে। তবে আপাততঃ গত বছরের দুপর্ব দিয়ে দুটো দিন পার করি।
আমাদের সেসময়ে ছোটবয়েসে রোজা রাখলে পেপারে "অমুক সোনামণি মাত্র অত বছর বয়সে রোজা রেখেছে" টাইপের খবর আসার সুযোগ ছিলোনা, তারপরও বাচ্চাদের রোজা রাখতে চাওয়ার হিড়িক সেযুগে কিছু কম ছিলোনা।
সবারই মনে হয় ছোটবেলায় বাবা-মা বা বাসার অন্যদের দেখাদেখি "রোজা রাখতে চাই, রাখতে চাই দিতে হবে" টাইপের আন্দোলন করার অভিজ্ঞতা আছে। সবার গল্পই মোটামুটি একই রকম, তাও আমরা সবাই অন্যদের কাছে সেই গল্প করি। অন্যেরটা শুনি বা না শুনি, নিজেরটা বলে ছাড়ি। কারণ, ছোটবেলার খুব এ্যাডভেঞ্চারাস কিছু অভিজ্ঞতার একটি হলো মনে হয় সেই প্রথম রোজা রাখা; খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে, গ্লাসের ভেতর টলটল করা স্বচ্ছ পানি দেখা যাচ্ছে, রান্নাঘর থেকে ঘ্রাণ বের হয়ে আসছে, বড়মামার আনা জিলিপি বা দই স্বচ্ছ পলিথিন প্যাকেটের ভেতর থেকে ডাক দিচ্ছে, সন্ধ্যার আগে আগে বাবার আনা বরফ ছোঁয়া যাচ্ছেনা-- এতসব বাঁধা অতিক্রম করে শেষমেষ সন্ধ্যের সাইরেণ বাজার পর বিজয়ীর হাসি হেসে খাবার মুখে দেয়া -- এটা বেশ বড় রকমের এ্যাডভেঞ্চারই!
আমি প্রথম রোজা রেখেছিলাম পাঁচ বছর বয়েসে। এমনিতে খুব দূর্বল ছিলাম, ছোটখাটো আর কাঠির মতো শুকনো (আমার বর্তমান চেহারা দেখে যে কারো পক্ষে এটা মেনে নেয়া অবশ্য বেশ কঠিন হতে পারে)।
তারওপর জন্মানোর পর অলরেডী বেশ কয়েকটা ফাঁড়া কাটিয়ে মানে বেশ কবার অজ্ঞান-ট্যান হয়ে "ও রোজা রাখবে কি!" এর তকমাটা খুব ভালোভাবেই গায়ে লাগিয়ে ফেলেছিলাম। তারপরও রোজা কিভাবে রাখতে পারলাম সেটা ভাবলে আজো অজান্তেই মুচকি হেসে ফেলি।
১৯৮২ সালের কথা, সেদিন সন্ধ্যায় মেজোমামার বিদেশ যাবার কথা। এখন আর সেই কালচার আছে কিনা জানিনা, সেই আশির শুরুতে কারো বিদেশ যাওয়া ছিলো বিরাট ব্যাপার, বিশেষ করে আমাদের নোয়াখালীর লোকদের জন্য। বিদেশে যেতে পারাটা যতোনা বড় ব্যাপার, তার চেয়ে এলাহী ব্যাপার হয়ে যেতো তাকে বিদায় জানানোর আয়োজনটা।
বিদেশগামী লোকটার সাথে জীবনে দেখাও হয়নি এমন লোকদেরও দেখা যেতো বিদায় দিতে এসে জড়ো হয়েছে, কান্নাকাটি করছে (এটা অবশ্য একটু বেশী বলে ফেললাম মনে হয়)। তো, মামাকে বিদায় জানানোর জন্যও যথারীতি ঢাকা শহরে আমাদের যত আত্মীয়স্বজন আছে সবাই এসে আমাদের বাসায় হামলে পড়লো। সারা বাসা জুড়ে একটা উৎসব উৎসব ভাব। রাত দশটায় ফ্লাইট বলে সন্ধ্যার পরপরই আমরা সবাই মিলে বের হয়ে গেলাম এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।
এয়ারপোর্টে গিয়ে কি কি ঘটলো ভালো মনে নেই, তবে এটুকু মনে আছে যে কোন এক ঘাপলার কারণে মামাদের ফ্লাইটটা কয়েকদিন পিছিয়ে গেলো।
পেছালো তো পেছালোই, সেটা জানা গেলো অনেক পরে, রাত দশটা এগারোটার দিকে। মানে আবার বিশালবাহিনী নিয়ে বাসায় প্রত্যাবর্তন! বাসায় মনে হয় সেদিন বিশ-পঁচিশজন মানুষ ছিলেন, সারা বাসাজুড়ে হট্টগোল! আমাকে আর পায় কে? এমন দিনে ঘুমটুম সব বাদ দিয়ে আমি একবার এদের দলে গিয়ে কিছুক্ষণ গল্পসল্প শুনি, আবার ওদের দলে যাই। রোজা শেষ হবার আগেই যেন ঈদ চলে আসল। শুধু আমি না, আমাদের পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে মনে হয় শুধু পিচ্চিটা ছাড়া আর সবাই জেগে ছিলাম। এভাবে ফুর্তির মধ্যেই কোনফাঁকে রাত তিনটা বেজে গেলো টেরও পেলামনা।
তিনটার দিকে বড়আপা হঠাৎ রেডিওটা ছাড়ল। সম্ভবতঃ মুরুব্বীরা কেউ বলেছিলেন ছাড়তে। রেডিও ছাড়ার সাথেসাথেই যে সুরটা কানে আসল, তাতে আমি পুরোপুরি মুগ্ধ হয়ে গেলাম! অসম্ভব সুন্দর সুরের একটা গান, সম্ভবতঃ হামদ, গানটা আমি পরেও অনেক শুনেছি, এবং আমার ধারনা যে লোকটি গেয়েছেন তাঁর মনপ্রাণ সঁপে দিয়ে গাওয়ার কারণেই গানটা এমন শুনিয়েছে। গানের কলির কিছুই মনে নেই, শুধু মনে আছে প্রথম দুলাইনে সুর করে "আল্লাহু, আল্লাহু, আল্লাহু, আল্লাহ" বলে গায়। মুগ্ধ হয়ে গান তো শুনলামই, গান শেষ হলে বড় আপাকে "আবার ছাড়ো, ঐ গানটা" বলে বেশ জালালামও।
সেদিনই রেডিওতে আরেকটা গান শুনেছিলাম, এটা অত ভালো লাগেনি, কিন্তু কেন জানি এখনও মনে আছে। গানটা ছিলো এরকম, "আল্লাহু, আল্লাহু, তুমি জাল্লে জালালু, শেষ করাতো যায়না কেন তোমার গুণগান"। এ গানটার "জাল্লেজালালু"র মানে কি এটা নিয়ে অনেকদিন মনে খচখচ করত, অবশ্য এখনও জানতে পারিনি।
সে রাতের মুগ্ধতা সেখানেই শেষ না। কিছুক্ষণ পর শুনি বাহির থেকে আওয়াজ আসছে, গমগমে ভরাট গলায় একদল ছেলে গাইছে, "তোমরা ওঠো মমিন সকলে, ঘুমিয়ে থেকোনারে, সেহেরীর সম চলে যায়, এই রাত খোদাকে ডাকার"।
পাঠক বলুনতো দেখি এটা কোন গানের সুর নকল করে গাওয়া হয়েছে? হিন্টস, সাবিনা ইয়াসমিনের হিট একটা গান। তো, রেডিওর গানের চেয়ে আরো কয়েকগুন বেশী মুগ্ধ হলাম আমি রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে ভেসে আসা এই গান শুনে। সেই মুগ্ধতা অনেকদিন কাটেনি, অনেক বড় হয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমি শুধু ভোররাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে বের হয়ে আসা সেই গান শোনার জন্যই সময়মতো জেগে যেতাম, অনেকদিন এমনও হয়েছে, গান শুনে আবার ঘুমিয়ে পড়েছি। হয়ত নিজের চোখে দেখা একটা হত্যাকান্ড না হলে সে মুগ্ধতা আরো অনেকদিন ধরে রাখার সুযোগ হতো, তবে সে গল্প আজ করবনা। আজ আবার ফিরি সেই প্রথম গান শোনার রাতে।
ভোররাতে সম্ভবতঃ একটু টেনশনে ছিলাম, সেহরী খেতে দেয় কিনা সেটা নিয়ে। কিন্তু আমার সব ভয় দূর হয়ে গেল যখন মা নিজেই আমাকে জাপতে ধরে বেশ কয়েক ন্যালা ভাত খাইয়ে দিলো, আবার খানিক পরে বাবাও দেখলাম মিষ্টিআমের মোরব্বার সাথে দুধমাখা ভাত সাধছে। পেটপুরে খেয়ে দেয়ে লাফাতে লাগলাম, "কালকে রোজা রাখবো, কালকে রোজা রাখবো। " কেউ পাত্তা দেয়নি অথবা অন্য যেকোন কারণেই হোক, খুব একটা বাঁধা আসেনি সেসময়। এমনও হতে পারে যে, যথাযথ কর্তৃপক্ষ মানে মা তখন ভেবেছে যে "সকালে উঠে খিদে পেলেই তো রোজার কথা ভুলে যাবে।
"
কিন্তু মায়ের যাবতীয় অনুমানকে মিথ্যা করে দিয়ে পরদিন সকালে আমাকে আর বাগে পাওয়া গেলনা। এখনও মনে আছে, সামনের রুমে অনেক লোকজন ছিলো, সেই সুযোগে সেরুমের খাটের নীচে অনেকক্ষণ লুকিয়ে ছিলাম, যাতে মা খুঁজে না পায়। এরমধ্যে সম্ভবতঃ মেঝোখালা খেজুর নিয়ে আসলেন, সেই খেজুর দেখে এমন লোভ লাগলো যে কয়েকদফা নিজের সাথে (মানে নফসের সাথে ) রীতিমতো যুদ্ধ করতে হলো! আজো যে আমি খেজুর এত পছন্দ করি তার পেছনে সম্ভবতঃ সেই দিনের সেই না পাবার কষ্টটা কাজ করে।
দুপুরে গোসল টোসল করে হৈ হৈ রৈ রৈ করে নামাজ পড়ে আসলাম। সেই ফিরে আসার পর টের পেলাম খিদে কাকে বলে! বেশ কয়েকবার মনে হচ্ছিলো মাকে গিয়ে চুপিচুপি খাবার দিতে বলি, আবার আত্মসম্মানবোধেও লাগল।
কারণ, আপারাও সবাই তখন পিচ্চি পিচ্চি আর আমি যেহেতু সেদিনই জীবনে প্রথম রোজা রাখছি তাই সবার আগ্রহের একটা কেন্দ্রতেও পরিণত হয়ে গেছি। এমন অবস্থায় তো হাল ছেড়ে দেয়া যায়না। দুপুরে মার দেখানো অনেক রকম খাবারদাবারের লোভ এড়িয়ে কোনভাবে পার করে দিলাম।
বিকেলে বাবা অফিস থেকে এলে বেশ খানিকক্ষণ আহ্লাদও করলাম, আমার দাবী অনুযায়ী সেদিন বেশী করে বরফ আনা হলো, স্পেশাল জিলিপী আনা হলো। বিকেলের ইফতারীর আয়োজন দেখতে দেখতে এতই ব্যস্ত হয়ে গেলাম যে রোজার কষ্টের কথাও ভুলে গেলাম মনে হয়।
তবে বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিলাম, কারণ এটা মনে আছে সন্ধ্যার কিছু আগে সেই যে খাটের উপর গিয়ে গেঁড়ে বসলাম, আর নামিনি। মনে তখন ভীষন রোমাঞ্চ, আর খানিক পরেই তো খেতে পারবো; তবে তখন খেতে পারার চেয়েও বড় আনন্দ হলো আর খানিক পরেই তো আমার রোজা রাখা হয়ে যাবে! কি সাংঘাতিক কথা!!
দেখতে দেখতে সময় ঘনিয়ে এলো, আর পাঁচ দশ মিনিট আছে। একগ্লাস লেবুর শরবত, একটা প্লেটে শসা, ছোলাভাজা, পিয়াজু আর মুড়ি (এটা আমাদের বাসার চিরন্তন ইফতার) নিয়ে বাবার সামনাসামনি খাটে বসে আছি আমি। ঠিক তখনই অঘটনটা ঘটলো! কি অঘটন সেটা আমার আর মনে নেই, কারণ অঘটনটাই হলো ইফতারের কয়েকমিনিট আগে আমার যথারীতি জ্ঞান হারিয়ে ফেলার ঘটনা! যথারীতি বলছি কারণ ছোটবেলায় এই কাজটার জন্য আমি বিখ্যাত ছিলাম, অন্ততঃ দশবার জ্ঞান হারিয়েছি, একবার হারিয়েছি মোড়ার ওপর লাউ তুলতে গিয়ে লাউসহ ধপাস করে পড়ে।
তারপরের কথা আর আমার মনে ননেই, শুধু মনে আছে পাঁচ দশ মিনিট পর যখন জাগলাম, তখন খালি জিজ্ঞেস করছিলাম সাইরেন দিয়ে ফেলেছে কিনা।
যখন জানলাম সাইরেন দিয়ে ফেলেছে, মনটা এতো খারাপ হলো! তবে তারচেয়েও আরো চমকে গেলাম যখন জানলাম আমার মুখে পানি দিয়ে রোজা ভাঙানো হয়েছে। রোজাটা কি পুরো করতে পারলাম? জিজ্ঞেস করতেই বাবা-মা সমস্বরে (সম্ভবতঃ) বললেন, "অবশ্যই, অবশ্যই"।
তারপর অনেকদিন মাকে জালিয়েছি শুধু এটা জানার জন্য যে আসলেই সেদিন রোজাটা পুরো রাখতে পেরেছিলাম কিনা। ছোটবেলায় মা সবসময় ঐ প্রশ্নের জবাবে বলত, "কতবার বলবো? রেখেছিস তো!!"
তবে এখন জিজ্ঞেস করলে কিছু বলেনা, খালি মুখ টিপে হাসে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।