যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
একরামুল হক শামীমের জন্মদিন বিষয়ক লেখাটি পড়ে নিজস্ব পুরোনো কিছু চিন্তা মাথায় খেলে গেলো। সেগুলোরই একটা এলোমেলো কম্পাইলেশন এই লেখাটি।
নিজের কিছু স্মৃতি:
শামীম তার লেখায় যে বিষয়টির অবতারণা করেছেন সেটি আমাদের সমাজে নতুন না বলেই মনে করি, অর্থাৎ, পরিবারের আপনজন বা কাছের মানুষদের সাথে গ্রিটিংস বা অভিবাদন সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিকতার বিষয়টি। যেমন, জন্মদিনের দিন সন্তান ফোন করলো, কিন্তু বাবা-মা মুখ ফুটে "হ্যাপি বার্থ ডে" বা "শুভ জন্মদিন" বললেন না। আমার নিজের বেলায়ও একইরকম হয়।
বিদেশে আসার পর প্রথম কয়েকবছর নিজের প্রতিটি জন্মদিনেই বাসায় ফোন করতাম, ওপাশে সাধারণত মা-ই ধরতেন, গলার স্বরে আলাদা আবেগটুকু টের পেয়েই বোঝা যেত যে ফোনের অপেক্ষায় ছিলেন এদিন, কিন্তু মুখ ফুটে বলতেননা, "হ্যাপী বার্থ ডে" বা "শুভ জন্মদিন, বাবা" ধরনের কিছু। বড়জোর হয়ত কথার ফাঁকে একবার হঠাৎ করেই প্রসঙ্গ তুলে বলতেন, "কি রে, বয়স কত হলো?" সেটাও যে প্রতিবারই করতেন তা না। তবে সত্যি বলতে কি, মা যে এই আনুষ্ঠানিকতাটুকু করতেননা, এতেই আমি বেশী খুশী হতাম; কারণ, 'মার মুখে "শুভ জন্মদিন বাবা" শুনে আবার সেটার উত্তরে "ধন্যবাদ, আম্মা" বলা' -- এটাকে কেমন যেন ন্যাকা একটা ব্যাপার মনে হতো, বড় লজ্জা বা অস্বস্তি অথবা এর কাছাকাছি এক ধরনের অনুভূতির ব্যাপার ছিলো সেটা। আমি জানিনা পাঠকদের মাঝেও অনেকের এমনটা হয় কিনা। এখনতো গুণে গুণে নিজের জন্মদিনে দেশে ফোন করাটাকেই ন্যাকামি মনে হয়! "ত্রিশ পেরিয়েছে সেই কবে, বুড়ো হাবড়ার আবার জন্মদিন!" -- এরকম কোন অনুভূতি? হতে পারে।
ব্যাপারটা আমাদের পরিবারে ব্যাপক; যেমন উপরে যে বলেছি জন্মদিনে ফোন করলে মা মাঝেমাঝে বয়েস কত হলো জিজ্ঞেস করতেন, বাবা সেটাও করতেননা। বাসায় ফোন করলে মা'র সাথে সবসময়ই কথা হয়, বাবার সাথে প্রতিদিন না; তবে জন্মদিনে ফোন করলে বাবার সাথে কথা হতো। তিনি নিশ্চয়ই সেদিন মা কথা বলার সময় ফোনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন, হয়তো জন্মদিনের দিন যে তিনি আবশ্যিকভাবে কথা বলতেন এতেই তাঁর শুভকামনাটি আমার কাছে পৌঁছে যেত। এর বেশী প্রকাশটাই বরং অস্বস্তির -- এরকমই মনে হয়। যেমন স্মৃতিকে আরেকটু পেছনে টেনে বলা যায়, আমাদের সব ভাইবোনের বেলাতেই বাসায় কেকে কেটে জন্মদিন পালন বন্ধ হয়ে গেছে প্রত্যেকে দশ পেরুবার আগেই।
তারপরও যখন বয়েস তেরো চৌদ্দ, মনে আছে দেখতাম, জন্মদিনের দিন মা ঠিকই আমার পছন্দের কোন একটা খাবার রেঁধেছে; এটুকুই, খুলে বলতেও হতোনা "বাবু, তোর জন্মদিন দেখে এটা রাঁধলাম!" সত্যি কথা! টেবিলের মেন্যু দেখেই বুঝে ফেলতাম, "ওহ! আজ তো আমার জন্মদিন। " কৃতজ্ঞতাবোধের জন্য না, বরং পছন্দের কারণে স্বাভাবিকভাবেই সে খাবার হাপুস হুপুস করে খেতাম, যেমন গরুর মাংসের কাবাব একটি খেয়ে কোনদিন আমার হয়নি, তিন-চারটা তো মিনিমাম। সেই কামলা স্টাইলের খাওয়া দেখেই কৃতজ্ঞতাটুকু বুঝে নিতেন মা নিশ্চয়ই, আলাদা করে "থ্যাংক্যু মাম" বলার দরকার হতোনা। এ এক অদৃশ্য যোগাযোগ, টেলিপ্যাথি না হোক, কাছাকাছি, কিছু বলা লাগছেনা, সবাই বুঝে নিচ্ছে "হি/শী ইজ দেয়ার ফর মি"।
এরকম ব্যাপার আমাদের সবার জীবনেই কমবেশী আছে।
কলেজে পড়া মাদার ইন ম্যানভিলের সেই অংশটুকুর সাথে এর খুব মিল। যেখানে লেখিকা ছোট্ট-বালক জেরীর উপকার করায় (কি উপকার ছিলো কিছুতেই মনে করতে পারছিনা, ত্রিশের পর মেমোরীর এই ত্রাহিত্রাহি অবস্থা দেখে আমি খানিক চিন্তিত), জেরী লেখিকার দিকে শুধু তাকিয়েছিলো। কৃতজ্ঞতাভরা সে দৃষ্টি লেখিকার কাছে মুখ ফুটে বলা "থ্যাংকসের" চেয়ে অনেক বেশী গভীর মনে হয়েছিলো।
এসব মিলিয়েই ভাবনাটা প্রায়ই হামলা দেয়, ভাষায় যখন প্রকাশ করা হয় তখন কি অনুভূতি বেশী গভীর থাকে, নাকি যখন প্রকাশ করা যায়না, তখন?
সম্পর্কের গভীরতা আর আবেগের প্রকাশ:
উপরে যে বলেছি অনুভূতির গভীরতা, এখানে "অনুভূতি" শব্দটা হয়তো ঠিক অর্থ বহন করছেনা, বা বলা যায় যে এই অনুভূতিটা হলো কিছুটা গ্রে অর্থের। উদাহরণ দিই জন্মদিন নিয়েই।
যেমন বন্ধুকে যখন আপনি "হ্যাপি বার্থডে" বলছেন তখন হয়তো সে অর্থে আপনার মধ্যে বড় কোন অনুভূতি কাজ করছেনা, প্রিয় বন্ধুর জন্য একধরনের শুভকামনাই শুধু কাজ করছে। এসব কিছুকে অনুভূতি হিসেবে ধরেই এই আলোচনা।
প্রশ্নটা হলো, কখন সম্পর্কটাকে আমরা গভীরতর ভাববো। যখন অনুভূতির প্রকাশ ঘটছে সহজে তখন, নাকি, যখন প্রকাশ করা কঠিন হচ্ছে তখন। যেমন মেয়েদের ক্ষেত্রে অনেকে মায়ের সাথে খুব ফ্রী বা সাবলীল থাকে, প্রায় বান্ধবীর মতো; মাকে মেয়ে নিজের সব কথা বলে, নিজের প্রেম বিষয়ক ব্যাপারগুলো স হজেই শেয়ার করে।
আবার অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় যে মা-মেয়ের মাঝে এই শেয়ারিংয়ে একটা দূরত্ব আছে। এখান থেকে কি আমরা বলতে পারি যে যে মা-মেয়ের জুটিটি সহজেই শেয়ার করতে পারে পরস্পরকে, তাদের মাঝে সম্পর্কটি গভীরতর, অর্থাৎ তাদের মাঝে পারস্পরিক ভালোবাসাটা বেশী? উল্টোভাবে বললে, মায়ের সাথে সব কথা শেয়ার করতে পারেনা, সংকোচ আছে, কিন্তু মাকে পৃথিবীর অন্য যে করো চেয়ে বেশী ভালোবাসে এমনটি হওয়া কি অসম্ভব?
যেমন উপরের উদাহরণটিকে কেন্দ্র করেই আরেকটি সিনারিও কল্পনা করি, এরকম ঘটনা হরহামেশাই ঘটে আমাদের আশপাশে। ধরুন, মেয়ে চাইছে বন্ধুদের সাথে একত্রে নেপাল ঘুরতে যাবে, কিন্তু বাবাকে কিছুতেই রাজী করানো যাচ্ছেনা, এখন মেয়ের মন খুব খারাপ। মা বিষয়টি লক্ষ্য করলেন, এবং বাবাকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজী করালেন। মেয়ে এখন মহাখুশী।
এক্ষেত্রে যে মেয়েটি মা'র সাথে সাবলীলভাবে সব শেয়ার করে যে হয়তো বাবার রাজী হবার খবর জানার পর দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরবে, বেশী আহ্লাদী হলে "থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, সুইট মাম্মি" বলে কেঁদে ফেলবে, আরো আহ্লাদী হলে পাপ্পি দেবে -- অর্থাৎ তার আনন্দ আর ভালোবাসার প্রকাশ ঘটবে সবরকমে। অন্যদিকে যার ভাবপ্রকাশে কিছুটা সংকোচ আছে সেও খুশী হবে, মার প্রতি কৃতজ্ঞ হবে, হয়তো তার ইচ্ছে হবে মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে একটুক্ষণ বসে থাকতে। হয়তো সে এসব কিছুই করবেনা, চুপচাপ গিয়ে মায়ের খাটের পাশে বসে ঘন্টাখানেক মা'র সাথে এটা ওটা গল্প করবে, হয়তো একটু হাতটা ছুঁয়ে দেবে অথবা দেবেনা। আবার এককাঠি বাড়া অনেকে হয়তো উল্টো কৃতজ্ঞতা ঢাকার জন্য এমনভাব করবে যেন বাবাকে রাজী করানোর ব্যাপারটায় সে বিন্দুমাত্র আলোড়িত হয়নি, নেপাল ঘুরতে না গেলেও তার তেমন ক্ষতি হতোনা (এরকম চরিত্র সাধারণত আমরা নাটক-সিনেমায় দেখি, বাস্তবেও হয়তো আছে)।
এখন উপরের উদাহরণে কোন মেয়েটির সাথে মায়ের সম্পর্ক বেশী গভীর বা বেশী ভালোবাসার? এই জায়গায় এসে একটা ধাক্কা খাই।
পুরো ব্যাপারটাই হয়তো যার সাথে সেমন আচরণ করে এসেছি তারই একটা কন্টিনিউয়েশন। যে বাবার কাছ থেকে হাজারবার উপকৃত হবার পরও কখনও "ধন্যবাদ" বলা হয়নি, তাঁকে হঠাৎ করে একদিন "ধন্যবাদ" বলা কঠিন। ধন্যবাদের মতো সুন্দর, মসৃণ, চমৎকার একটি কথাও তখন অস্বস্তিকর হয়ে দেখা দেয়, মনে হয়, এই সম্পর্ক এমনই গভীর যে এখানে "ধন্যবাদ" বড় ন্যাকা হয়ে যায়। বন্ধুদের বেলায়ও তাই। খুব কাছের বন্ধুকে যত সহজে "ঐ হারামজাদা আমার এসখ টাকা ফেরৎ দেসনা কেনো?" বলা যায়, গভীর কৃতজ্ঞতাবোধ জানাতে "ধন্যবাদ" বলাটা ততই কঠিন হয়ে পড়ে।
হয়ত "ধন্যবাদ" বললে সাথে সাথে সে হো হো হো হো করে ফেটে পড়বে, বলবে, "শালা পুরা জাপানী হয়া গেছস!"
ভাষার সাংস্কৃতিক বিবর্তন:
উপরে আলোচিত আবেগ প্রকাশ/অপ্রকাশের ব্যাপারটি যে শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে ঘটে তা না, বরং এর একটি সাংস্কৃতিক চেহারাও আছে। যেমন, আমি এখানে এসে প্রথম বছরটি যখন জাপানী ভাষা শিখেছিলাম, তখন আমাদের ডর্মে প্রায় চল্লিশটি দেশের ছেলেমেয়ে থাকতো। এদের মধ্যে আলোচনার একটা প্রধান বিষয়ই ছিলো পরস্পরের ভাষার অভিবাদন আর গালমন্দগুলো জানা। তখন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি আমাদের বাংলা ভাষায় অভিবাদনের কত অভাব! তাও পুস্তকে যতটা আছে, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে অভিবাদন বাংলা ভাষায় বা আরো নিঁখুতভাবে বললে বাঙালীর মুখে যে তেমন জায়গা করে নিতে পারেনি সেটা বুঝেছিলাম। এটা হয়তো সরাসরি আমাদের সাংস্কৃতিক আচারের সাথে জড়িত, আমরা অনুভূতিকে সরাসরি প্রকাশ করিনা।
কারো বাসায় বেড়াতে গিয়ে খাবার টেবিলে প্রত্যেক পদে কামড় বসিয়েই "উহু, আহা" করে খাবারটি যে কত মজা হয়েছে তার প্রকাশ আমরা করিনা। অধুনা বন্ধু-বান্ধবদের বাসায় এর চল হলেও, আমি এখনও কল্পনা করতে পারিনা যে খালাদের বা ফুপুদের কারো বাসায় গিয়ে খেতে খেতে বলছি, "রান্না দারুণ হয়েছে!" নিশ্ছিত উনারা ভাববেন যে "ছোকরা দুপাতা জাপানীজ পড়ে ফরমাল ফুলবাবু হয়েচেন!!"
এটা নিয়ে পশ্চিম আর পূবের বিতর্কও চলছে অনেকদিন। পশ্চিমা সিনেমা, নাটক নভেল তো বটেই, বাস্তবজীবনে বন্ধুবান্ধবদেরও দেখি যখন তখন স্ত্রী বা প্রেমিকাকে "লাভ ইউ হানি" বা এরকম কাছাকাছি কোন বাক্যে মনের ভাব জানাচ্ছে। পূবের লোকেরা এটা দেখে অনেক হাসে, বলে, এটা কি রকম কথা! প্রতিদিন বলে বলে নিশ্চয়তা দিতে হবে নাকি? পূবের লোকেরা হয়তো জীবনে একবার/দূবারই বলে এমন "লজ্জা-শরমের"(ব হুব্রীহির কাদেরের ভাষা ধার করলাম) কথা, অনেকে হয়তো কখনই বলেনা। জামালউদ্দিন হোসেন আর রওশন আরা বেগমের এরকম একটা নাটকও একবার বিটিভি দেখিয়েছে, যেখানে ভদ্রলোক কোনদিন স্ত্রীকে "সুন্দর লাগছে" বলার মতো অস্বস্তিতে পড়তে চাননি।
শেষকথা:
যাই হোক, তথ্যপ্রযুক্তির লাগামহীন ঘোড়ার তালে পৃথিবীতে যে জিনিসটা খুব দ্রুত ঘুচে যাচ্ছে তা হলো সাংস্কৃতিক ব্যবধান। আমি কল্পনাই করতে পারিনা যে মামার বাসায় ফোন করে বলবো, "হ্যাপি বার্থ ডে, মামা"; কনফার্ম ওপাশ থেকে চীৎকার শোনা যাবে, "হারামজাদা, ফাজলামী করস!" অথচ আমার ভাগ্নী-ভাগ্নেরা কি সাবলীলভাবে এসব অভিবাদন আয়ত্ব করে নিচ্ছে, জন্মদিনে ফোন করে সমস্বরে "শুভ জন্মদিন" জানায়, কথায় কথায় "থ্যাংক ইউ" বলে।
এমনকি নিজের বেলায়ও দেখতে পাই, বাসার লোকের সাথে যে ভদ্রতা বা সৌজন্যতাটুকু কোনদিন করবোনা, বন্ধুদের সাথে সেরকম সৌজন্যতা হরহামেশা করছি। কারো বাসায় দাওয়াত খেতে গেলে দু'চার ডিগ্রী বাড়িয়েই খাবারের প্রসংশা করি, অভিবাদনের ব্যবহার এই পরিমন্ডলে অনেক সাবলীল। এখানেও হয়তো সম্পর্কের গভীরতার প্রশ্নটা চলে আসে, যাই হোক সেদিকে আর না গিয়ে যেটা বলতে চাচ্ছি তা হলো, আমরা পূবের লোকেরা কি ধীরে ধীরে বদলাচ্ছি?
আলোচনার বিষয় হতে পারে,
বদলানো কি উচিত? এরকম কড়ায় গন্ডায় প্রকাশবাদী হয়ে যাওয়া উচিত আমাদের? না ভাববাদী যে অনুভূতির প্রকাশ, যা অদৃশ্য এবং অনেকের কাছে ভাবনার অতীত সেটাকে আঁকড়ে রাখা উচিত?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।