শুকনো ঘাসের শুন্যবনে আপন মনে , অনাদরে অবহেলায় গান গেয়েছিলেম।
সেই কলেজ জীবন থেকেই রেজোয়ান কবির শিল্প সাহিত্যে যেমন প্রতিভার সাক্ষর রেখেছিলেন তেমনি বাকপটুতায়, নম্র ভদ্র আচরণে ও সর্বোপরি চলনে বলনে অসাধারণ স্মার্টনেসের কারণেই সকল সময় সকখানেই মধ্যমনি হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
যত স্মার্টই হোননা কেনো স্কুল কলেজের স্কলারশীপগুলো না থাকলে এতখানি উঠে আসা যে কিছুতেই সম্ভব হতনা তার পক্ষে এ তিনি ভালো করেই জানেন। কারন ক্ষুরধার বুদ্ধি ও অসাধারন ফলাফল থাকার পরেও মানুষের জীবনের অনেককিছুই থেমে যায় দারিদ্রের কষাঘাতে।
দরিদ্র স্কুল মাস্টার বাবার ঘরে ১০ ভাইবোনের মাঝে বেড়ে ওঠা রেজোয়ান কবির সে কথা খুব ভালো করেই জানেন।
কলেজের গন্ডি ডিঙিয়ে যখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। তখনি তিনি থমকে দাড়ালেন যাকে দেখে তাকে দেখে থমকানো বা চমকানো যে কোনো ভাবেই তার মত মানুষের জন্য উচিৎ নয় তা বুঝিয়ে দিতে তাকে আর কারো প্রয়োজন পড়ে না।
দুগ্ধধবল রাজহংসী গ্রীবা ধারিনী বড়লোকের একমাত্র বিদুযীকন্যাটিকে দেখামাত্র তার মনে হয়েছিলো এমন কাউকে দেখেই হয়তো কবি লিখেছিলেন,
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের' পর
হাল ভেঙে যে- নাবিক হারায়েছে দিশা!
না কোনোমতেই এই সব আকাশ কুসম কল্পনাকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবেনা এমনটাই ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু কখনও কখনও যে আকাশ কুসুম স্বপ্নও ধরায় ধরা দেয় তারি প্রমান পেলেন তিনি যখন বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে মার্জিয়া নিজে যেচে পড়ে তাকে বললো,
-আপনার আবৃত্তি আমার দারুন লাগে! আমি আপনার একজন ফ্যান!!
নিজের কানকেও বিশ্বাস হচ্ছিলোনা যেন তার।
সেই পরিচয়ের শুরু , পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা।
যত গভীর প্রেমেই হাবুডুবু খাক তারা মার্জিয়ার বড়োলোক বাবা যে কোনোমতেই রাজী হবেন না তার কন্যার সাথে রেজোয়ান কবিরের বিয়েতে, সেবেশ ভালো করেই বুঝে গিয়েছিলেন দুজনেই।
তাই শেষবর্ষের পরীক্ষার পরপরই রেজোয়ান কবির তার অসাধারন ফলাফলটি নিয়ে স্বনামধন্য এক পত্রিকা অফিসে খুব ছোটোখাটো একটি চাকুরী জুটিয়ে ফেললেন আর বিয়ে করে ছোট একটি ফ্লাটে উঠে গেলেন মার্জিয়াকে নিয়ে।
মার্জিয়ার বাবা তার আদরীনি কন্যার এমন নির্বোধ কান্ডে বিস্মিত ও বিরক্ত হয়ে তাদের সাথে সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন।
কিন্তু বিয়ের দু বছরের মাথায় মার্জিয়ার অন্তসত্বা হবার খবর কোথা মায়ের কানে ঠিক ঠিক পৌছে গেলো ও অনেক অনুনয় অনুরোধে বাবাকে রাজী করিয়ে মা জামাই সহ মেয়েকে তার বাড়িতে নিয়ে উঠালেন। একমাত্র আদরের দূলালীকে এই অবস্থায় রেখে কোন মা পারে সুখে নিদ্রা যেতে?
সন্তান জন্মের পরে ফুটফুটে নাতীটির মুখের দিকে তাকিয়ে মার্জিয়ার বাবার ক্ষোভ রাগ দুঃখ কিছুটা প্রশমিত হলো।
এমনিতেই উনার বয়স হয়েছে তার বিশাল ব্যবসা বানিজ্য অর্থ কড়ি দেখবার ভার তিনি জামাই এর উপর ছেড়ে দিলেন। তিনি বিচক্ষন বুদ্ধিমান মানুষ। লোক চিনতে ভুল করেননি কখনও।
হৃদয় গভীরে প্রোথীত চীর উচ্চাকাংখী মনোভাবের কারনেই হোক বা সহ জাত প্রতিভার কারনেই হোক সারা জীবনে শ্বসুরমশাই যে প্রতিপত্তি অর্জন করেছিলেন তার কয়েকগুণ বেশী করে ফেলেলন রেজোয়ান কবির কয়েক বছরের মধ্যেই।
দু চোখ মুদবার আগে শ্বসুরমশাই জেনে গেলেন তার তিলতিল করে গড়ে তোলা বিপুল সম্পদরাশী যোগ্য লোকের হাতেই পড়েছে।
শুধু মার্জিয়া সন্তানকে ঘিরে ধিরে ধিরে গড়ে তুললেন এক আলাদা পৃথিবী। আর রেজোয়ান কবির অর্থ ব্যাবসা বাড়াবার এক নেশায় মেতে উঠলেন। খুব অদৃশ্য এক দেয়াল গড়ে উঠলো দুজনার মাঝে।
রেজোয়ান কবির ভুলেই গেলেন এক সময় তিনি কবিতা লিখতেন আর মার্জিয়া আন্তজেলা নজরুলগীতি চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। তিনি আবৃত্তি করতেন আর মার্জিয়ার সুকন্ঠি সঙ্গীতর মূর্ছনায় মুখরীত হত আকাশ বাতাস।
২
রেজোয়ান কবিরের শরীর- মনে, চলনে বলনে, পোষাক- আষাকে তার শৈশব কৈশোরে বেড়ে ওঠা পরিবেশের ছিটেফোটা লক্ষন আর নেই। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিস, ঝকঝকে কয়েকখানা গাড়ী, চারিদিকে চাকচিক্যের জৌলুসে একজন সফল মানুষ তিনি। দীর্ঘ শরীরে খানিক মেদের আভাসেও স্থুল দেখায়না তাকে। ব্লাডপ্রেসার , ডায়াবেটিস টাইপ কোনো রোগ বালাইও নেই তার।
তবে মার্জিয়া একটু একটু করে ক্ষয়ে গেছে ভেতরে ভেতরে আর তা তার বাইরের আবরণেও ছাঁপ ফেলেছে বেশ।
কর্মব্যাস্ত রেজোয়ান কবিরের সেদিকে তেমন ভ্রুক্ষেপ নেই তবুও তারি ভেতরে মাঝে মাঝে চমকে ওঠেন , ভাবেন এই কি সেই মার্জিয়া? যাকে দেখে একদিন তিনি কবিতা লিখেছিলেন? তবে মার্জিয়ার চোখেও স্বামীর পরিবর্তনটা এড়ায় না। মার্জিয়া ভাবে কোথায় সে বলিষ্ঠ সৌন্দয্যমন্ডিত মুখ রেজোয়ানের! কেমন একটা ধূর্ততার ছায়ার আভাস দেখে চমকে ওঠেন তিনি । আলগোছে বুঝি দীর্ঘশ্বাসও বেরিয়ে আসে।
রেজোয়ান কবির ভেতরে ভেতরে আজকাল কি এক তাগিদ অনুভব করেন। ভাবেন তিনি কি বুড়িয়ে গেছেন? ভেতরে ভেতরে খুব সুপ্ত ইচ্ছা জাগে তার দু একজন বন্ধুদের মত যৌবন যাচাই করে নেবার।
তারতো সুযোগের অভাব নেই। তবে ভয় তার মার্জিয়াকে। ঐ শান্ত শীতল সর্পচাহনী যে তার অন্তসথল পর্যন্ত দেখে ফেলতে পারে।
শেষ পর্যন্ত সাহসী হয়ে ওঠেন তিনি। নতুন মহিলা সেক্রেটারী ইন্টারভিউ এর দিনে তার সকল শক্তির পরাজয় ঘটলো।
রেজোয়ান কবিরের মনে হলো মেয়েটির ব্যাক্তিত্তে নয় তার প্রগলভতায়, তার হাস্যে ও লাস্যে ও দেহবল্লরীতে কুল হারালেন তিনি।
শেষ পর্যন্ত মার্জিয়ার কাছে এক গাঁদা মিথ্যে বলে কক্সেসবাজার যাবার নাম করে ও একসপ্তাহের ট্যুরের কথা বলে নতুন সেক্রেটারী মীরাকে নিয়ে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের বলাকা ডানায় ভর করে উড়াল দিলেন তিনি।
একসপ্তাহের জায়গায় যখন ১০দিন কেটে গেলো এবং ফোনে বা ইমেইলেও কোনো যোগাযোগ করতে পারলেন না তখন উদ্বিগ্ন হয়ে অফিসে ফোন করলেন মারজিয়া।
অফিসের এক বুড়ো পুরোনো কর্মচারীর কাছে যে খবর পেলেন তাতে পুরো পৃথিবী ঘেন্না দুঃখ ও অপমানে টলে উঠলো তার চোখের সামনে।
দু সপ্তাহ পরে ফিরলেন রেজোয়ান কবির,
মেইন গেটটা পার হয়ে বাড়ীতে ঢুকবার দরজায় দাড়িয়ে মার্জিয়াকে দেখলেন তিনি।
মার্জিয়া শান্ত গলায় শুধু একটা কথা বললেন,
- এ বাড়ীতে ঢুকবার অধিকার হারিয়েছো তুমি রেজোয়ান।
খুব অবাক হয়ে বোকার মত বলে উঠলেন রেজোয়ান কবির।
-স্বামী স্ত্রীর একি বাড়িতে থাকবার অধিকার আছে।
-তোমাকে আজ থেকে স্বামী বলে আমি আর মানতে পারছিনা। তুমি সব অধিকার হারিয়েছো আর ভুলে যেওনা এই বাড়ীটা, গুলশানের বাড়ী, আমার যত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির মালিক আমি ।
আমার বাবা আমাকেই দিয়ে গিয়েছেন। তুমি কর্মচারীর দায়িত্ব পালন করেছিলে মাত্র। স্বামীত্তের অধিকারে তুমি ভুলে গিয়েছিলে তুমি মালিক নও এসবের।
প্রচন্ড অপমানে বেরিয়ে এলেন রেজোয়ান । মীরার ছোট ছিমছাম ফ্লাট টায় গিয়ে দরজায় দাড়িয়ে ঘামতে লাগলেন।
নতুন করে শুরু করতে হবে সব । রেজোয়ান কবির হারতে জানেননা।
কলিং বেল বেজে চলেছে । মীরা এসে দরজা খুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো,
- কি হলো রেজোয়ান সাহেব? আপনি ফিরে এলেন যে?আসুন আসুন ..
রেজোয়ান কবির দরদর করে ঘামছেন। অপমান ঘৃনায় রক্তবর্ণ ধারন করেছে মুখখানি।
- মীরা তোমার সাথে আমার কথা আছে।
- কথা?
-হ্যা ভাবছি কিছুদিন তোমার ফ্লাটেই থাকবো। আচ্ছা একবারে তোমার এখানে থেকে গেলে কেমন হয়?
- হ্যা মন্দ হতনা। তবে পরশু আমার হাসব্যান্ড আসছে ।
-তোমার হাসব্যান্ড? আর্তনাদের মত শোনার রেজোয়ান কবিরের কন্ঠ।
-তুমি ম্যারেড? অথচ তুমি ...
-অথচ আমি আপনার সাথে ফ্লার্ট করেছি। আপনার সাথে সফরে গিয়েছি? আপনার সাথে রাত কাটিয়েছি?
তো আপনারও তো ওয়াইফ আছে। আপনিও তো ম্যারেড। অথছ আপনি কি করে রাত কাটালেন আমার সাথে?
সতীত্ব কথাটা কি শুধুই মেয়েদের জন্য?
বাকরুদ্ধ রেজোয়ান কবির মীরার মুখের দিকে চেয়ে হতবিহ্বল দাড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর হনহন করে বেরিয়ে গেলেন কোনো এক অজানার উদ্দেশ্যে।
সামান্য কৌতুহল আর একটু ভুলের কারনে আজ সব কিছুই হারালেন তিনি।
মাথার ভেতর ঘুরঘুর করতে লাগলো একটি প্রশ্ন। "সতীত্ব শব্দটি কি শুধুই মেয়েদের জন্যে?"
উত্তর জানা নেই রেজোয়ান কবিরের কিন্তু কারো কাছে কি আছে, আর কারো কি জানা আছে এ প্রশ্নের উত্তরটি?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।