আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার রান্না, কান্না এবং বান্না

মনের জানালায় দাঁড়িয়ে ভাবনাগুলোর মিলিয়ে যাওয়া দেখি। গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ হয়ে, ঐ দূর দিগন্ত পানে...

আমার জন্য রান্না হচ্ছে নিজেকে পরিহাস করার এক মোক্ষম হাতিয়ার। অবশ্য পরিবারের সাথে থাকবার ফলে সে হাতিয়ার যে খুব একটা ব্যবহৃত হয়েছে তা বোধ হয়না। তবে অনিচ্ছাসত্ত্বেও যে কয়েকবার নিজে রান্না করার ঠেকায় পড়েছি তার কিছু কাহিনী বলি। জ্বী হ্যাঁ কাহিনী-ই, পড়লে অনুধাবন করতে পারবেন যে এমন জিনিস রোজ রোজ ঘটে না।

প্রথমবার করতে হয়েছিল বিগত বছরে, যখন পরিবারের সকলে আমাকে আর আমার বাবাকে রেখে দেশে বেড়াতে গিয়েছিল। মা-র কাছ থেকে জেনে নিয়ে আমার দুইটা পছন্দের তরকারী কিভাবে রাধঁতে হয়ে লিখে রেখেছিলাম। মা যেভাবে বললো, তাতেতো মনে হয়েছিল একেবারে পান্তা ভাতের মতো সহজ। (গরম ভাতে পানি দিলেই পান্তা ভাত হয়ে যায় বলেই এটা সহজ। হাহাহা) তো একদিন সে মাহেন্দ্রক্ষণ এলো।

রাঁধতে নেমেছি ডিম দিয়ে কদু। আমার খুব পছন্দের একটা তরকারী। মা এমন মজা করে রাঁধেন যে মনে হয় চেটেপুটে সব খেয়ে ফেলি। যাক সে কথা, কোনোভাবে কেঁদে কেটে চোখ ভাসিয়ে (পেয়াজ কাটার ফল), চুলোয় দিয়ে, মরিচ, মসল্লা, পানি দিয়ে গ্যাস দিয়ে কিছুক্ষণ পর চেহারা কেমন হয়েছে দেখতে যেয়ে আমার হাত থেকে ঢাকনাটা আরেকটু হলেই পড়ে যায় আর কি! এ কি বর্ণ ধারণ করেছে! সব পানি হাওয়া। তলায় অসহায়ের মতো পরে আছে কদুগুলো।

আবার পানি ঢেলে কোনোমতে কদুগুলোর পায়েটায়ে পরে যখন মনে হল মুখে দেওয়ার উপযুক্ত হয়েছে, মুখে পুরে দেখি লবণ দিতেই ভুলে গিয়েছি। তাও বা লবণ দিয়ে খাওয়া যেত কিন্তু হলুদ মশলা একাকার হয়ে যে জিনিসটা দাড়িয়েছে সে মুখে দেয়া গেলেও গলধঃকরণ করা যায় না। কি আর করা, ফেলে দিতেও মায়া লাগছিল। আমার প্রথম রান্না! শেষে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখে কদুর শোকে শোকাহত হয়ে বাইরে থেকে খাবার নিয়ে এসে সে যাত্রা পার হলাম। সেবার আর রান্না করার সাহসে কুলোয় নি।

অবশ্যি আমাদের বেশকজন বাঙ্গালী প্রতিবেশির সাথে পারিবারিক ভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকায়, আন্টিরা সপ্তাহের খাবার রেঁধে পাঠিয়ে দিতেন আমার আর বাবার জন্য। ... এর পরের বার রান্নামুখো হতে হয়েছে আজ। তার আগে আমার পরিবারের বাসিন্দাদের কথা কিছু বলি। বাসায় আমি, আমার ছোটো ভাই, বোন, বোনের জামায় আর আমাদের সকলের আদরের মণি, বোনের পিচ্চি মানে আমার ভাগ্নে। ছোট্ট এই পরিবারটা মূলত চলে 'আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে' স্টাইলে :=)।

কেউ কারো উপর কতৃত্ব ফলাতে পারেনা। তার উপর আমার ভাগ্নে এবং তার বাবা নিজেদের নামে বেশ কটা রাজার উপাধি নিয়ে বসে আছেন। একবার হয়েছে কি, আমার বোন নাকি আমাদের সে না থাকলে কি হবে এই শিক্ষা দেয়ার জন্য ব্যাগ বেধে ছেলেকে নিয়ে গিয়ে উঠে এক বান্ধবীর বাসায় (অবশ্য পরে জানতে পারি, সে গিয়েছিল বান্ধবীর ভাইয়ার বিয়েতে। কিন্তু যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিল, "আমি আর ফিরছিনা")। খাবার কিনে খেতে খেতে আমাদের তিনজনেরই বাস্তবিকে তখন শিক্ষা হয়ে গিয়েছিল।

তিনজনেই তখন একমত হয়েছিলাম যে, আর যাই করিনা কেন রান্না যিনি করেন তাকে চটানো যাবেনা। অবশ্যি আমার বোনের মতো বোন হয়না। ফিরে আসি আজকের কথনে। বোন, তার পিচ্চি আর আমার ছোটো ভাইটা গিয়েছে আমার এক খালার কাছে। ভাইয়ের স্কুলে সামারের ছুটি তাই সবাই মিলে খালার কাছে গিয়েছে বেড়াতে।

থাকবে বেশ কিছু দিন। এর মধ্যে অবশ্য এক হপ্তা পেড়িয়ে গিয়েছে। যাবার বেলায় সে রেঁধে দিয়ে গিয়েছিল আমাদের দুজনের জন্য। তরকারী ফুরিয়ে আসছে দেখে সে আজ ফোন দিয়ে জানায় কি করতে হবে। বললো, "ফ্রিজে কদু আছে।

কিভাবে রাধঁতে হবে বলছি"। আমার তখন বিগত বছরের স্মৃতি মনে করে হাসি পাচ্ছে। যাই হোক, রন্ধনশিল্প কে আর্ট ভেবে নিয়ে লেগে গেলাম তুলি নিয়ে, মানে পেয়াজ, মরিচ মসল্লা নিয়ে । পেয়াজ কাটাও যে এতো ঝক্কির কাজ কে জানতো। এবার অবশ্যি প্রতিটা স্টেপ-ই দৃঢ়তার সাথে পারছি দেখে মনে বিশ্বাস জন্মালো এবারেরটা খাওয়া যাবে।

শিল্পের কদর করতে জানলে সে নিশ্চই তার প্রতিদান দিবে। আমি অবশ্য সবসময়ই চেয়ে এসেছি রান্নাটা ভালো করে শিখতে। কিন্তু পরিস্থিতির কারণেই হোক বা অলসতায় হোক হয়ে উঠেনি। যা বলছিলাম, কিয়তক্ষণ পর যখন কদু বাবাজীর চেহারাটা দেখতে গেলাম আহ্‌! সেকি বর্ণ! দেখে বুকটা আনন্দে ভরে উঠলো। লবণ দিতে এবার আর ভুল করিনি।

স্বাদ নিয়ে বুঝলাম একেবারে আমার মনমতো হয়েছে। পরে খাবার সময় নিজের রান্না খেয়ে পুলকে মনটা ভরে ভরে উঠছিল। কেও একজন ঠিকি বলেছিল, খাওয়া হচ্ছে প্রার্থনার-ই অঙ্গ। সে প্রস্তুত করাই হোক, বা গলধঃকরণ করাই হোক। ঠিকমতো যদি করা হয় তাইলে এর চাইতে পরিতৃপ্তির বিষয় আর নেই।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।