.... তবুও আমি স্বপ্ন দেখি ... (স্বপ্ন, বাস্তব এবং ব্লগের সর্বস্বত্ব ব্লগার কতৃক সংরক্ষিত)
ইদানিং আমার গুছিয়ে লেখার ক্ষমতা কমে গিয়েছে। অন্য ভাবে বলা যায়, কেন যেন লিখতেই পারছি না। অনেকগুলো পোস্ট ড্রাফ্ট আকারে জমে আছে। শেষ করা হচ্ছে না। একটা উপন্যাসের ক্লাম্যাক্স লেখা বাকি।
সেটাও খুব একটা এগুচ্ছে না। বার কয়েক কবিতা লেখার ব্যার্থ চেষ্টা করলাম। ভাবছিলাম হয়তো একটা দুটো আবর্জনা হলেও বের হয়ে আসবে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেলো আবর্জনাও তৈরী করতে পারলাম না।
আমার খুব ইচ্ছে করে আগের মত লিখতে।
এখন ব্লগে অনেক নুতন ব্লগার। সবাই অনেক চমৎকার লেখা দিচ্ছেন। আমি নিয়মিত পড়ি সে সব লেখা। তাদের লেখা পড়ে আমারও ইচ্ছে করে বিষয় ভিত্তীক লেখা দিতে। কিন্তু সেই একই সমস্যা।
লেখা যে আর আমি শেষ করতে পারি না। সমকাল থেকে মাহবুব মোর্শেদ ভাই আর্টিকেল ধরনের লেখা চেয়েছেন। ইংরেজী বিশ্বের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখছি ওনার জন্য। কিন্তু সাতটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ননা দিতে গিয়ে, প্রথমটা তথা অক্সফোর্ডে গিয়ে আটকে আছি। কেবলই মনে হয় পরে লিখবো, পরে লিখবো।
কিন্তু সেই পরেটা আর আসে না। ব্রিটিশ মিউজিয়াম ঘুরে সেই অভিজ্ঞতার উপর একটা তথ্যপূর্ন লেখা তৈরী করার চেষ্টা করছিলাম। সরকার বদল হলো, তথাকথিত নেতারা আগের মত বুক ফুলিয়ে কথা বলতে শুরু করলো, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাথরুমে পড়ে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত পৌছে গেলো অথচ এই সাড়ে সাত মাসে আমার লেখাটা শেষ হলো না। আজ তাই নিজের উপর জেদ করে এটা লিখতে বসেছি। আমার চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে - আমি লিখতে চাই।
কি লিখতে চাই জানি না। যা খুশি মাথায় আসে লিখবো। কিন্তু লিখতে চাই।
এতক্ষন কিন্তু বেশ লিখলাম। বলা যেতে পারে প্রিরাইটিং ছিল।
সমস্যাটা হচ্ছে এখন। বিষয়বস্তুতে ঢোকার মুহূর্তে আর কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। "কি লেখা যায়? কি লেখা যায়?” - করে মাথার ভেতরে যুদ্ধ হচ্ছে অথচ কোন আইডিয়া আসছে না। ধুর ছাই...। আচ্ছা, লেখার চিন্তা বাদ দিয়ে বরং একটা গল্প শোনাই।
আমার ডাবলিন জীবনের ছোট কিন্তু সম্প্রতি দাগ কেটে যাওয়া একটা ঘটনা।
একদিন আমি বাসা থেকে বের হয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব বলে। রীতিমত দৌড়াচ্ছি, ট্রেন মিস হয় হয় করছে। ট্রিনিটিতে যাবো তাই ডার্ট (ডাবলিন সিটির স্কাই রেইল) ধরার জন্য দৌড়ে স্টেশনে গেলাম। কিন্তু গিয়ে দেখি অনলাইনে সময় দেখার সময় ভুল করেছিলাম।
ছয় মিনিট বাকি আছে তখনও। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হাঁপাতে হাঁপাতে বসলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আমার পাশে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বসেছেন। তিনি আমাকে হাঁপাতে দেখেই হোক আর অন্য কোন কারনেই হোক বারবার তাকাচ্ছেন। প্রথমে আমরা দুজনেই চুপ ছিলাম।
একটু পর ভদ্রলোকই কথা বললেন, “বৃষ্টি হবে মনে হয়। "
আসলে ভবিষ্যত কালে না বলে বর্তমান কালে বললেও হতো। বৃষ্টি তখন ফোটা ফোটা পড়ছে। আমি হেসে বললাম এবারের ইউকএন্ডটা 'সানি' হবে না। অনেকেরই মন খারাপ হবে।
ভদ্রলোক আইরিশ হয়েও একটু যেন অন্য রকম। আমার কথা শুনে সাথে সাথে বললো, “আমি বুঝি না মানুষ সান বাথ নিয়ে কি মজা পায়। আমার কাছে নিজের চামড়া পোড়ানোর মাঝে কোন মজা নেই। "
আমি একটু হাসলাম। কি বলবো আসলে বুঝতে পারছিলাম না।
তাই বোকার মতই হাসা বলা যায়।
এবার ভদ্রলোক নিজেও হেসে জিজ্ঞেস করলেন আমি কোথা থেকে এসেছি, কোন গরমের দেশ থেকে কি না ইত্যাদি। আমি জানালাম আমি দক্ষিন এশিয়ার দেশ বাংলাদেশ থেকে এসেছি। দক্ষিন এশিয়া বলার কারন অনেক সময় দেখা যায় বাংলাদেশকে চিনতে অসুবিধা হয় অনেকের। তাই বোঝার সুবিধার জন্যই এভাবে বলি।
তবে সেটা বলার দরকার ছিল না। ভদ্রলোক সাথে সাথে বললেন, “বাংলাদেশ! ১৯৭১ সনে তোমরা দারুন যুদ্ধ করেছো। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। "
আমি ঠিক বলে বোঝাতে পারবো না, কেমন লাগলো তখন। একটা মানুষ আমার দেশকে চেনে ১৯৭১ দিয়ে।
তার কাছে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের পরিচয়ের প্রধান ফলক। আরো কিছুক্ষন গল্প করার পর তিনি জানতে চাইলেন বর্তমানে দেশের অবস্থা কেমন। বর্তমান সরকারের কথা বললাম। শেখ হাসিনার কথা বললাম। চিনতে পারলেন না।
বললাম বঙ্গবন্ধুর কথা। সাথে সাথে চিনলেন। বললেন, “হি ওয়াজ অ্যা গ্রেট লিডার। ১৯৭১-এ তাঁর কথা অনেক পড়েছি পত্রিকায়। "
এ কথা সে কথায় গল্প করতে করতে ট্রেন এগিয়ে যাচ্ছিল।
বাংলা ভাষা নিয়ে কথা হলো, আমাদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি নিয়েও কথা হলো। ব্রিটিশ শাসন, বঙ্গভঙ্গ, পাকিস্থান ও ভারতের স্বাধীনতা এবং পাকিন্থান থেকে বের হয়ে আসা - কিছুই বাদ গেলো না। আমি ট্রিনিটিতে পড়ি শুনেও ভদ্রলোক বেশ খুশি হলেন। এক সময় বললেন, "তোমরা নিজেদের সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছো কিন্তু অন্যদেরটাও সম্মান করতে জানো। এটাই তোমাদের অনেক দূর নিয়ে যাবে।
" আমি কিছু না বলে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
দেখতে দেখতে তাঁর স্টেশন চলে এলা। আমি দাড়িয়ে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেলাম। তিনি সাথে সাথে বাধা দিয়ে বললেন দরকার নেই। তারপর নেমে যাওয়ার সময় আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি তোমার এবং তোমার দেশের মঙ্গল কামনা করছি।
যেখানেই থাকো, ভালো থেকো। "
এর পর কেটে গিয়েছে বেশ কিছুদিন। তবুও আমার চোখে আজও ভদ্রলোকের চেহারাটা ভাসে। খুব বেশি ভাসে যখন দেখি আমরাই নিজেদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে তাচ্ছিল্য করি। যখন দেখি বঙ্গবন্ধুর নামে খাল-বিল-বাথরুমের নামকরন করে তাঁর দলই তাঁকে হেয় করার পথ করে দেয়।
যখন দেখি আমরা নিজেরাই আসলে জানি না "একাত্তর" কত বড়!
আজ আমার নিজের প্রতিই করুনা হয়। মাঝে মাঝে প্রবল ইচ্ছে করে ডাক দেই "আরেক একাত্তর"-এর। কিন্তু সম্ভব হয় না। আমি অনেক তুচ্ছ, অনেক অনেক।
২০ জুলাই ২০০৯
ডাবলিন, আয়ারল্যান্ডে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।