আমি কিছুই লিখব না।
কোনোভাবে রুমানার শেষ রক্ষা হলেও হাইস্কুলে যাওয়া আর হলো না ফরিদার। পাঁচ ক্লাস পাস দিয়ে বসতে হলো বিয়ের পিঁড়িতে; কিন্তু বিয়েতে বাজল না সানাই, কেউ গাইল না 'হলুদ বাটো মেন্দি বাটো' গান। চুপি চুপি লাল শাড়ি পরে রাতের আঁধারে যেতে হলো শ্বশুরবাড়ি। জানাজানি হলে কেউ যদি পুলিশে খবর দেয় এ ভয়ে পাশের বাড়ির লোকজনকেও জানানো হলো পরদিন সকালে।
অশিক্ষিত, দিনমজুর বাবা-মা নিজেদের সান্ত্বনা দিল এই বলে, যাক মেয়ের একটা গতি তো হলো। কিন্তু গতি করতে গিয়ে তারা যে বেগতিক করলেন তা একবারও ভাবলেন না। মাত্র ১২ বছর বয়সী মেয়ের বিয়ে দিয়ে দণ্ডনীয় একটা অপরাধ যেমন করলেন, তেমনি সর্বনাশের চূড়ান্ত সীমায় ঠেলে দিলেন মেয়ের জীবন। সর্বনাশ তো নয়, মহা সর্বনাশ অপেক্ষা করছিল ফরিদার জন্য। এক বছরের মাথায় মা হতে গিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো ফরিদাকে।
কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার পদ্মা নদীতীরবর্তী গ্রাম ফিলিপনগরের মেয়ে ফরিদা। এই মর্মন্তুদ ঘটনার নজির বাংলাদেশের গ্রাম কিংবা শহরে মাঝে মধ্যেই দেখা যায়। ফরিদার মতো অনেক মেয়েকেই বাল্যবিবাহের নিদারুণ অভিশাপে দগ্ধ হতে হয়। বাল্যবিবাহ প্রসঙ্গে অ্যাডভোকেট কোহিনূর বেগম বলেন, প্রচলিত আইনে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ে এবং ২১ বছরের কম বয়সী ছেলের বিয়েকে বাল্যবিবাহ বলা হয়, যা প্রচলিত আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। অথচ গ্রামাঞ্চলে বেশিরভাগ মেয়ের বিয়ে হয় ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সের মধ্যে।
শহরেও নিম্নমধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের মধ্যে বাল্যবিবাহের প্রচলন ব্যাপক। বাল্যবিবাহের কুফলে সব সময় মৃত্যুর ঘটনা না ঘটলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, কেউ দীর্ঘস্থায়ী অসুখে ভোগে, কেউবা আবার শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। যেহেতু ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ে আইনসিদ্ধ নয়, তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়ের বয়স বাড়িয়ে ১৮ বছর দেখানো হয়, যাতে সেটা বাল্যবিবাহের মতো গর্হিত অপরাধের মধ্যে না পড়ে। অথচ ফরিদা জন্মনিবন্ধন থাকলে দৃশ্যপট অন্যরকম হতো। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী জানান, আইন থাকার পরও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে ১২-১৩ বছরের মেয়েদের ১৮ বছর দেখিয়ে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
তাদের যদি জন্মনিবন্ধন থাকত এবং সেই জন্মনিবন্ধন সনদ যদি বিয়েতে উপস্থাপন করা বাধ্যতামূলক করা হতো তাহলে আজ তাদের পরিণতি নিশ্চয় অন্যরকম হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক লিয়াকত আলী সিদ্দিক বলেন, বাল্যবিবাহের প্রভাব কমানোর জন্য যে কোনো বিয়েতে জন্মনিবন্ধন সনদ উপস্থাপন বাধ্যতামূলক করতে হবে। জন্মনিবন্ধন সনদ উপস্থাপন করা না হলে অভিভাবক এবং সনদ না দেখে যে কাজী বিয়ে পড়াবেন উভয়ের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
উল্লেখ্য, জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশে জন্মনিবন্ধন প্রতিটি শিশুর জন্মগত অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। ২০০৪ সালে শেষবারের মতো সংশোধন করা হয় জন্মনিবন্ধন আইন।
এ সংশোধনীর মাধ্যমে সব শিশুর জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বাংলাদেশ হেলথ সার্ভে (বিএইচএস) ২০০৫ অনুযায়ী, বাল্যবিবাহের দিক থেকে বাংলাদেশ এখনও বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে।
বাল্যবিবাহ বন্ধে চাই জন্মনিবন্ধন, চাই শত শত রুমানা। বেশ কিছুদিন আগে দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর ছিল এ রকম_ ঝিনাইদহের নিয়ামতপুর গ্রামের ১৩ বছর বয়সী অষ্টম শ্রেণী পড়ূয়া মেয়ে রুমানার বাবা হঠাৎ করেই তার বিয়ে ঠিক করেন। বিষয়টি রুমানা তার স্কুল শিক্ষিকাকে জানায়।
তিনি স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শশাঙ্ক শেখর ভৌমিকের সহযোগিতায় রুমানার বিয়ে বন্ধ করেন। রুমানার ভাগ্য ভালো যে, তার বিয়ে বন্ধ হয়েছে। অথচ ফরিদা কিংবা সখিনার মতো প্রতিদিন অসংখ্য মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে এবং সেটাকে তাদের ভাগ্য বলে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু তারা জানে না, সামান্য সচেতনতাই তাদের ভাগ্যের চাকাকে বদলে দিতে পারে।
পিআইবি ফিচার
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।