আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিশ্বায়নের দরজা : ভাষার শক্তি ও প্রত্যয়



বিশ্বায়নের দরজা : ভাষার শক্তি ও প্রত্যয় ফকির ইলিয়াস ======================================== লন্ডনের রাস্তা ধরে হাঁটছি। সাইন দেখে হটাৎ থমকে দাঁড়াই। ‘রূপসী বাংলা’। একটি বইয়ের দোকান। বিক্রি হয় বাংলাদেশের নানা কারুকাজ, স্যুভেনিরও।

দরোজায় বাংলায় লেখা সাইন ‘বই পড়ুন, বই উপহার দিন’। ক্রেতারা আসছেন দূরদুরান্ত থেকে। আসছে শিশু-কিশোররা। তারাও নেড়েচেড়ে দেখছে বাংলা বই। বাংলাদেশ বিষয়ে বই।

এভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত আলো ছড়াচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, সুকান্ত, শামসুর রাহমান। ভাষার বিশ্বায়ন নিয়ে ভাবলেই প্রথম আমার যে দিকে নজর পড়ে, তা হচ্ছে একটি ভাষাভাষী মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থান। যে রাষ্ট্রটি যত বেশি অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ- তার ভাষাই বিশ্বে তত বেশি সমাদৃত। চীন তার প্রথম উদাহরণ। অর্থাৎ সব প্রতিকূলতাকে ডিঙিয়ে অর্থনীতির ভিত মজবুত করাই চীনাদের লক্ষ্য।

অর্থ এবং অর্থই তাদের কাছে অন্যতম আরাধ্য বিষয়। না, তারা দুর্নীতি করে উপার্জন করছে না। তারা শ্রম দিচ্ছে। বিশ্ববাজারে তুলনামূলক কম পারিশ্রমিকে তারা খাটছে। ফলে বিশ্বের অন্যতম ব্যবসায়ী দেশগুলো তাদের প্রস্তুতকারক হিসেবে চুক্তিটি চাইনিজদেরই দিচ্ছে।

‘মেড ইন চায়না’ এখন বিশ্বের অন্যতম বাণিজ্য বিলবোর্ড। চক্রবৃদ্ধি হারে এভাবেই ব্যবসায়ীরা ঝুঁকছে চায়নার দিকে। একটি ভাষার বিশ্বায়নের প্রয়োজনীয়তার কথা ভাবলে, আরো কিছু প্রাসঙ্গিকতা আসে। এর অন্যতম একটি হচ্ছে সেই রাষ্ট্র-সমাজের পরিশুদ্ধ সংস্কৃতি। এখানে মনে রাখতে হবে- ‘আমাদের হাজার বছরের উজ্জ্বল সংস্কৃতি রয়েছে’- এই বাণীটি প্রচার করলেই কিন্তু বিশ্ববাসীকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করা যাবে না।

সংস্কৃতির পরিম-লটিকে দর্শনীয় করে তুলতে হবে। এগুলোকে আকর্ষণীয় করে গড়তে হবে। যাতে তা দর্শক-পরিব্রাজকদেরকে টানতে সমর্থ হয়। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের কথা বলতে পারি। বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থান, নিদর্শন, ঐতিহ্যগুলোকে যদি পরিকল্পিতভাবে, সুনিপুণ হাতে গড়ে তোলা যায় তবে বাংলাদেশও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একটি নান্দনিক ট্যুরিস্ট জোন হতে পারে।

এর প্রধান বাধা, রাষ্ট্রপক্ষের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর দূরদৃষ্টির অভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অসহনশীলতা ইত্যাদি। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি ৩৮ বছর পেরিয়ে এসেও এইসব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আসতে পারছে না কেন? কারণ কি? সেগুলো খুঁজে দেখা খুবই জরুরি। বাংলা ভাষা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে অভিবাসী বাঙালির মাধ্যমে। এখানে আরেকটি কথা জরুরি। তা হচ্ছে, বিদেশে জন্ম নেয়া বাঙালি প্রজন্ম কিন্তু বাংলা ভাষার ব্যাপারে অধিক হারে আগ্রহী হচ্ছে না।

এর অন্যতম কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি ঐতিহ্য, কৃষ্টির সঙ্গে তাদের যোগাযোগ কিংবা সমন্বয়ের অভাব। এই কাজটি ব্যয়সাধ্যও বটে। কারণ প্রতিবছর ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে সপরিবারে বাংলাদেশ ভ্রমণ নানা কারণেই সম্ভব নয়। হয়ে উঠেও না। ফলে বিদেশেই নিজ নিজ বলয়ে শিকড়ের অন্বেষণে ব্রতী হওয়ার গুরুত্বটি এভাবেই বেড়ে যায়।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষাকে ছড়িয়ে দেয়ার আরেকটি দরকারি পথ আছে। সেটা হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের মূল প্রবাহের শক্তিটিকে বিশ্বধারায় পৌঁছে দেয়া। এ কাজটিও সহজসাধ্য নয়। কারণ দেখা গেছে, কোনো সাহিত্যের সঠিক অনুবাদ না হলে মূল চেতনাটি অনুবাদে প্রকাশিত না হলে, তা বিশ্ব পাঠকের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয় না। তাহলে এই অনুবাদ কর্মটি হবে কিভাবে।

আমরা দেখেছি বাংলা সাহিত্য অনুদিত হলেই তা বিশ্ব দরবারে পৌঁছে যাবে- এমন একটা প্রবণতা অতীতে ছিল। এর সূত্র ধরে কিছু অনুবাদকর্ম হয়েছেও। কিন্তু তা অনেকেরই নজর কাড়তে পারেনি। এরচেয়ে বরং উপমহাদেশের বাঙালি লেখক যারা সরাসরি ইংরেজিতে লেখেছেন কিংবা লিখছেন- তারা বেশি প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে একজন অরুন্ধতি রায়, ঝুম্পা লাহিড়ী কিংবা তাহমিনা আনামের নাম আনন্দের সঙ্গে প্রণিধানযোগ্য।

আরেকটি বিষয় আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে। তা হচ্ছে, বাংলা ভাষাটিকে আমরা বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য করার প্রচেষ্টার পাশাপাশি বাংলা সংস্কৃতির সৌন্দর্যকে সিংহভাগ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাবার প্রচেষ্টা রাখতে হবে নিরন্তর। ভাষার প্রত্যয় এবং প্রত্যাশা নিয়ে যে কবি একটি কবিতা লিখেন কিংবা যে নাট্যকার একটি নাটক লিখেন তার একটা সার্বজনীন আবেদন থাকে। আর এই আবেদনটিই হচ্ছে বিশ্ব মানুষের কল্যাণ কামনা কিংবা শান্তি প্রতিষ্ঠার অব্যাহত প্রার্থনা। আমি মনে করি বিশ্বের প্রতিটি ভাষাতেই যেহেতু স্রষ্টা, প্রকৃতি এবং প্র্রেমের গুণকীর্তন করা হয়, সেহেতু প্রতিটি ভাষাই মানব আত্মার অনুরণন।

ব্রিটেন কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী বাঙালির সংখ্যা বেশি থাকায় এসব দেশে বাংলা ভাষার কদর ক্রমশ বাড়ছে। লন্ডন কিংবা নিউইয়র্কের কোনো হাসপাতালে, উকিলের দফতরে-‘আমরা বাংলায় কথা বলি’-এমন সাইন দেখে এখন আর চমকে উঠতে হয় না। বাঙালি ক্লায়েন্টদেরকে সেবা দেয়ার আন্তরিকতার জন্যই এমন ব্যবস্থা। ভাষার বিশ্বায়নে অর্থনীতিও যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত- এটি তারই একটি উদাহরণ। খুব আনন্দের কথা, আজ জাতিসংঘে বাংলা ভাষাকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উঠছে।

লন্ডনের আলতাব আলী পার্কে গড়ে উঠেছে স্থায়ী শহীদ মিনার। একইভাবে স্থায়ী শহীদ মিনার গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চলছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ আরো কিছু দেশে। আজ থেকে দুই দশক আগে এই নিউইয়র্কেও বাংলা বইয়ের ভালো কোনো সংগ্রহ ছিল না। আজ তা শুধু সম্ভবই হয়নি বরং বই বিপণিগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে সুবিশাল পাঠক সমাজ। বাড়ছে বাংলা গান, কবিতার ক্যাসেট, সিডি, ভিসিডি এগুলোর কদরও।

লন্ডন, নিউইয়র্ক, ফ্রাঙ্কফুর্ট, সিডনি, টরেন্টোতে আয়োজন হচ্ছে বাংলা বইমেলার। নিউইয়র্কে ‘বাঙালির চেতনামঞ্চ’ এবং ‘মুক্তধারা’র উদ্যোগে মহান শহীদ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের গোড়াপত্তন হয়েছিল আজ থেকে দেড় যুগ আগে। গেল তিন বছর যাবত বইমেলা পরিণত হয়েছে ‘বাংলা উৎসব এবং বইমেলা’র। ‘মুক্তধারা ফাউন্ডেশন’ এর পুরো দায়িত্ব নিয়েছে। আমি দেখেছি কিভাবে একজন বিশ্বজিত সাহা নিজ কাঁধে বইয়ের বাক্সগুলো বহন করে ছুটে গেছেন বইমেলার আয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রের এক অঙ্গরাজ্য থেকে অন্য অঙ্গরাজ্যে।

তার নিজ হাতে পোতা ‘মুক্তধারা’র বীজ আজ আঠারো বছরের কিশোরে রূপ নিয়েছে। আজ ‘মুক্তধারা’র বইগুলোর উষ্ণতা বুকে নিয়ে সে ভবনেই বসে কবি, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের আড্ডা। সেতুবন্ধনের এই যে আয়োজন, আত্মীয়তা এবং আন্তরিকতা- বাংলা ভাষার বিশ্বায়নে সেটাও একটি সিঁড়ি। আমি বিশ্বাস করি, প্রজন্মের জন্য বিশ্বায়নের যে দরোজা এখন উন্মুক্ত হয়েছে এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে প্রত্যয়ের সঙ্গে। ভাষার শক্তি মানুষকে প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ এনে দেয়।

ভাষার মাঝেই মানুষ খুঁজে পায় নিজস্ব পরিমন্ডল। -------------------------------------------------------------------------- দৈনিক ডেসটিনি। ঢাকা । ২১ জুন ২০০৯ রোববার প্রকাশিত ছবি- ম্যাথিও ফারাল

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৩ বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.