পণ্যের বিজ্ঞাপনে নারীর উপস্থাপন এটি বাজার দখলের একটি সহজ পন্থা। কম বেশি সব পণ্যের উৎপাদক ও বাজারজাতকারী এখন এদিকে ঝুঁকেছে। সুন্দরী প্রতিযোগিতা, ফটোজেনিক বাছাই এসবের নামে বিজ্ঞাপনে নারীর ভারসাম্যহীন উপস্থাপন এখন হর-হামেশা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবগুলো বহুজাতিক কোম্পানি, বিজ্ঞাপন সংস্থা এখন সাধারণ মানুষকে পণ্যমনস্ক করতে বেছে নিয়েছে বিজ্ঞাপনে নারী অসামঞ্জস্য উপস্থাপন। সে সাথে ব্যবহার করছে গণমাধ্যমকে।
কিছু এসব আয়োজন এ দেশীয় সংস্কৃতিকে নারীর কতখানি উন্নয়নে আসছে। স¤প্রতি সমাপ্ত একটি বহুজাতিক কোম্পানি প্রচার কৌশল দিয়ে তা দেখা যেতে পারে।
লাক্স ফটো সুন্দরী মানুষের মন জয় করলেন’ ‘লাক্স ফটো সুন্দরী মাতালেন’। ‘লাক্স সুন্দরী এখন নোয়াখালীতে’। এ কয়টি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম।
ঢাকা ও স্থানীয় পত্রিকাগুলো লাক্স ফটোজেনিকদের নিয়ে বেশ কয়েকদিন এ জাতীয় সংবাদ ছেপেছে।
নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় প্রতিটি উপস্থাপনের প্রতি কোন না কোনো উদ্দেশ্য থাকে। উদ্দেশ্য প্রণোদিত উপস্থাপনই পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রথম যুক্তিগ্রাহী সংজ্ঞা।
সংবাদের প্রথাবদ্ধ চরিত্র প্রতিটি সংবাদেরই ভাবনার দরজা উম্মোচন করে। সে সুবাদে হোক কিংবা বিশ্ব ব্যবস্থার কারণেই হোক এ জাতীয় সংবাদগুলোও ভাবনার ও বলার দাবি রাখে।
প্রকাশিত সংবাদগুলোর মূল বক্তব্যের দিকে তাকালে যে কয়টি প্রত্যয় নজরে আসে সেগুলো ১. লাক্স ২. সুন্দরী। ধারণা পরিষ্কারের জন্য এ দুটি বিষয়ের সাথে সংবাদপত্র যোগ করা যায়। এ বিষয় তিনটি যেহেতু সমাজের ডাল-পাতা তাই সমাজের সাথে এদের কার কী রকম সম্পর্ক থাকা চাই তাও বলার উর্দ্ধে নয়।
প্রকাশিত সংবাদগুলো ‘সংবাদমূল্য’ নিয়ে যদি বলা হয় তাহলে বোধ হয় তা নিয়ে সকল মহলেরই কম বেশি প্রশ্ন আছে। তবুও এসব সংবাদ ছাপা হচ্ছে।
দেদারছে ছাপছে। ঢাকার পত্রিকাগুলোর পাশাপাশি স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোও ছাপছে। স্থানীয় মানুষের দুঃখ সুখ নিয়ে স্থানীয় পত্রিকাগুলো প্রকাশ পাবার কথা থাকলেও সেগুলোতেও বড় বড় হুরফে এসেছে ‘লাক্স ফটো সুন্দরী এখন মাইজদীতে’ এ জাতীয় সংবাদ। প্রকাশিত এ জাতীয় সংবাদগুলোর কমন কয়টি শব্দের একটি হচ্ছে ‘লাক্স’। লাক্স কী তা সবাই জানেন।
অনেকেই জানেন লাক্স মানে সাবান। আবার অনেকে বলেন লাক্স মানে একটি বহুজাতিক কোম্পানির উৎপাদিত পণ্য।
এ বহুজাতিক কোম্পানি দুনিয়ার অনেক দেশে তাদের পণ্য বিপনন করে। আবার মাঝে মাঝে গরিব দুঃখী ভোক্তার কথা ভেবে সাবানের সাথে মাজন, তেলের সাথে টুথব্রাশ, শ্যাম্পোর সাথে টুথপেস্ট ফ্রি দেয়। কী দরদী কোম্পানি।
ভূখা মানুষের সামনে ফ্রি-এর মুলা ঝুলিয়ে ভাত কেনার টাকায় বিউটি সোপ কিনিয়ে নেয়। এটি অবশ্য কেবল লাক্সের লিভার ব্রার্দাাসের ক্ষেত্রে নয়। এটি অপরাপর বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রেও সমান অবস্থা।
এরপরে যেটি কমন শব্দ তা হচ্ছে সুন্দরী। সুন্দরী নারীরা লাক্স ব্যবহার করে? অথবা, লাক্স ব্যবহার নারীরা সুন্দরী হয়? কোনটি সত্য? অথবা, কোনটি সত্য নয়, তবু আসল সত্য খোঁজ দরকার।
সাদা চোখে দেখা যায়, প্রতিটি কোম্পানি এখন পণ্যের বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় নারীকে পণ্যের মত ব্যবহার করে। এ ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রেই ভারাম্যহীন। আপত্তিজনক। ‘লাক্স ফটো সুন্দরী মাতিয়ে গেছেন’ এ সংবাদটি দিয়ে কী নারীর উন্নয়ন বুঝা যায়? নাকী লাক্সের উন্নয়ন বোঝা যায়? অন্যসব পণ্যের ক্ষেত্রেও একই প্রশ্ন। পণ্যের উন্নয়ন বুঝানো হয়, না নারীর? যদি নারীর উন্নয়ন বুঝানো হয় তাহলে সে উন্নয়ন নিয়ে সবশেষে আলোচনার সুযোগ রইলো।
কিন্তু পণ্যের উন্নয়ন নিয়ে কথা হলে সেখানে কেন একজন নারী। তাকে টেনেটুনে ঢাকা থেকে একটি মফস্বল শহরে এনে কাঁধে লাক্স মার্কা বেল্ট ঝুলিয়ে, সিল মেরে কোন উন্নয়ন প্রদর্শিত হয়। নিশ্চয়ই নারীর নয়। বরং নারী সেখানে ভাসাম্যহীনভাবে উপস্থিত হয় তাহলে পণ্যের বিপনণে নারী এ উপস্থাপন কতখানি উন্নয়ন সংকেত দেয়। কতখানি মানবিক হয়?
পণ্য বিপনণে বিজ্ঞাপন সহজ সিদ্ধ একটি কৌশল এবং তাই ব্যবহার করা উচিত।
কিন্তু এবার লাক্সের প্রচারে আরো বেশি কৌশল অবলম্বন করে। দুদিন আগে মাইকে লাক্স ফটোজেনিক সুন্দরী এখন আপনার শহরে এমন প্রচারে সাবানের কাটতি হয়েছে লাখ লাখ। কিন্তু সুন্দরীর উন্নয়ন কোন পথে কতখানি হয়েছে?
লাক্স ফটোজেনিকদের মফস্বল শহরগুলোতে এনে সাংবাদিক সম্মেলন করা হলো। তারপর সাংবাদিকদের সাথে ফটোজেনিকরা মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গেলেন। চমৎকার পন্থা কথা বললেন ছবি তুললেন উপহারও দিলেন।
পরদিন সাংবাদিকরাও কৃতজ্ঞতা বশত নিজ নিজ পত্রিকায় খবর ছাপালেন। এতে যা হবার তাই হলো। ফটোজেনিক এনে পণ্যের প্রতি মানুষের মনস্তাত্তিক চাহিদায় যেমন চাপ তৈরি করা হলো পাশাপাশি নিজের গুণগানের কথাও সাংবাদিকদের দিয়ে লিখিয়ে নিলেন কোম্পানির কর্তা ব্যক্তিরা।
অনস্বীকার্যভাবে এখানে সংবাদপত্রের কথা চলে আসে। এতদিন নাগাদ যে পত্রিকাগুলো ‘নারী উন্নয়ন’, নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার না করা, নারীর ভারসাম্যহীন ও গৎবাঁধা উপস্থাপন বন্ধ করার কথা বলছিল তারাই রাতারাতি সুর বদলায়।
তাদের অনেকেই এ জাতীয় সংবাদ ছাপাতে থাকে। কিন্তু আসলেই রাষ্ট্রযন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সংবাদপত্রের কী ভূমিকা হবে? সমাজ ও গণমাধ্যমের মাঝে কতখানি দূরত্ব থাকবে, নৈকট্য থাকবে তা বোধ হয় আবারো চিন্তার সময় এসেছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।