ভাষার প্রতিপত্তি, বিশ্বায়নের সমকাল
ফকির ইলিয়াস
---------------------------------
একটি ভাষা যে কোন জাতির কাছেই সমাদৃত। সে ভাষার জনগোষ্ঠী যত বড় কিংবা যত ছোটই হোক। যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী ড. জেভিন বেকন বলেন, একটি ভাষা হচ্ছে একটি জাতির মুখ্যশক্তি। ভাষা মানুষের প্রথম এবং শেষ আশ্রয়। কারণ জন্ম নিয়েই সে নিজ মায়ের ভাষায়, মায়ের আদর স্নেহ পায়।
আবার মৃত্যুর সময় নিজ মাতৃভাষায়ই শেষ আরাধনাটুকু করে যায়।
আজকের বিশ্বে সে ভাষাই তত বেশি শক্তিশালী, যে ভাষার যে রাষ্ট্রের অর্থনীতি যত বেশি চাঙ্গা তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। তার কারণ কি? কারণ হচ্ছে শক্তিশালী ভাষাভাষি মানুষরাই বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করছে। অগ্রসরমাণ প্রজন্মের শক্তি সঞ্চিত হলেই স্বীকৃতি মিলছে নিজ ভাষার। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের প্রধান প্রধান হাসপাতালে সাইন বোর্ড ঝুলছে, ‘আমরা বাংলায় কথা বলি’।
নিউইয়র্কের বোর্ড অফ এডুকেশন তাদের প্রতিটি নোটিশে এখন সংযোজন করে নিয়েছে বাংলাভাষা। নির্দেশিকায় স্খান পাচ্ছে বাংলায় নিয়মাবলি। তার কারণ প্রায় পনেরো হাজারেরও বেশি বাংলা ভাষাভাষি ছাত্রছাত্রী এখন লেখাপড়া করছে নিউইয়র্কের মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে। এখন এখানে ‘বাংলা কারিকুলাম’ চালু করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষার প্রচেষ্টা চলছে।
বিশ্বে একই রাষ্ট্রে বিভিন্ন ভাষা চালু থাকার উদাহরণও দেখি আমরা।
ভারতের কথাই ধরা যাক। কেরালা কিংবা তামিলনাড়ু অঙ্গরাজ্যের মাতৃভাষা আর কোলকাতার মাতৃভাষা এক নয়। দুটি রাজ্যের দু’জন নাগরিকের রাষ্ট্রভাষা যদিও ‘হিন্দি’ কিন্তু এই দুই অঙ্গরাজ্যে তা কি মানতে দেখা যায়? না, যায় না। বরং এই দু’অঙ্গরাজ্যের নাগরিকার মিলিত হয়ে যান এক ভাষায়। আর তা হচ্ছে ইংরেজি।
ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন মাল্টিকালচারাল কোম্পানি তাদের শোরুম খুলেছে মুম্বাই, দিল্লি, পুনা কিংবা কেরালার ট্রিচুর ডিস্ট্রিক্টে। সেখানে ভারতীয় রিপ্রেজেনটেটিভদের বলা হয়েছে, ফোনের জবাব দিতে হবে ইংরেজিতে। কারণ ক্লায়েন্ট সবাই ইউরোপ-আমেরিকার। ভাষার প্রতিপত্তি এভাবেই দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন উপনিবেশ। অর্থনীতিই হয়ে ওঠেছে মুখ্যশক্তি।
এমনকি বদলে দেয়া হয়েছে সেখানকার প্রতিনিধিদের নামও। ‘রাজেশ’ হয়ে গিয়েছে ‘রেন্ডি’, ‘মনিষা’ হয়ে গিয়েছে ‘মনিকা’। এ বদল শুধু প্রতীকী কারণের। এই সঙ্গে জড়িত ‘মাল্টিকমপ্লেক্স বিজনেস অ্যান্ড মার্কেটিং। ’
বিভিন্ন দেশেই আজ একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়, তা হচ্ছে শুদ্ধ এবং কথ্যভাষার দ্বন্দ্ব।
যুক্তরাষ্ট্রে আঞ্চলিক কিংবা কথ্যভাষায় বিভিন্ন রেপ সঙ্গীতে এমনভাবে বাণীবদ্ধ করা হয়, যার মাঝে মধ্যে অশ্লীল, অশোভন কিছু শব্দও ঢুকিয়ে দেয়া হয় খুব কৌশলে। এসব গান পারিবারিক আবহে, মাতা-পিতা-স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে বসে শোনার মতোই নয় বলা যায়। তারপরও এসব রেপ সঙ্গীতের সিডি বাজারে আসছে মিলিয়ন মিলিয়ন। এরও কারণ একটাই, বাণিজ্যিক মুনাফা অর্জন এবং তা সম্ভবও হচ্ছে।
দুই.
কবি অক্টাভিওপাজ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি লিখি আমার মাতৃভাষায়।
বাজারজাতকারীরা তা ইংরেজিতে তর্জমা করে মুনাফা লুটে। নোবেল কমিটির কাছেও ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব বেশি। তা না হলে তারা ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষায় প্রতিষ্ঠিত কবি-লেখকদের ব্যাপারে অন্তিমে এসে আগ্রহী হবে কেন?’
পাজের ক্ষোভ বাজারি মুনাফাখোরদের প্রতি। কিন্তু সে ক্ষোভ যতই তীব্র হোক না কেন, ভাষা বাণিজ্যকারীরাই পৃষ্ঠপোষকতা পায় বিভিন্ন সরকারের, রাষ্ট্র শাসকদের। এই মুনাফালাভের লোভ তো লেখকরাও সংবরণ করতে পারেন না!
বাংলাভাষা ও সাহিত্যের আলোকে একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দেই।
কোলকাতার খ্যাতিমান লেখক দেবেষ রায় সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। তিনি বাংলাদেশের কথাসাহিত্য নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণ করেছেন। তার নিজের ভাষায় তা হচ্ছে তার ‘আন্দাজ’।
কোন আন্দাজ নিশ্চয়ই কোন রাষ্ট্রের সাহিত্যকে নির্ধারণ করতে পারে না। তা নিয়ামক তো নয়ই।
এদিকে বাংলাদেশেও কিছু লেখক-কবি আছেন যারা মুহুর্মুহু কোলকাতা, পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের তীব্র বিরূপ সমালোচনা করে থাকেন। তারা তাদের ভাষায় ‘ইনডিয়া’র বাংলা বইয়ের বাংলাদেশে আগমনেরও ঘোরবিরোধী। কিন্তু বড় অবাক হয়ে দেখলাম ওই ‘আন্দাজ’ পর্বের লেখায় যাদের নাম আছে তাদের ‘ইন্ডিয়া’ বিরোধী বেশ ক’জন ওই লেখাটিকে তাবিজ বানিয়ে গলায় ঝুলাতেও কসুর করছেন না। এর কারণ কি? কারণ হচ্ছে পক্ষান্তরে সাহিত্যের বাজার-বাণিজ্যিকে স্বীকার করে নেয়। তাহলে রাষ্ট্রীয় আলোচনার মাধ্যমে কোলকাতা-ঢাকা যৌথ বইমেলা, সাহিত্য অনুষ্ঠান, ভাষা সংস্কৃতির আদান পর্ব হতে দোষ কোথায়? নাকি সেখানেও কারও কারও স্বার্থের বিষয় জড়িয়ে আছে? সাহিত্য এবং ভাষার বিশ্বায়নের সমকালে তা কি আটকে রাখা যাবে? দোষ যে কোলকাতা রাজ্য সরকারের নেই, তা আমি বলছি না।
তারাও ঢাকার বাংলা টিভি চ্যানেলগুলোকে কোলকাতায় ঢুকতে না দিয়ে একক রামরাজত্ব বহাল রাখতে চাইছেন। কিন্তু হালে তা কি সম্ভব হবে? বিবিসি, সিএনএন এর ওয়ার্ল্ড সার্ভিস দখল করে নিয়েছে এবং নিচ্ছে স্যাটেলাইট আকাশ। তাহলে বাংলা ভাষাভাষি দু’ দেশবাসীর এত দ্বিধা কেন?
তিন.
গেল এক দশক ধরে বাংলাদেশে একটি সাহিত্যকর্ম আমাকে বেশ আপ্লুত করছে। আর তা হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে সংস্কৃতি সাহিত্য নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন রাষ্ট্রের আপামর মানুষ। মণিপুরী, গারো, হাজং, মারমাসহ বিভিন্ন ভাষাভাষি তরুণ সাহিত্যিকরা এগিয়ে এসেছেন।
তারা সেসব ভাষার কবিতা, কথাসাহিত্য বাংলায় অনুবাদ করে বাংলা সাহিত্যের মূলধারায় প্রতিষ্ঠিত করছেন। তা অনুমান হচ্ছে এভাবে ইংরেজিতেও। কোন উপজাতির সাহিত্য, একটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ভাষার বাহু বলা যায়। কারণ সেসব ভাষাভাষি মানুষও একই রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি।
বলছিলাম, একই রাষ্ট্রে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার কথা।
কোন অঞ্চলের কথ্য ভাষায় সাহিত্য রচিত হবে কি না; কিংবা হওয়া উচিত কি না তা নিয়েও চলছে নানা বিতর্ক। একটি কথা মনে রাখতে হবে, একই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই একটি অঞ্চলের কথ্যভাষা অন্য অঞ্চলে সম্পূর্ণ অচল। এমন কিছু শব্দাবলি আছে যা অঞ্চলের ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্ন অর্থও প্রকাশ করে। তাহলে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসছে যিনি কোন আঞ্চলিক কথ্যভাষায় গদ্য পদ্য লিখছেন, তিনি কি এ অঞ্চলের পাটক-পাঠিকাকে সামনে রেখেই তা লিখছেন। নাকি তার জাতীয় ভাষার পাঠক তার লক্ষ্যবিন্দু।
আগেই বলেছি, ইংরেজিতে কথ্য অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে গান রচিত, গীত হচ্ছে পাশ্চাত্য। এর শ্রোতাও একটি গোষ্ঠী। বাজারি চাহিদাও রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যেও ইংরেজি ভাষার বাচনভঙ্গি, উচ্চারণের ভিন্নতা প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়। যেমন নর্থ ক্যারোলিনা, সাউথ ক্যারোলিনা, টেক্সাস কিংবা নিউইয়র্কের মানুষ একই বাচনভঙ্গিতে কথা বলেন না।
সমকালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অগ্রসর হতে যত বেশি সম্ভব ভাষার দখল শিখতে পারাটাই কৃতিত্ব বলে আমি মনে করি। যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে ওঠা কোন বাঙালি প্রজন্ম যদি বাংলাভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর গবেষণা করে বাঙালি জাতিসত্তাকে বিশ্বে আরও উজ্জ্বল করতে পারে তা তো সবার জন্যই শুভ বার্তাবাহী।
আমার একজন প্রাক্তন সহকর্মী জাপান সরকারের একটি বৃত্তি নিয়ে টোকিও যাচ্ছেন আসছে জুন মাসেই। তিনি বললেন, তার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, তিনি সেখানে গিয়ে যোগদানের আগে যদি জাপানি ভাষা কিছুটা রপ্ত করে যান তবে তাকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রে তার থাকাকালীন সময়েই তাকে ভাষা শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্খা করবে জাপানি ওই প্রতিষ্ঠান।
বিশ্ব মানবের কাছে নিজেদের ভাষা ছড়িয়ে দেয়ার এই যে চেষ্টা এবং চেতনা তা অনুসরণযোগ্য। আর এর সঙ্গে অর্থ রোজগারের বিষয় তো রয়েছেই।
আরেকটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দিয়ে লেখাটি শেষ করব। একটি সংবাদ দেশে-বিদেশে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, একজন অভিবাসী বাঙালি মহান একুশে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র ডাক বিভাগের (ইউএসপিএস) অধীনে একটি ডাকটিকেট প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছেন।
এর প্রকৃত ঘটনাটি অন্যরকম। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু লাইসেন্সধারী এজেন্ট (ঠঊঘউঙজ) রয়েছে যারা ডাকটিকিট প্রিন্ট করতে পারে। ডাক বিভাগের নিয়োগকৃত এসব এজেন্টের কাছে যে কেউ উপযুক্ত কারণ, শর্ত এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি মেনে ডাকটিকিট প্রকাশের আবেদন করতে পারেন। তা তারা মেনে নিলে সাময়িকভাবে কম্পিউটার প্রিন্ট ডাকটিকিট প্রকাশের ব্যবস্খা করে। প্রধান শর্ত হচ্ছে লক্ষাধিক ডাকটিকিট এভাবে অনলাইনে বিক্রি করতে হবে।
তা করতে পারলেই তারা ডাকঘরে ওই ডাকটিকিট বিক্রির উদ্যোগ নেবে। আসল কথা হচ্ছে অর্থ উপার্জন। অর্থ উপার্জনের উৎস করে দিতে পারলেই ভাষা সংস্কৃতি এখন আদৃত হচ্ছে বিশ্ববাজারে। তাই ভাষাকে টিকে থাকতে হচ্ছে এর সঙ্গে পাল্লা দিয়েই।
--------------দৈনিক সংবাদ।
ঢাকা। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ প্রকাশিত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।