আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যৌনতা বিষয়ক ভাবনা ০৪



সারভাইবাল ফর দ্যা ফিটেস্ট- শব্দটি সম্ভবত ডারউইন যে প্রেক্ষিতে ব্যবহার করেছিলেন শুধুমাত্র সে প্রেক্ষিতেই ব্যবহৃত হয় না এখন। বরং যেকোনো পরিস্থিতিতেই সফল ব্যক্তিদের জন্য এটা প্রজোয্য । তবে বিবর্তনের ভাষ্যে- প্রাণীদের ভেতরে যে প্রাণীই দীর্ঘ সময় টিকে থাকবে যে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে। এটা একটি প্রাণীর প্রজনন এবং সন্তান উৎপাদনের সাথে সংযুক্ত একটি ধারণা। বিবর্তন একটি প্রক্রিয়া যে প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন পরিবেশগত চলকের সাথে প্রাণীর মিথঃস্ক্রিয়া ঘটছে নিয়মিত, এবং পরিবেশের প্রভাবে প্রাণীর মৃদু পরিবর্তন ঘটছে।

এই পরিবর্তন প্রাণী ঘটাচ্ছে পরিবেশের প্রভাবে। এবং দীর্ঘ সময় ধরে একটি চলমান প্রক্রিয়ায় আমরা সম্পূর্ণ নতুন ধাঁচের একটি প্রজাতি পাচ্ছি যা আচরণগত দিক থেকে এমন কি কাঠামোগত দিক থেকে সম্পূর্ণ পৃথক একটি প্রাণী। কখন দুটো প্রাণীকে আমরা ভিন্ন প্রজাতির বলে আখ্যায়িত করতে পারি? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা একটু কঠিন। কিছু ব্যতিচার বাদ দিলে আমরা শুধুমাত্র প্রজাতিচিহ্নিত করতে পারি তাদের প্রজননের ধরণ দেখে। সাধারণত একই প্রজাতির প্রাণীদের ভেতরে প্রজনন ও নিষেক ঘটে।

অর্থ্যাৎ আমরা যেসব প্রাণী দেখি, আদতে তারা স্বপ্রজাতির সাথেই মিলিত হয়ে প্রজনন প্রক্রিয়ায় নিজের ভবিষ্যত বংশধরদের জন্ম দিতে পারে। এই ব্যবধানটুকুই আসলে প্রজাতিগুলোর ভেতরের ব্যবধান। ব্যতিচার আছে, গাধা এবং ঘোড়ার মিলনে খচ্চর নামক প্রাণীর জন্ম হয়, কিন্তু সাধারণত খচ্চরের প্রজনন ক্ষমতা নেই। একই ভাবে বাঘ এবং সিংহের ভেতরে মিলনে নতুন একটি প্রজাতির জন্ম হয়, এবং তাদের প্রজনন ক্ষমতা থাকলেও প্রকৃতিতে এদের উপস্থিতি প্রায় শূণ্য- তার একটা কারণ সাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশে বাঘ এবং সিংহ মিলিত হওয়ার সুযোগ পায় না। প্রাকৃতিক পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে যা ভালো গুণ সেটাই টিকে থাকে এবং প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারা খারাপ গুণগুলো পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত হয় না।

সুতরাং ভালোরাই টিকে থাকে প্রাকৃতিক পরিবেশে, এবং ভালোগুণগুলোই টিকে থাকে বিরুদ্ধ পরিবেশে । তবে আমাদের বিদ্যমান সামাজিক ব্যবস্থায় যেসব ভালো মন্দ নৈতিকতার ধারণা বিদ্যমান, বিবর্তনে ঠিক তেমন নৈতিকতা নেই, বরং এখানে প্রতিটা জীবই পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতা করছে, প্রতিযোগিতা নিজের জীন অন্য একটি প্রজন্মে ছড়িয়ে দেওয়ার লড়াই । এভাবেই জীবন টিকে থাকে, জীন টিকে থাকে। সুতরাং প্রায় সব সময়ই প্রাণী মাত্রই বহুগামী এবং এটাই সবচেয়ে সহজ পন্থা নিজের জীন পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে দেওয়ার। উপযুক্ত স্ত্রী প্রাণীর উপস্থিতিতে পুরুষ এবং পুরুষ শুধুমাত্র মিলিত হওয়ার জন্য লড়াই করছে এমন পরিস্থিতিই জীব জগতের প্রায় সর্বত্রই, এবং এই লড়াইয়ে টিকে থাকতে হলে একজন পুরুষ প্রাণীকে প্রচুর পরিমাণ বীর্য উৎপাদন করতে হয়।

যত বেশী পরিমাণ বীর্য থাকবে তত সেই প্রাণীর জীনের টিকে থাকবার সম্ভবনা। এবং যেহেতু স্ত্রী প্রাণীমাত্রেরই সীমিত ডিম্বানু, তাই স্ত্রীজাতীয় প্রাণী অনেক বেশী বাছাই করে পুরুষ সঙ্গীর সাথে মিলিত হয়। তবে যেকোনো সামাজিক প্রাণীর মতোই এই স্ত্রী জাতিয় প্রাণী একগামী নয়, তারাও বহুগামী এবং সুযোগ পেলে তারাও অন্য উপযুক্ত পুরুষের সাথে মিলিত হয়। বহুগামীতার ভেতরে তেমন কোনো নৈতিকতার দোহাই নেই জীব জগতে। এটাই বিবর্তণের ধারা, এভাবেই প্রতিটা প্রাণীই নিজের জীনকে ছড়িয়ে দিতে চায়।

বৈজ্ঞানিকেরা ফ্লেমিঙ্গো জুটি নিয়ে অনেক উৎসাহব্যঞ্জক কথা বললেও এই ফ্লেমিঙ্গো জুটিরাও ঠিক এক গামী নয়, অধিকাংশ সময়ই তারা বহুগামী, জীব জগতে একমাত্র বোকারাই একগামী সম্ভবত, কিংবা তারাও ঠকে যাওয়াদের দলে। এই লড়াইটা কত তীব্র সেটা বুঝা যায় পুরুষ প্রাণী এবং নারী প্রাণীর পরবর্তী প্রজন্ম বাছাইয়ের ক্ষেত্রে- পাখী, বিশেষত জলচর পাখী, তাদের উপরে নির্ভর করা পক্ষীশাবকদের সেবা ও খাদ্য খোঁজার জন্য একজন বিশ্বাসী পুরুষ পাখীর প্রয়োজন হয়, পুরুষ পাখী নিজের প্রজন্ম মনে করে মায়া মমতায় এইসব পক্ষীশাবকদের দেখাশোনা করবে। নিজস্ব শাররীক বৈশিষ্ঠ্য ও গুণাবলী দেখিয়ে যখন কোনো স্ত্রী জাতীয় পাখীকে পুরুষ পাখী সঙ্গম এবং প্রজননের জন্য প্রলুব্ধ করতে পারে, ঠিক তখনই সে স্ত্রী পাখীর বাসায় গিয়ে তার আগের ডিমগুলো ঠুকড়ে নষ্ট করে ফেলে। একই ভাবে যদি সে পাখীর প্রাক্তণ কোনো পুরুষ থাকে, সে পুরুষ নজরে রাখে সব সময়ই স্ত্রী পাখীকে, এবং নিজের পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষা করবার জন্য নিয়মিত পাহাড়া দিয়ে যায় নিজের বাসা। এর পরও অবশ্য শেষ রক্ষা হয় না।

সুযোগ পেলেই খাবার খুঁজতে গিয়ে অন্য কোনো পুরুষ পাখির সাথে মিলিত হয়ে আসে স্ত্রী পাখী। তবে কিছু কিছু ব্যতিক্রম আছে, সেখানে স্ত্রী পাখীরাই পুরুষ পাখীর জন্য লড়াইয়ে লিপ্ত হয়, এবং সেসব ক্ষেত্রে পুরুষের কাজ নিজস্ব গৃহ পাহাড়া দেওয়া, স্ত্রী পাখীই সমস্ত কাজ করে, মানে তারাই আহার্য সন্ধানে যায় এবং তারাই লড়াই করে। এই বৈশিষ্ঠ্যের জন্যই এইসব ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত পুরুষের বীর্যের পরিমাণ কম বরং স্ত্রী প্রজাতীর পাখীর ডিম্বানুর পরিমাণ অনেক বেশী। এবং ঘর পাহাড়া দেওয়া এই পুরুষ পাখীও সুযোগ পেলে অন্য কোনো স্ত্রী পাখীর সাথে মিলিত হয়। সম্পূর্ন প্রক্রিয়াতে বিশ্বস্ততার কোনো জায়গা নেই।

কোনো প্রজাতীর নারী ও পুরুষের শুক্রানু এবং ডিম্বানু উৎপাদনের পরিমাণ আদতে নির্ধারণ করে তাদের জীবন ধারা। যেসব প্রজাতীর প্রাণী যৌথ জীবন যাপন করে এবং যাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ২ জন, সেসব ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই পুরুষ প্রাণীটিই আহার্যের সন্ধানে যায়, এবং এইসব প্রাণীদের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই পুরুষ প্রানীর শুক্রাণুর পরিমাণ স্ত্রী প্রাণীর ডিম্বানুর তুলনায় বেশী। তবে যদি স্ত্রী জাতীয় প্রাণীই আহার্যের সন্ধানে যায় তবে এ ক্ষেত্রে স্ত্রী জাতীয় প্রাণীর ডিম্বানু উৎপাদনের পরিমাণ বেশী। এত দিন সামাজিক নৈতিকতাবোধে আচ্ছন্ন জীব বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিলো শুধুমাত্র প্রজননের জন্যই প্রাণীরা মিলিত হয়, উপযুক্ত পরিবেশে নির্ধারিত একটি সময়েই তারা জুটি খুঁজতে যায়, তবে এ ধারনা সঠিক নয়, সকল প্রাণীই পরবর্তী প্রজন্ম উৎপাদনের জন্য সঙ্গমলিপ্ত হলেও তারা অনেক সময়ই আনন্দের জন্যই মিলিত হয় পুরুষ প্রাণীর সাথে। সামাজিক জীব, যেমন শিম্পাঞ্জী কিংবা বেবুন কিংবা গরিলা কিংবা অন্য সকল যুথবদ্ধ প্রাণীও নিজের আনন্দের জন্য মেটিং সিজনের বাইরে মিলিত হয় পুরুষের সাথে।

প্রকৃতিতে পুরুষজাতীয় প্রাণী ইর্ষাকাতর তারা যদি সন্দেহও করে কোনো সন্তান তার ঔরসজাত নয়, তবে নৃশংস ভাবে হত্যা করে সে সন্তানকে। তবে দীর্ঘ দিনের সামাজিক অভ্যাস ও চর্চায় মানুষের ভেতরে ব্যতিক্রম দেখা যায়। এরা অন্য সব প্রাণীর মতো নয়, বরং এরা অন্য পুরুষের সন্তানদেরও নিজ সন্তানের মতো লালন করে, এমন কি উপযুক্ত প্রমাণ থাকা স্বত্ত্বেও তারা নিজের সন্তানকে হত্যা করে না, সামাজিক বিধান এবং আমাদের নৈতিকতা বোধ কিংবা আমাদের স্নেহশীলতার নিদর্শন বোধ হয় এটাই। মানুষ এখানেই অন্য সব প্রাণীর তুলনায় ব্যতিক্রম। তারা দীর্ঘ দিনের সামাজিকতা অভ্যাসে নিজস্ব জীনের প্রবাহ না হলেও পরবর্তী প্রজন্মকে স্নেহ করতে শেখে, এবং এরাই অন্য মানুষের সন্তানকে দত্তক নিয়ে লালন পালন করে, এমন কি রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও এই স্নেহশীলতা কমে না।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।