বিশ্বজুড়ে ধর্ষণের পরিসংখ্যান দেখছিলাম, সবচেয়ে বেশী ধর্ষণের ঘটনা ঘটে দক্ষিণ আফ্রিকায়, সেখানে প্রতি ১০০ জনে ১জন ধর্ষিতা হয়। বাংলাদেশের নাম সে তালিকায় নেই, সুতরাং এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না বাংলাদেশে ধর্ষণের হার কত।
ধর্ষণকে দুই ভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, জোরপূর্বক শাররীক সম্পর্ক স্থাপন, যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তির যৌনাঙ্গ কিংবা পায়ুপথে সঙ্গম করা হয়েছে।
এবং অন্য ধরণের যৌননিপীড়ন, কিংবা যৌনলাঞ্ছনা, যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তি শাররীক ভাবে আক্রান্ত হয়েছেন বিপরীত কিংবা সমলিঙ্গের মানুষদের দ্বারা কিংবা তাকে মৌখিক ভাবে হেনেস্তা করা হয়েছে।
তবে এসব যৌনলাঞ্ছনা কিংবা যৌননিপীড়নের সংজ্ঞা বদল করে যে সত্য প্রকাশিত হয়, সেটা ভয়ংকর।
প্রতিটি দেশে অন্তত এক তৃতীয়াংশ প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েরা স্বীকার করে নিয়েছে, তাদের জীবনে কোনো না কোনো সময় তারা পরিচিত কিংবা অপরিচিত পুরুষের হাতে যৌনলাঞ্ছিত হয়েছে।
আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ আসে না তেমন ভাবে, কিংবা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এমনটাই সত্য যে এখানে আক্রান্ত ব্যক্তির পক্ষে বিভিন্ন সামাজিক ট্যাবু কিংবা রক্ষণশীলতার প্রভাবে উদ্ভুত মানসিক জড়তা কাটিয়ে পুলিশে অবহিত করবার আগ্রহ থাকে না।
সাধারণ পরিসংখ্যান বলছে যৌনলাঞ্ছিত হয় মেয়েদের অধিকাংশই যৌনলাঞ্ছিত হয়েছে পরিচিত মানুষদের কাছে, প্রতি ৩টি যৌনলাঞ্ছনার ঘটনার একটি ঘটায় একেবারে অপরিচিত মানুষ, অর্থ্যাৎ শতকরা ৭০ শতাংশ ঘটনা ঘটবার সময় যৌনলাঞ্ছিত ব্যক্তি যৌনআগ্রাসী ব্যক্তির পরিচয় এবং তার সাথে সামাজিক সম্পর্ক সম্পর্কে অবহিত থাকে।
এই পরিচিত তাকে দ্বিমুখী যাতনায় পিষ্ট করে, শাররীক আগ্রাসনে ঘটে যাওয়া ক্ষতি, সামাজিক ধারণা উদ্ভুত শাররীক বিশুদ্ধতা এবং সতীত্ব কলুষিত হওয়ার বোধ এবং আক্রান্ত ব্যক্তি এবং আগ্রাসী ব্যক্তির সামাজিক ক্ষমতার তারতম্য- সব মিলিয়ে পুলিশকে অবহিত করতে অনেক ধরণের বাধার সম্মুখীন হতে হয় একজন আক্রান্তকে।
পারিবারিক ভাবে নিরুৎসাহিত করা হয় অনেক সময়, সামাজিক সম্মানহানির ভয়ে অনেক ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ করেন না।
এইসব নানাবিধি ট্যাবুর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশে ধর্ষণ এবং যৌনলাঞ্ছনার ঘটনাগুলো জনসমক্ষে কিংবা জরিপে উঠে আসে না।
যতগুলো অপরাধ পুলিশের কাছে অভিযোগ হিসেবে আসে তার ৮০ ভাগই অমীমাংসিত অবস্থায় আসে, কিংবা অধিকাংশ সময়ই ধর্ষক মুক্তি পেয়ে যায়। এবং এইসব জটিলতার কারণে অনেকে আইনী ব্যবস্থার আশ্রয় নিতে চান না।
প্রশ্ন হলো যারা আইনগত ভাবে ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে আমরা কি ব্যবস্থা গ্রহন করবো। চেক প্রজাতন্ত্র আগ্রাসী ধর্ষকদের ক্যাস্ট্রেশন করে, অর্থ্যাৎ তাদের বাধ্যতামুলক ভাবে মৃত্যুদন্ড কিংবা খোজা হওয়ার যেকোনো একটা পরিণতি মেনে নিতে হয়।
ইউরোপের অন্যান্য দেশে এবং যুক্তরাষ্ট্রে সহিংস ধর্ষকদের নিয়মিত ঔষধ সেবন করতে হয় যা তাদের যৌনকামনাকে দমন করে। যৌনচাহিদা দমন করবার ঔষধ দিয়ে ধর্ষকদের ধর্ষণ প্রবনতা কমানো সম্ভব কি না এটা নিয়ে বিতর্ক আছে।
এটা নিয়ে বিতর্ক উস্কে দিচ্ছে বৈজ্ঞানিক গবেষণা, তারা প্রাকৃতিক বিবর্তনের সূত্র ধরে এমন ঘোষণা দিচ্ছে এটা বিবর্তনের প্রভাব এবং এটা জৈবিক একটি প্রতিক্রিয়া, যদিও অন্য সব সাধারণ মানুষের ধারণা ধর্ষণপ্রবনতা আদতে মানুষের তাৎক্ষণিক উগ্র যৌনাবেগ, যা দমনে ব্যর্থ হয়ে তারা ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে, এবং কেনো এই উগ্র যৌনাবেগ সৃষ্টি হয় এটার নানাবিধ কার্যকরণ নির্ধারণের প্রচেষ্টা করেছে বিহেভিয়ারিয়াল সায়েন্টিস্ট এবং সোশ্যাল সায়েন্টিস্টগণ।
অদ্ভুত সত্য হলো ধর্ষণ শুধুমাত্র মানুষের নিজস্ব যৌনআগ্রাসন নয়, বরং বেবুন এবং শিম্পাঞ্জীরাও এমন আচরণ করে, তারা দলের অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের উপরে চড়াও হয়ে নিজেদের যৌনকামনা চরিতার্থ করে, কখনও একক ভাবে , কখনও দলীয় ভাবে তাদের এমন আচরণ করতে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা।
তবে ধর্ষকদের নিয়মিত চিকিৎসা সেবা দেওয়া, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য যাচাই করা, তাদের নিয়মিত পুলিশের কাছে নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়া এবং প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে রেখে তাদের যৌন কামনা দমনের ঔষধ সেবনে বাধ্য করা, সবগুলো ব্যবস্থাই করতে হয় রাষ্ট্রীয় খরচে।
বাংলাদেশের জন্য এমন কোনো ব্যবস্থা কি কার্যকরী কোনো পদ্ধতি বিবেচিত হতে পারে।
বাংলাদেশ কি ধর্ষকদের মুষ্ককরণ ঘটাবে, তাদের মৃত্যুদন্ড রদ করে এমন বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি জানাবে?
পুনর্বাসন সব সময়ই অপরাধীদের জন্য বিশাল একটা সমস্যা, দীর্ঘ একটা সময় কারাগারে আটক রেখে তাকে সংশোধনের ব্যবস্থা করা কিংবা তাকে প্রচলিত নিয়মের সবক দিয়ে রাষ্ট্রের উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করা এমনটাই কারাগারের লক্ষ্য ছিলো। তবে সে লক্ষ্য অর্জিত হয় নি।
সব সময়ই সংশোধনাগার আদতে রাষ্ট্র যাদের নিজের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে তাদের আটকে রাখবার জায়গা হয়েছে, এবং এদের অনেকেই ভয়ংকর রকমের সোশিওপ্যাথ, তারা সামাজিক মানুষদের ঘৃনা করে, এবং তারা সামাজিক মানুষের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাদের সাথে বসবাস করে একজন খুব বেশী সংশোধিত হয় না।
প্রতিটা উন্নত দেশে এখন নিয়ম হয়েছে কোনো অভিযুক্ত ধর্ষক যখন তার আবাস পরিবর্তন করবে তখন সেটা সেখানকার স্থানীয় প্রশাসনকে জানানো হবে।
এবং প্রতিটা মিউনিসিপালটি অফিসে তার রেকর্ড এবং বর্তমান অবস্থা লিপিবদ্ধ থাকবে, এবং যেকেউ ইচ্ছা করলে এই তথ্য জানতে পারবে।
অভিযুক্ত ধর্ষকদের আমরা ঘৃণা করি, সামাজিক মানুষ হিসেবে আমাদের পরিচিত জনদের প্রতি বিদ্যমান হুমকি হিসেবে আমরা চিহ্নিত করি এদের, তবে এদের অনেকেই সিরিয়াল ধর্ষক নয়। তাদের অনেকেই একবার ধর্ষণ করে অভিযুক্ত হওয়ার পর সত্য সত্যই সংশোধিত হয়ে সুনাগরিক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে।
একজন সাম্ভাব্য অপরাধী এবং এবং একজন সংশোধিত মানুষের ভেতরে প্রভেদ করবার কোনো উপায় আসলে তথ্য উপাত্তে থাকে না।
রাষ্ট্র অনেক সময়ই মানুষের মানসিকতা এবং মানসিক অবস্থাকে যাচাই করতে ব্যর্থ হয়, সুতরাং এমন একটা অপরাধ যা ৩০০ বছর আগেও অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে সেটা দমনের জন্য শুধুমাত্র কঠোর আইনের প্রয়োগ নয়, এটার উৎস জানা জরুরী, সামাজিক এবং মানসিক কারণগুলোর সাথে এটাও নির্ধারণ করা প্রয়োজন আমাদের বিবর্তনের ধারায় আমরা কেনো ধর্ষণপ্রবন হয়ে উঠেছি।
এবং আমাদের নিজস্ব ধর্মীয় কিংবা সামাজিক নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ কি আমাদের নিজেদের জেনেটিক প্রোফাইলের বিরুদ্ধে যেতে সহায়তা করবে।
যদি আমাদের নিজস্ব বিবর্তনের ইতিহাসের কোথাও এমনটা থাকে যে আমরা স্বভাবতই ধর্ষণপ্রবন আমাদের শিক্ষা এবং সংস্কৃতি আমাদের ধর্ষণ প্রবনতাকে রোধ করে, তবে আমাদের সে ভাবেই আগাতে হবে, সেসব সামাজিক সংস্কার এবং নৈতিকতা এবং সামাজিক শিক্ষার প্রবর্তন এবং চর্চা করতে হবে ,যা একজন মানুষকে অন্য মানুষের প্রতি যৌনআগ্রাসী না হয়ে বরং পারস্পরিক সম্মতিতে আনন্দময় এবং নির্ভেজাল শাররীক সম্পর্কে লিপ্ত হতে আগ্রহী কিংবা অনুপ্রাণীত করবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।