দেবদাসী, মন্দিরবাসীনি কিংবা অন্য যেকোনো নামেই অভিহিত করা হোক না কেনো তাদের, প্রাচীন সভ্যতায় সুন্দরী তরুণীদের একাংশকে সব সময়ই কোনো না কোনো উপাসনালয়ে অন্য সব পুরোহিত এবং আমত্য ও উচ্চ বংশীয় পুরুষদের যৌনলিপ্সা এবং অন্যান্য মানসিক চাহিদা পুরণ করে কাটাতে হতো।
তারা সমাজের সবার জন্য উৎসর্গকৃত নগরনন্দীনি। ইশরাত, মেসোপটোমিয়া, ব্যাবিলন এবং ফনিশিয়ান সভ্যতার একক দেবী, ক্রমশ পুরুষের আধিপত্যে তার উর্বরতা ব্যতীত অন্য কোনো পরিচয় টিকিয়ে রাখতে পারে নি। কিংবা অন্য ভাবে বলা যায় সভ্যতা মাতৃতান্ত্রিকতা ছেড়ে পিতৃতান্ত্রিক হয়ে উঠবার পথেই ইশরাত পরম দেবীর আসনচ্যুত হয়ে সাধারণ এক দেবি হয়ে উঠেন, যাকে পরবর্তীতে যখন সেমেটিক ধর্মের সৃষ্টি হলো, তখন পাপিষ্ঠা অভিধা দেওয়া হলো।
প্রাথমিক পর্যায়ে ইশরাতের উপাসনা হতো সকল রকমের উদযাপনে, যুদ্ধাজয়, নবান্ন আর পার্বনে ইশরাতের ভজনা হতো নিয়মিত।
এবং এইসব ভজনা আদতে সমাজের সকল পুরুষের পারস্পরিক যৌনবিদ্বেষ এড়ানোর একটা সহজ উপায় গণ্য হতে পারে। খোলা মাঠে সমুদ্রের সামনে কিংবা নদী উপকূলে সবাই যৌনাচারে মেতে উঠতো পার্শ্ববর্তীনির সাথে। এবং এই প্রথা শুধুমাত্র সেখানে উদ্ভুত সভ্যতার একান্ত অংশ এমন নয়, বরং সেটার প্রচলন অন্য সব সভ্যতায় আছে যাদের সাথে এই ইরাকের দজলা আর ফেরাত নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলের কোনো সম্পর্ক কখনই গড়ে উঠে নি।
নগরকেন্দ্রীক সভ্যতার উদ্ভব, উপাসনালয় সৃষ্টি এবং পৌরোহিত্বের যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন হওয়ার পরে ইশরাতের উপাসকের জন্ম হলো, নগরের সকল বিবাহিত রমণীকে বিবাহিত জীবনের পরবর্তী একটা সময়ে সামাজিক রীতি অনুসারেই মন্দিরের সামনে অপেক্ষা করতে হতো , সেখানে যে কেউ তাদের আঁচলে সামান্য উপঢৌকন দিয়ে তার সাথে মিলিত হতে পারতো। যদিও ততটা আশ্চর্য হওয়ার মতো সংবাদ নয় এটা, যারা পয়সা উপঢৌকন দিতো তাদের অধিকাংশই ছিলো বিবাহিত পুরুষ।
বিবাহিত পুরষের কামনিবৃতির উপকরণের অভাব নেই, এরপরও বিবাহিত পুরুষের এমন আচরণ আদতে পুরুষের ভেতরে কাম্য নারী নিয়ে দ্বন্দ্বকে দমিয়ে রাখার একটা সামাজিক প্রয়াস।
এই শ্রেনীর কাউকেই ঠিক প্রচলিত সংজ্ঞায় গণিকা বলা সম্ভব নয়, গণের সম্ভোগের জন্য নিয়োজিট থাকলেও বর্তমানের গণিকাদের যেভাবে অর্থের বিনিময়ে বহুপুরুষ ভোগ করতে পারে, সেবাদাসীদের তেমন অর্থপ্রাপ্তির সুযোগ ছিলো না। আর বিবাহিত যেসব নারী অন্তত একবার হলেও অপরিচিত পুরুষের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হতে বাধ্য হতো, তাদের ঠিক গণিকা পর্যায়ভূক্ত করা যায় না।
সুতরাং সাধারণের ভেতরে জনপ্রিয় ধারণা, গণিকাবৃত্তি পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন পেশা, এই ধারণা সম্ভবত সত্য নয়। পশুপালন, কৃষিকাজ, মৎস্যপালন এবং মৎস্যবিক্রয়ের পেশা আদিমতম, এবং এর সাথে আছে ভাড়াটে সৈনিকের পেশা, নগরনির্মাণের পেশা, এবং এইসব পেশার প্রসার হওয়ার পরে অবশ্যই এইসব মানুষের বিভিন্ন চাহিদার সাথে যৌন চাহিদা পুরণের জন্য গণিকাদের সৃষ্টি হয়েছে।
কিন্তু এটা প্রাচীনতম পেশা নয় মোটেও।
আর গণিকাবৃত্তি অন্তত প্রাচীন সমাজে অত্যন্ত সম্মানিত একটা কাজ ছিলো। রীতিমতো চৌষট্টি কলার চর্চা করে বিখ্যাত গণিকা হওয়া যেতো। একজন উচ্চপ্রশিক্ষিত গণিকার কদর ছিলো সবখানেই। সেটা রাজদরবার কিংবা বন্দর, যেখানেই হোক না কেনো, একজন প্রশিক্ষিত গণিকার সম্মান আর উপার্জনের পরিমাণ যেকোনো ব্যবসায়ীর তুলনায় কম ছিলো না মোটেও।
উচ্চাভিলাষী সুন্দরী কিংবা অসুন্দরী মেয়েরা প্রতিষ্ঠিত গণিকা শিক্ষাঙ্গনে উপস্থিত হতো শিক্ষার জন্য, তাদের সর্বশিক্ষায় পারদর্শী করে তোলা সম্ভব ছিলো না।
অভিনয়, নৃত্য, বাদ্যযন্ত্র বাজানোর দক্ষতা, ছবি আঁকার এবং ছবি বুঝতে পারার ক্ষমতা, গান তৈরি এবং সুর করবার দক্ষতা, গৃহসজ্জা এবং রান্নার দক্ষতা, ধাঁধা তৈরী এবং ধাঁধা সমাধানের দক্ষতা, লিখতে পড়তে শেখা, কবিতা ও গল্প তৈরি করা এবং লিখতে পারার দক্ষতা, বিভিন্ন রত্ন চেনার দক্ষতা, জুয়া খেলবার দক্ষতা, এবং আরও অনেক ধরণের যোগ্যতার পরীক্ষা দিয়েই একজন চৌষট্টি কলাবিশারদ হতে পারতো।
এমন একজন পারদর্শী রমণী রাজার অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হয়ে উঠবেন এবং নগরের সবার শ্রদ্ধাভাজন হয়ে উঠবেন, যার বাসগৃহে মন্ত্রনা সভা বসবে, কোথাও যুদ্ধ এবং বাণিজ্যের বিষয়ে তার মতামত জানতে চাওয়া হবে, এসব খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয় ছিলো তখন, অন্তত প্রাচীন ভারতে এটা রীতিমতো একটি শিল্পে পরিনত হয়েছিলো। এইসব গুনাবলীর সাথে তাকে আবার কামকলাপারদর্শী হতে হতো। কামের ষোলেআচারও তাকে শিখতে হতো।
সম্ভবত তাদের কাজ মূলত গণিকাবৃত্তি নয় বরং দক্ষ আমলা হিসেবে যেনো তারা যেকোনো মানুষের সাথে আলোচনায় লিপ্ত হতে পারে এবং তাকে সবধরণের সুখস্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারে, এমন উদ্দেশ্য নিয়েই এই শিক্ষালয় খোলা হয়েছিলো।
একই ভাবে প্রশিক্ষিত এবং কামকলায় দক্ষ রমণীদের চাহিদা ছিলো প্রাচীন চীনে, কিংবা ব্যবিলনে।
মিশরের মন্দিরের সেবাদাসীদের সম্মান ছিলো আলাদা। ইশরাতের মন্দিরের সেবাদাসী কিংবা মিশরের মন্দিরের সেবাদাসীদের বিরুদ্ধে কটুকথা রটনা এবং উচ্চারণ রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে অপরাধ ছিলো।
মিশরীয় সভ্যতাই সম্ভবত পুরুষের ক্ষমতার লোভের চরম উদাহরণ হতে পারে।
সেখানে অন্তত ১৫০০ বছর আগ পর্যন্ত সম্পদ বন্টিত হতো মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, অর্থ্যাৎ মাতার সম্পদ পেতো কন্যারা, ছেলেরা ধনসম্পদের উত্তরাধিকারী বিবেচিত হতো না, সুতরাং সেখানে রানীর মৃত্যু হলে সম্রাট ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি টিকিয়ে রাখবার জন্য কন্যাকে নিজের স্ত্রী করে নিতেন, একই ভাবে পিতার মৃত্যুর পরে পুরুষ সন্তান সম্পদের লোভে, হয় মাকে কিংবা বোনকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতো। এবং এই প্রথা নিজস্ব যৌনচাহিদা পুরণের কোনো পন্থা নয়, বরং সম্পদের অধিকারের লোভ। এইসব সম্রাটের নিজস্ব হারেমে প্রশিক্ষিত গণিকা এবং অন্যসব স্ত্রীরাও থাকতো, তবে তাদের প্রধান স্ত্রী কিংবা মূল রানী হতো সম্রাটের রক্তসম্পর্কিত কিংবা সম্রাঞ্জীর রক্তসম্পর্কিত কোনো কন্যা।
যদিও ইহুদী ধর্ম গোত্রের ভেতরে গোত্রের সদস্য- সদস্যদের কাউকেই গণিকা বৃত্তিতে উৎসাহিত করতো না, বরং সেটা তাদের নৈতিক আইন অনুসারের জঘন্য অপরাধ বিবেচিত হতো, তবুও ইতিহাসে খুব অল্প সময়ের জন্যই তারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলো, তাই তাদের নিজস্ব গোত্রে তারা পতিতাবৃত্তি দমন করতে পারলেও নগর থেকে পতিতাদের উচ্ছেদ করতে পারে নি।
যত বড় নগর, তত বেশী গণিকা, তত বেশী ব্যাভিচার, এমনটাই বাস্তবতা।
গ্রীক সভ্যতাও একটা পর্যায়ে শুধুমাত্র গণিকাবৃত্তির জন্যই বিখ্যাত। তাদের নগরে যদিও পতিতাদের নাগরিকত্বের অধিকার ছিলো সামান্য তবে নগরের অধিকাংশ সম্পদের মালিক ছিলো এই গণিকারা, তারাই নগরের সম্ভ্রান্ত নাগরিকদের বিলাস ও ব্যভিচারের অর্থ প্রদান করতো।
ঔচ্চাভিলাষী যেকোনো নারী সে সময়ে স্বইচ্ছায় গণিকাবৃত্তি মেনে নিতো, এবং তারা অর্থে-বিত্তে- সম্মানে পিছিয়ে ছিলো না। বরং সামনের কাতারেই ছিলো।
এখনও পরিস্থিতি তেমন বদলায় নি, মানুষের রমনেচ্ছা এখনও রয়েছে, পুরুষ এখনও নিজের কামনিবৃত্তির নতুন নতুন ক্ষেত্র উন্মোচনের চেষ্টা করছে।
নারীদের সবাই যে দক্ষ গণিকা হয়ে উঠতে পেরেছিলো এমন নয়, বরং চৌষট্টি কলায় দক্ষ যে রমণী, তার শষ্যাসঙ্গী হতে যে পরিমাণ আর্থিক সঙ্গতি লাগতো তা যোগান দিতে পারতো শুধুমাত্র উচ্চতর রাজকর্মচারীগণ, সম্রাট নিজেই নিজের নগরে একজনকে উপঢৌকনসহ বহাল রাখতেন , যখনই অন্য দেশের কোনো সম্ভ্রান্ত নাগরিক কিংবা সম্রাট নগরে আসতেন , এই গণিকা তাদের মনোরঞ্জন করতো।
সে সময়ের পরে একটা সময়ে ইসলাম ধর্ম আসলো, সেখানে বিদ্যমান নিয়মতান্ত্রিকতা অন্তত সে সময়েরব বিবেচনায় অনেক বেশী অগ্রসর ছিলো, নেপথ্যের কারণ যাই হোক না কেনো, নারীকে নিজের যৌনদাসত্বে আটকে রাখবার বাধ্যবাধকতা ছিলো না সেখানে। বরং যদি নারী নিজের স্বামীকে পছন্দ না করতো তবে সে নিজের আগ্রহেই বৈবাহিক সম্পর্ক রদ করতে পারতো।
তালাকের দীর্ঘ একটা নিয়ম ছিলো, সেখানে একবার তালাক ঘোষণার পরে ৩ মাসের ইদ্দতকালীন সময় থাকতো, যে সময়ের ভেতরে স্বামী তার স্ত্রীর সাথে শাররীক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারতো চাইলেই এবং সেটা করলেই তালাক রদ হয়ে যেতো। তবে যদি পুরুষ তিন মাস সঙ্গম বিরত থাকে, এরপর পুনরায় তালাক দিতে হবে।
পুনরায় ৩ মাসের সময়, এভাবে এক চন্দ্রবছর পরেও যদি স্বামী স্ত্রীর বনিবনা না হয়, তবে স্বামী স্ত্রীকে ভরণপোষণের দায়িত্ব না নিয়েই তালাক দিতে পারে।
মুহাম্মদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানুষের অদ্ভুত যুক্তিবোধ জন্মাতে পারে নি, কিংবা এটা তাদের ধারণায় ছিলো তবে মুহাম্মদের প্রবল প্রতাপের সামনে তারা এটার চর্চা করতে পারে নি।
আবু বরকের খিলাফতের শেষের দিক থেকে ওমরের খিলফতের অধিকাংশ সময়ই তালাকের পরিমাণ এত বেড়ে গেলো, উমর এবং তার পূত্র আব্দুল্লাহ, দুজনেই একটা প্রথার জন্ম দিলেন, যা কোরান সম্মত নয় , কিন্তু তার চর্চা মানুষ এখনও করছে, এবং সেটাই সাধারণের ধারণায় তালাকের মূল বক্তব্য।
এই সময়ে ব্যভিচারের নমুনা হলো, মুসলিম একই সাথে ৪টির বেশী স্ত্রী রাখতে পারবে না, সুতরাং কেউ কেউ প্রাক্তন স্ত্রীকে তালাক দিয়ে কয়েক দিনের জন্য অন্য কোনো কাম্য রমনীকে বিবাহ করছে এবং মেয়াদ কিংবা ইদ্দত শেষ হওয়ার আগেই পুরোনো স্ত্রীকে ত্যাগ করে নতুন এবং নতুন স্তীকে ত্যাগ করে পুরোনো স্ত্রী- এমন পরিবর্তন করে বস্তুত সুন্নাহ মতে যতটা সম্ভব তার চেয়ে বেশী ব্যভিচারের লিপ্ত হলো। উমর সে সময়ে বাধ্য হয়েই ফরমান জারী করলেন- পূর্বে যেমন তিন ধাপে তালাক সম্পন্ন হতো, এখন থেকে তা হবে না।
একবার তালাক উচ্চারণ করলেই সেটা ৩ বারের কাজ করবে, এবং ইদ্দতকালীন সময় হবে ৩ মাস, এরপরে সে রমনীকে বিবাহ করিতে হলে হিল্লা বিবাহের প্রয়োজন হবে।
আব্দুল্লাহ আরও একধাপ এগিয়ে এটার ব্যখ্যা দিলেন, যদি কোনো পুরুষ ব্যবসায়িক সফর, কিংবা যুদ্ধব্যতীত অন্য কোনো কারণে কোনো রমনীর সাথে ৩ মাস একাধারে মিলিত না হয়, তবে তাদের তালক হয়ে যাবে।
সম্ভবত এমন কোনো নিদর্শন তখন বিদ্যমান ছিলো, হয়তো যে রমণীর স্বামী বিদেশে, তার যৌনচাহিদা পুরণের পন্থা হিসেবে সে আশেপাশের যুবকদের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেছে, কিংবা অন্য কোনো লোভের বশবর্তী হয়েই আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের এমন সিদ্ধান্ত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।