যুদ্ধ এবং যৌনতাই আমাদের ভাবনাকে নিয়ন্ত্রন করে, অর্থনীতি শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধ এবং যৌনতাকেই পূঁজি করে টিকে থাকে, সম্প্রসারিত হয়। আপাতদৃষ্টিতে যতটা পরিপাটি মনে হয় আমাদের সমাজের গাঁথুনি, সেটা বোধ হয় অনেক দুর থেকে দেখবার ফল, কিংবা আমাদের সমাজে যৌনতাভিত্তিক লুকোচুরি থাকলেও সেটা স্বাভাবিক ভাবে বিকশিত না হয়ে যতটা ছড়িয়েছে ভেতরে ভেতরে, সেটা জেনে আশ্চর্য হই প্রতিবারই।
যৌনঅপরিতৃপ্তির কারণে পরকীয়া প্রবন মানুষেরা স্বগৃহে এবং স্ববরে স্থিতি পাবে ভায়াগ্রা আসবার পরে- এমন মন্তব্যও ভ্রান্ত প্রমাণিত হলো, পরকীয়ার কারণে স্বামী কিংবা স্ত্রীকে হত্যা করা, শিশু সন্তানদের হত্যা করবার মতো বিভৎসতার নজির শুধু এই শতকেই পত্রিকায় এসেছে এমন নয়, বাংলাদেশের পত্রিকায় গত শতকে, অর্থ্যাৎ ১০০ বছর আগেও এমন ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে।
তখনও পরকীয়াপ্রবন নারী প্রেমিকের সাথে গাঁটছাড়া বাঁধবার আগে স্বামীকে হত্যা করে ফেরারী হয়েছে, কিংবা ভুল করে নিজের কন্যাকে হত্যা করেছে।
এটাকে সামাজিক অবক্ষয় বলবার অবকাশ বোধ হয় নেই এখন।
সভ্যতা কখনই এমন রাস্তায় যায় নি, বরং এই যৌনতাকে নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করেছে সভ্যতা। আমাদের সভ্যতার অবদান বড়জোর এইগুলোকে একটা নিয়মতান্ত্রিকতার ভেতরে নিয়ে আসা।
সভ্যতায় নারী একটা সময় পূজিত হয়েছে তার উর্বরতার জন্য, নারীরাই সন্তান গর্ভে ধারণ করতে পারে এবং নারীরাই পুরুষের বিজ গর্ভে ধারণ করে নতুন প্রজন্মের জন্ম দেয়- এই অলৌকিক গুণের জন্যই নারী দেবিরুপে পূজিত হয়েছে, যা কিছু ফলবন্ত, ভুমি, নদী, শষ্য সবই পূজিত হয়েছে নারীরুপে, আকাশ বর্ষণ করে, সেই বর্ষণসিক্ত ভুমি ফলবতী হয়, সুতরাং আকাশ পুরুষ, ধরণী নারী।
বয়ে যাওয়া জলধারা, যার কোনো শাখা নদী নেই, কিংবা যার কোনো উপনদী নেই, বাংলাদেশে সেসব জলধারাকে নদ বলে, নদী সেগুলোই যাদের শাখাপ্রশাখা আছে,
যমুনা, মেঘনা, পদ্মা, করোতোয়া, সবই নদী, কারণ এদের ভাটির কোথাও না কোথাও এরা একটা দুটো শাখা ছড়িয়েছে, আত্রাই থেকে উৎপন্ন হয়েও কোনো শাখা নদী তৈরি করে নি, তাই পূনর্ভবা নদ, ব্রহ্মপূত্রেরও কোনো শাখা নদী নেই, কপোতাক্ষ কিংবা আড়িয়াল খাঁ শুধু কোনো জায়গায় একটা জলের শাখা ছড়াতে পারে নি বলেই আজীবন নদ রয়ে গেলো।
আমাদের নিজেদের ভেতরেও এই ফলবন্ত হয়ে উঠবার প্রতি একটি মোহ কাজ করছে, সামাজিক পুরুষাকার এভাবেই চিহ্নিত হয়েছে।
পূজ্য নারী নগরভিত্তিক সভ্যতা শুরুর পর থেকেই সমাজের কতৃত্ব হারিয়েছে ধীরে ধীরে, নগর সভ্যতা এবং সেমেটিক ধর্মের আগমনে নারী হয়েছে অবগুণ্ঠনবাসীনি। তাদের চাষ আর পশুপালনের কাজে নিয়োজিত করা হয়েছে। অর্থ্যাৎ এখানেও তাদের উর্বরতাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
সে সময়ে নারীর যৌনতার অবাধ স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করবার প্রয়াসেই সেমেটিক ধর্মে নারীকে পাপের আকর বলা হয়েছে। এমনটাই নারীবাদি নৃবিজ্ঞানীদের অভিমত ছিলো।
ইভ, তার যৌনতা এবং লোভের জন্য স্বর্গ থেকে বহিস্কৃত একজন, নারীর শুদ্ধতা এবং উৎকর্ষতা শেষ পর্যন্ত তার যোনীর অভেদ্যতা। এই সামাজিক ধারণারও জন্ম হয়েছে এই ধর্মগুলোর অবাধ প্রসারে।
প্রতিটা সমাজ নিজের মতো করে যৌনতাকে নিয়ন্ত্রন করতে চেয়েছে, চেয়েছে অর্থনীতি বিকাশ এবং সামাজিক স্থিরতা নির্মান করতে চেয়েছে যৌন সম্পর্কগুলোকে কোনো না কোনো নিয়মে বেধে।
গ্রীসে চল ছিলো, কোনো মেয়ে বিবাহযোগ্যা হলে তাকে পতিতাবৃত্তি করতে হতো, মন্দিরের বেদীতে গিয়ে বসে থাকতে হতো, যে কেউ সামান্য অর্থ দিয়ে তাকে ভোগ করবার পরে তার বিবাহের সুযোগ মিলতো। হেরোডেটাস নিজের ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন- সুন্দরী মেয়েদের তেমন সমস্যা হতো না, তারা অতি সহজেই মানুষের নজরে পরতো এবং পরবর্তীতে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারতো।
তবে সমস্যা হলো অসুন্দরীদের। তারা বছরের পর বছর মন্দিরের চাতালে অপেক্ষা করতো, যদি কোনো দিন কোনো দয়াবানের করুণা হয় এবং তার সামনে পয়সা ছুড়ে দিয়ে তার সাথে সঙ্গমের আগ্রহ দেখায় তবেই তার জামাই জুটবে।
আমাজানের আদিবাসীরা প্রতি পূর্ণিমায় অবাধ যৌনাচারের সুযোগ রেখেছে, এ কারণেই সেখানে পুরুষে পুরুষে যৌনদ্বন্দ্ব নেই, ভারতের নগরগুলোতে প্রখ্যাত সুন্দরীদের মন্দিদের দেবদাসী করা হতো, তারা বিশিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ এবং অন্য সব কুলীনদের যৌনচাহিদা পুরণ করতো পয়সার বিনিময়ে।
ব্যাবিলনে কিংবা মিশরের উপরের অংশে, মন্দিরে সুন্দরীদের সেবাদাসী করে রাখবার প্রবনতা ছিলো। অর্থ্যাৎ সমাজের একটা অংশ, যারা সে সময়ে সমাজকে নিয়ন্ত্রন করতো, তাদের নিজেদের ভেতরে যৌনতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়ার কোনো রকম আগ্রহ ছিলো, সুতরাং তারা ভবিষ্যতে সুন্দরী ও কাম্য হয়ে উঠতে পারে এমন রমনীদের দেবতা তথা সমাজপতিতের সবার ভোগের জন্যই উন্মুক্ত রাখতো।
যেকেউ মন্দিরে গিয়ে তাদের সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করবার সুযোগ পেতো না।
বিয়ের প্রথা যেমনই হোক না কেনো, সেটা আদতে একটা সামাজিক স্বীকৃতি, একজন নারী ও পুরুষের একত্রবাসের স্বীকৃতি, কনে পন দেওয়া কিংবা বরপন দিয়ে দুজন এই স্বীকৃতি আদায় করে নেয় সমাজ থেকে।
দক্ষিণ আফ্রিকার একটি উপজাতিতে নিয়ম হলো, তাদের বিবাহযোগ্যা নারীকে যখন কোনো পুরুষ পছন্দ করবে, তখন সেই মেয়েকে নিজের যোগ্যতা প্রমান করতে হবে সবার সামনে নেচে। তার নাচ দেখে যদি অন্য সবাই যৌনউত্তেজিত হয় তবেই সেই মেয়ের বিয়ের স্বীকৃতি মিলে, অর্থ্যাৎ যখন একজন নারী অন্য একজন পুরুষের সাথে একত্রবাস শুরু করবে, সেসময় থেকেই যৌন্যতার দ্বন্দ্বে যেনো সে পুরুষ অন্য পুরুষের সাথে জড়িয়ে না পড়ে এটা নিয়ন্ত্রনের জন্যই গোত্রের সবাইকে এক করে তাদের সবাইকেই যৌনউত্তেজনা দেওয়ার প্রথা।
প্রথা অদ্ভুত হতে পারে, সময় সময় খুবই উৎকট এবং অশালীন মনে হতে পারে, কিন্তু সামাজিক স্থিরতা নিয়ে আসবার দীর্ঘমেয়াদী প্রয়াসে এইসব রীতিই সংস্কৃতি হিসেবে চর্চিত হচ্ছে।
এবং খুব বেশী অগ্রসর না হলেও সেসব সভ্যতা গত ১০ হাজার বছর ধরে নিজস্ব সংস্কৃতি অক্ষুন্ন রেখেই টিকে আছে।
যৌনতার অন্য একটা ব্যবহার ছিলো যুদ্ধে, পুরুষের সুন্দরী নারীর প্রতি কামনাকে পূঁজি করে সম্রাট এবং সেনাপতিগণ একদা নারীদের গুপ্তচরের পেশায় নিয়োজিত করতো, তাদের কাজ ছিলো শত্রু শিবিরের গুরুত্বপূ্র্ণ মানুষদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে এইসব সংবাদ সেনাপতিকে জানানো। তারা একই সাথে গুপ্তঘাতকের কাজও করতো।
তারাশঙ্কর তার এক গল্পে এমনটাই জানিয়েছেন যে, আমরা যাদের বেদে-বেদেনী বলি তারাও আসলে কোনো এক সময় রাজার গুপ্তচর ছিলো, তাই বেদে-বেদেনীরা ছদ্মবেশ নিতে পটু, এটা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তারা সংস্কৃতি হিসেবে চর্চা করছে, তারা পতিতাবৃত্তিও করে প্রয়োজনে।
স্বামীর বয়স্ক সব আত্মীয়দের সাথে পর্যায়ক্রমে সঙ্গমলিপ্ত হওয়ার প্রথাও আছে কোথাও কোথাও।
সভ্যতার অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়েই পুরোহিতদের যৌন চাহিদা পুরণের অনেক রকম পন্থাই আবিস্কৃত হয়েছে।
পুরোহিতদের কাজ সমাজে একটা শৃঙ্খলা নির্মান, তারা নিজেদের ধর্মীয় বয়ান কিংবা অভিজ্ঞতার আলোকে সমাজের বিভিন্ন ঝুট ঝামেলা নিয়ন্ত্রন করেন, তাদের ক্ষোভ প্রশমন করেন, এবং আবশ্যিক ভাবে এইসব পুরোহিতদের কামুকতা বেশী, সুতরাং তারা সকল সুন্দরী নারীদের ভোগ করতে আগ্রহী, রাজার কনয়া কিংবা চন্ডাল কন্যা কোনো বিভাজন নেই, পুরোহিতের সাথে সঙ্গম না করলে বিবাহ বৈধ হবে না। এমন রীতিও একটা সময়ে প্রচলিত ছিলো।
অনেক রকম যৌনসংস্কৃতি চর্চিত হয়েছে। সভ্যতার অগ্রগতির এবং প্রযুক্তির উন্নতির জন্য আমরা সেসবের কিছু অংশ জানছি।
অনেক রীতিকেই আমাদের অতিরিক্ত জটিল সমাজের প্রেক্ষিতে এবং আমাদের চর্চিত সংস্কৃতির প্রভাবে রীতিমতো অভব্য এবং অসভ্য মনে হয়। অথচ আমাদের পরিপাটি সামাজিক বুননেও এইসব যৌনদ্বন্দ্ব সব সময় ক্রিয়াশীল।
আমাদের সভ্য মানুষদের বিবাহবহির্ভুত সম্পর্কে জড়িয়ে পরা কিংবা সামাজিক ভাবে অবৈধ সম্পর্ক চর্চা করা কিংবা সামাজিক ভাবে অনৈতিক বিবেচিত কর্মকান্ডে অতিরিক্ত উৎসাহী হয়ে উঠবার কারণটা মোটেও সামাজিক অবক্ষয় নয়, বরং আমাদের নিজস্ব মূল্যবোধ এবং চর্চিত সংস্কৃতি এই প্রথাকে কখনই দমন করতে পারে নি। মানুষের যৌনতার চাহিদাকে উপেক্ষা করে দানবের জন্ম দিয়েছে।
সেমেটিক ধর্ম নিজে নিজস্ব কিছু নিয়মের সৃষ্টি করেছিলো, নিজস্ব গোত্রের জন্য এই নিয়মগুলো হয়তো কার্যকরী ছিলো, কিন্তু একটা পর্যায়ে তারাই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো এবং তাদের সংস্কৃতি কিংবসা সংস্কার অন্য সব অধিকৃত দেশে ছড়িয়ে পড়লো।
ইসলাম সর্বশেষ ধর্ম একটা নির্দিষ্ট কাঠামো বেধে দিয়েছে, এর আগে কোনো সভ্যতায় এতটা স্পষ্ট নির্দেশনা ছিলো না। কাদের সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপন বৈধ হবে এবং কাদের সেটা স্থাপন করা অবৈধ হবে এটার বিস্তারিত সেখানে বলা আছে।
আমার অনেক আগে একটা প্রশ্ন জেগেছিলো মনে, সংকলিত হাদিসের অর্ধেকের বেশীই যৌনতা সম্পর্কিত, আরবের মানুষের কি অন্য কোনো কাজ ছিলো না?
এত দিন পরে নিজেই খুঁজে পেলাম সে উত্তর, আদতে মানুষ সভ্যতার শুরু থেকেই এই যৌনতা এবং যুদ্ধ দিয়েই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, সুতরাং এটার গুরুত্ব তাদের কাছে অনেক বেশী। আর সেই গুরুত্বের প্রকাশ ঘটছে সাহাবীদের সাধারণ জিজ্ঞাসায়। তারা নিজেরাও প্রচলিত সংস্কৃতির সাথে নবউদ্ভাবিত ধর্মের সংস্কৃতিকে খাপ খাইয়ে নিয়ে নিজেদের যৌনজীবন এবং যৌনতার চর্চা করতে চেয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।