আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধুতি মানে শুধু ধুতি নয়

পর্যটক

দিন কয়েক আগে ধুতি লুঙ্গি প্রসঙ্গে এক তুমুল আলোচনা চলছিল। একজন দাবি করছিলেন লুঙ্গি বাঙ্গালী মুসলমানের পোষাক। ঐ পোষ্ট টা দাড়িয়ে ছিল এই দাবির উপরে। অন্যেরে প্রশ্ন তুলেছিল এই দাবিটা ঠিক না বলে। আমি খুবই দুঃখিত যে পোষ্টটার নিক কী ছিল, কোন রেফারেন্স আমি নোট রাখি নি।

কারও জানা বা মনে থাকলে জানিয়ে আমাকে ঋণী করবেন আশা করি। ওখানে এবং সাধারণভাবে আমাদের সমাজে ধুতি প্রসঙ্গে ভ্রান্তি নিয়ে "ধুতি মানে শুধু ধুতি নয়" - এই পোষ্ট। ধুতি প্রসঙ্গ: ধুতির সঙ্গে "বাবু" কথাটার একটা সম্পর্ক আছে। বাবু কথাটার ব্যাখ্যা করার ছলে ধুতি নিয়ে বলব। অনেকের ধারণা হিন্দুদের নামের আগে সম্মানসূচক বাবু লাগিয়ে তাঁর নাম বলতে হয়, যেমন "বাবু যতীন সরকার এখন তার বক্তব্য রাখবেন" - কোন সভার এক উপস্হাপক মাইকে ঘোষণা দিলেন।

অনেকটা জনাব, বা মিষ্টার এর মত এভাবে "বাবু" শব্দটা ব্যবহার করা হয়। এধারণাটার সত্যি না, ভিত্তিও নাই। শহর, মফস্বল এ'শব্দগুলোর সাথে আমরা সবাই পরিচিত। আমি এখানে এই দুইয়ের সম্পর্ক নিয়ে আমার কথা শুরু করব। জীবনকে কত ভাবে প্রকাশ করা যায়, জীবনের কত কত নতুন উপস্হাপন সম্ভব শহর সাংস্কৃতিক দিক থেকে বিচারে, শহর বিশেষত রাজধানী শহর সবসময়ই সে সুযোগটা আগে পায়।

কার থেকে আগে? মফস্বল থেকে। নতুন ভাবে জীবন যাপন করে শহর পথ প্রদর্শক বা ট্রেন্ড সেটার হয়ে আগে থেকে যায়। শহর ও মফস্বলের একটা গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হলো - মফস্বলের কাছে সবসময় শহর জীবনের এই নতুন প্রকাশ, যাপন অনুকরণীয় ও আরাধ্য হয়ে থাকে। সাধ্য সুযোগ মত মফস্বল এটা অনুকরণ করা জীবনের লক্ষ্য মনে করে। শহর এটা করে আমি বলছি বটে তবে এর মানে এটাই ভাল পথ ও এর প্রদর্শন কি না তা বলছি না।

এরকম কোন মানে আমি করছি না। কেবল বলছি, শহর-মফস্বলের সম্পর্কটা এরকম। শহরের এই স্বভাবটা ভাল না মন্দ সে বিচারে আমি এখানে যাব না। শহর কেন এটা করে, জীবনের ট্রেন্ড সেটার হয় বা সুযোগ পায় সে ব্যাখ্যা করার সুযোগও এখানে নাই। এখানে 'জীবন প্রকাশ' কথাটা চিন্তা করেই ব্যবহার করেছি।

যেমন "শহুরে" এই শব্দটা শুনলে একটা বিশেষ ধরণের জীবন, আচার আচরণ ইত্যাদির - কথা আমাদের মাথায় খেলে, শহুরে জীবনের প্রকাশ বুঝতে পারি - আপাতত এটুকু বুঝলেই চলবে। শহর মানে কেন বিশেষ ধরণের জীবন প্রকাশ তা কার উপর নির্ভর করে? এখানে কেবল এভাবে বলব, এটা রাষ্ট্রক্ষমতা, কী ধরণের শাসন, অর্থনীতি চালু থাকে - তা দ্বারা নির্ধারিত। যেমন বৃটিশ আমলে বৃটিশ ছাপ, মোগল আমলে মোগল ছাপের শহুরে জীবন ইত্যাদি। "আধুনিক" হবার কথাবার্তা, পশ্চিমের জ্ঞান-বিজ্ঞান সাহিত্য - এককথায় জীবন প্রকাশের এই ষ্টাইলের খবর আমরা পাই বৃটিশের সূত্রে, সহচর্যে, বৃটিশ কলোনী শহুরে জীবনের কালে। এখানেও আবার আর এক স্তরের মফস্বল ও শহর সম্পর্ক বিদ্যমান; বৃটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা যদি হয় মফস্বল, তবে এই বিচারে বৃটিশের লন্ডন ওর কাছে শহর।

তবু কলোনী সম্পর্কের কারণে শহর-মফস্বলের সমীকরণ এখানে একটু ভিন্ন ও ব্যাপকতায় ভরা। আপাতত লন্ডন এতটুকুই থাক, বৃটিশ-ভারতের হাতে যে কলকাতা শহর গড়ে উঠছিল সেই কলকাতাই আমার বলবার বিষয়। এর আগে মোগল আমলেই আমরা শহর দেখেছি, এই শহরে প্রবেশ আমাদের বৃটিশ আসার আগেই ঘটে গেছে; বৃটিশ কলোনীর খপ্পরে পরার বহু আগেই লক্ষৌ, দিল্লী, হায়দ্রাবাদ, পাটনা ইত্যাদি বড়সড় শহর। কলোনী মাষ্টার প্রভুর হাত ধরে আমাদের প্রথম শহর গড়তে বা শহরে প্রবেশ ঘটাতে হয় নাই। এর মানে কলোনী ছাপের বাইরে যেমন "আধুনিকতা" কী জিনিষ না যেনেও আমরা শহুরে ছিলাম।

'আমাদের' শহর ছিল। বিশেষ ধরণের জীবন প্রকাশ ছিল। নিজস্ব ট্রেন্ড সেটার ছিলাম। বৃটিশরা আসার পরে সেই শহর, সেই জীবন প্রকাশ একই ধারায় না থাকারই কথা। শহর হিসাবে কলকাতার নামডাক বৃটিশ-ভারতের রাজধানী হবার সূত্রে।

ফলে এবার নতুন রূপে শহর, জীবন প্রকাশ। এছাড়া এবারের বাড়তি হলো, "আধুনিক" হবার কথাবার্তা, পশ্চিমের জ্ঞান-বিজ্ঞান সাহিত্য - এককথায় জীবন প্রকাশের নতুন এক এই ষ্টাইল। জীবনের নতুন মানের খোঁজ পাওয়া। সিটি, পৌর বা কর্পোরেশনের বাসিন্দা বোধ করা। শহুরে হিসাবে এসবের মানে তাৎপর্য যে আমি বুঝি তা কাউকে বুঝিয়ে দেবার, প্রকাশের প্রথম অনুষঙ্গ হলো পোষাক, আদব কায়দা কানুন - বহিরঙ্গ।

মফস্বল বা পুরানোর চোখে আমি এই নতুন শহরের শহুরে। কিন্তু এর আইকন কী ছিল? অনেক কিছুর মাঝে আগে চোখে পরা হিসাবে দুইটা জিনিষের নাম করতে বললে এর একটা হলো পোষাক হিসাবে ধুতি। অন্যটা একটা নতুন ডাক নাম "বাবু"। মফস্বল বা পুরানোর চোখে আপনি তখন বাবু; এই পুরো পরিবর্তনের এক শব্দে প্রকাশ। বাবু - যে নতুন কলোনী রাজধানী শহরের প্রতীক।

তবে অবশ্যই নেটিভ প্রতিনিধি। বাবু মানে কলোনী রাজধানী শহরের 'জীবন প্রকাশ'। তাহলে সোজা মানে দাড়ালো, বাবু মানে শহুরে, তবে যে সে শহরের নয় সে আমলের কলোনী রাজধানী শহরের। তবে আবার এই শহুরে নতুন জীবনের মানে না বুঝে কেবল বহিরঙ্গে নকলিবাজ বাবুও ছিল; বাবুর ভাব নিত এরা। পাঠক, শরৎবন্দ্র পড়া থাকলে তাঁর উপন্যাসে বাবুর পামসু হারানো নিয়ে নৌকায় নাকানি চুবানির কথা মনে করে দেখতে পারেন।

গল্পটা পড়া থাকলে খেয়াল করবেন, বাবু ওখানে শহুরে জীবনের প্রতীক। কোন ধর্মীয় পরিচয়ের প্রকাশ নয়। আমাদের এখনকার ধুতি ধারণার সাথে এর কোন মিল নেই। ধুতির সাথের ধর্মীয় পরিচয়ের মেলানোর র ঘটনা আরও অনেক পরে। কিন্তু এত কিছু থাকতে ধুতিই কেন গৃহিত হলো? সাহেবের স্যুট-কোট হতে পারত।

এটা অনেকটা, শেখ মুজিবের মুজিব কোট কেন প্রতীক হলো? প্রিন্স কোট না কেন - সেরকম। কখন কি আইকন হয়ে উঠবে এর কোন ধরাবাধা নিয়ম নাই। তবে ধুতি কেন হলো এটা গবেষণা করে জানা যায় নিশ্চয়। তবে সেটা আপনাদের জানানোর চেয়ে অন্য একটা কথা জানিয়ে রাখি; আইকন - সে কোন জীবনের প্রকাশের প্রতীক হোক বা হোক কোন রাজনীতির প্রকাশ - ঐ আইকনেরও পড়তির দিনকাল সময় হয় একটা সময়ে এসে। আইকনে লুকানো চিন্তার প্রভাব ফিকে হয়ে যাবার, দূর্বল দিনকালের সময় কিন্তু ঐ আইকন বা প্রতীকই ঠাট্টার প্রতীক হয়ে যায়।

যেমন মুসলিম লীগের লাল ঝুটিয়ালা তুর্কি টুপির কথা ভাবুন। লাল ঝুটিয়ালা তুর্কি টুপি এখন পরাজিত মুসলিম লীগের প্রতীক। কেউ ব্যবহার করলে মানুষের কাছে ৭১ এ পরাজিত মুসলিম লীগের কথাই আগে মনে পড়বে। ধুতিকে এখনই উদাহরণ হিসাবে টানলাম না। কারণ মাঝের অনেক কথা আগে বলে নিতে হবে।

১৯০৬ সালে মুসলীম লীগ জন্ম নেবার অনেক আগেই ধুতি ও বাবু কলোনী শহুরে নতুন জীবনের আইকন হিসাবে গেড়ে বসা ছিল। না, আর একটু পিছন থেকে বলি। ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস জন্ম নেবার আগে রাজনৈতিক দল কী জিনিষ আমাদের জানা ছিল না। বৃটিশের কলোনী দখলের আগে আমরা তখন মোগল আমলে। রাজা বাদশা নবাবের আমলে রাজনৈতিক দলের কথা চিন্তা করা যায় না।

তো বৃটিশ আমলে প্রতিবাদ প্রতিরোধের ভিতর দিয়ে রাজনৈতিক দল করা যায় এরা বুঝলাম। প্রথম নতুন সংগঠন রাজনৈতিক দলের জন্ম হল। । গোল বেধেছিল এই নতুন সংগঠন, রাজনৈতিক দল করতে গিয়ে। ইন্ডিয়ান ন্যাশন্যালিজম বা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে কংগ্রেস গড়ে উঠে।

ধর্ম বর্ণ জাত ইত্যাদি সব বিভেদ নির্বিশেষে সকল ভারতীয়কে এক জাতীয়তাবাদের পরিচয়ে বেঁধে কলোনী মাষ্টার বৃটিশের বিরুদ্ধে খাঁড়া করে এক আওয়াজ তোলাই ছিল এর উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য সে সফল করতে পারে নাই। সকল ভারতীয়কে নিয়ে এক ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পরিচয় বিনির্মাণে সে সফল হয় নি। জন্মের ২০ বছরের মধ্যে মুসলিম লীগের জন্মই এর প্রমাণ। কংগ্রেস যে ধর্ম বর্ণ জাত ইত্যাদি সব বিভেদ নির্বিশেষে সকল ভারতীয়ের প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পারেনি - তা বলার জন্য আমি এখানে কোন তর্ক, প্রমাণে যাব না।

১৯০৬ সালে মুসলীম লীগ জন্ম - এর মানে হলো, একটা জনগোষ্ঠির এক অংশের কাছে কংগ্রেস নিজেকে তাদের প্রতিনিধি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি। ঐ জনগোষ্ঠিও মনে করতে পারেনি "ভারতীয় জাতীয়তাবাদ" বলে যে নতুন পরিচয়টা দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে এটা তাকেও প্রতিনিধিত্ব করে বা তাঁর স্বার্থের প্রকাশ। এই ক্ষোভ থেকেই এর প্রকাশ ঘটে আলাদা রাজনৈতিক দলের জন্মে। কংগ্রেসে অপ্রতিনিধিত্ত্ব থাকা এই জনগোষ্ঠি কারা, অর্থনৈতিক ভাবে চিহ্নিত করলে আমাদের পূর্ববঙ্গে অঞ্চলে মূলত এরা প্রজা-কৃষক ও শহুরে মুসলমান মধ্যবিত্ত। এদুটোর মধ্যে আমাদের এখনকার প্রসঙ্গের জন্য শহুরে মুসলমান মধ্যবিত্তই কেবল প্রাসঙ্গিক।

কলকাতা পরবর্তীতে সারা বৃটিশ-ভারতের রাজধানী আর না থাকলেও বাংলার রাজধানী ছিল। আগে যেভাবে বলেছিলাম, শহর-মফস্বলের সম্পর্ক সূত্রে, মূসলমান অধ্যুসিত সারা পূর্ববঙ্গ মফস্বল আর এর কাছে শহর, রাজধানী কলকাতা। ভাল ইস্কুল কলেজ পড়াশুনা, মফস্বলের উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার নতুন পেশার সন্ধান, কোর্ট কাচারিকে প্রশাসনকে কেন্দ্র করে ওকালতি পেশা, সরকারি চাকুরি, ইস্কুলে মাষ্টারি - ইত্যাদি সবকিছুকে মিলিয়ে স্বাভাবিকভাবে মফস্বল ছিল শহরের দিকে ধাবমান। এদিকে কলকাতা কলোনী শহরে নতুন শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হতে যখন এরা চেষ্টা করছে ইতোমধ্যে কলোনী শহরের ভিত্তিদান, আদব-কায়দা শহুরে রীতি - এককথায় শহুরে হবার মানে অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ওদিকে পূর্ববঙ্গের নতুন যাদের আগমন ধর্মীয় পরিচয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠই এরা মুসলমান।

অথচ প্রথম কয়েক জেনারেশনে শহুরে যারা হয়েছিল ধর্মীয় পরিচয়ের দিক থেকে এরা হিন্দু। সেই অর্থে ধুতির এই নতুন অভিষেক, প্রতীক যারা ঘটিয়েছিল ধর্ম পরিচয়ে তারা হিন্দু। কিন্তু মনে রাখতে হবে, নিজের ধর্ম পরিচয় প্রকাশের তাগিদ থেকে ওটা ধুতি হয় নি। কারণ, কলোনী মাষ্টারের হাতে গড়ে উঠা শহরে জমিদারী-গোমস্তাগিরি করে নেটিভদের মাঝে যে নতুন শহুরে জীবন প্রকাশ ঘটছে এরই আইকন হলো ধুতি, যাতে অনুপ্রাণিত হবার বীকন নিজের ধর্ম নয়; কলোনি মাষ্টারের সহচর্য, মন, পশ্চিমের মন, "আধুনিক" হবার কথাবার্তা, পশ্চিমের জ্ঞান-বিজ্ঞান সাহিত্য ইত্যাদি - এককথায় মাষ্টারেরই নেটিভ জীবন প্রকাশ। ওর মাঝে নিজের ধর্ম জাহির বা অন্তর্ভুক্ত করে নেবার জায়গা নাই।

খাপে মিলে না। ফলাফলে শহরে এসে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের কাছেও ধুতি শহুরেপনা, বাবুভদ্রলোকের প্রতীক হতে কোনই সমস্যা হয়নি। বেশ কয়েক জেনারেশন পার করে ধুতি আর বাবু জীবন কলোনী শহরের এমন আইকন হয়ে গেড়ে বসেছিল। ফলে শহর-মফস্বলের সম্পর্ক ও পথ প্রদর্শক সূত্রে যে-ই এই শহরে এসেছে বা বা আসার বাসনা রাখে - ধুতি আর বাবু ভাবে জীবন প্রকাশ করা হয়ে যায় তার ধ্যানজ্ঞান। মূলত পড়াশুনা ও তারপর জজ-ম্যাজিষ্টেট উকিল শিক্ষকের চাকুরি এই নতুন ট্রেড ট্র্যকে প্রবেশ ছিল আসবার হেতু বা উসিলা - আর সেই সাথে অনুসঙ্গ পাওনা সহযোগ - কলোনী শহুরের ধুতি আর বাবু জীবন প্রকাশ।

পূর্ববঙ্গের মুসলমানেরা অনেক পরে, দেরীতে কলোনী শহরে শহুরে হতে আসলেও তাদেরও অনুপ্রাণিত হবার বীকন সেই একই , ধুতি আর বাবু জীবন প্রকাশ, কলোনী শহরের শহুরে হওয়া। ধুতি তাই তার কাছেও শহুরে প্রতীক, ভদ্রলোক হওয়া যার আকাঙ্খা। এজন্য আমরা কলকাতায় বড় হয়েছে বা পেশা ছিল এমন মুসলমানদের ৪৭ এর দেশভাগের পরে যারা পূর্ববঙ্গে ফিরে এসেছে এমনদের প্রথম দিকের জীবন প্রকাশের পুরানো অভ্যাসে ধুতি পরা দেখি। অনেকের দাদা বা নানার স্মৃতিতে তাই ধুতি আছে, পাওয়া যায়। ধুতি আর বাবুভদ্রলোকে জীবন প্রকাশ হিন্দু-মুসলমান পরিচয় নির্বিশেষে সবার কাছে শহুরে প্রতীক, ভদ্রলোক হওয়া যার আকাঙ্খা -এই অবস্হা একচেটিয়াভাবে চলতে পেরেছিল মোটা দাগে বললে মুসলিম লীগের জন্মের আগে পর্যন্ত।

পূর্ববঙ্গের অনেক মুসলমান অবস্হাপন্নদের ফরমাল পোষাক ছিল ধুতি। ফরমাল, মানে আজকের দিনের অনেক যেমন স্যুট-কোটকে ফরমাল পোষাক মানেন; বিশেষ জায়গায় যেতে পরেন, পরা উচিত বলে সাব্যস্ত করেন - সেরকম। কলোনী শহুরে প্রতীক ধুতি প্রথম রাজনৈতিক ধাক্কা খাবার ঘটনা ১৯০৫ সালের বঙ্গবঙ্গ। আগে বিশেষণ দিয়েছি ওটা "রাজনৈতিক" ধাক্কার সময়। এর মানে হলো এই "রাজনৈতিক" ধাক্কার সংস্কৃতিতে, পোষাকে এর ছাপ পড়তে স্বভাবতই বেশ কয়েক বছর সময় লেগেছিল।

বঙ্গভঙ্গ মুসলিম লীগের জন্ম নিঃসন্দেহে ত্বরান্বিত করেছিল। পরের বছর মুসলিম লীগের জন্ম হয়। মুসলিম লীগের জন্মের পর এক গুরুত্ত্বপূর্ণ সমস্যা ছিল। ইতোমধ্যে বৃটিশ-ভারতের অলটারনেট বা বিকল্প শাসন ব্যবস্হা, ক্ষমতা কী - সে হিসাবে কংগ্রেসে ২০ বছরের জীবনে অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত। টাল খাওয়া হলেও তাঁর ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সমাজে প্রভাব কম নয়।

এই পরিস্হিতিতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে নিজ সমর্থক জনগোষ্ঠির স্বার্থ নতুন পরিচয় খাড়া করা, মানে নতুন পার্টি প্রতিষ্ঠা করা সহজ কাজ নয়। এমন কী যেখানে নিজের কনষ্টিটুয়েন্সী অর্থাৎ সম্ভাব্য যাদের সমর্থনের পার্টি সে হতে চায় সেই মুসলমানেদের অনেকের উপরই কংগ্রেসের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিদ্যমান ও প্রবল। আমাদের পূর্ববঙ্গের ক্ষেত্রে এখানে ধুতির প্রসঙ্গটা গুরুত্বপূর্ণ। মফস্বল পূর্ববঙ্গের কাছে কলকাতা অভিমুখে শহুরে জীবন প্রকাশ তাঁর ধ্যানজ্ঞান। হোক সে শহর মানে কলোনীর ঔরসে গড়ে ওঠা শহর, হোক সে হিন্দু বা কংগ্রেসী আধিপত্যের শহর - শহর তার কাম্য, আরাধনা, নতুন কায়দায় জীবন প্রকাশের আকাঙ্খা।

এই বিরাজমান পরিস্হিতিতে মুসলিম লীগ বুঝে যায় নিজেকে নতুন বিকল্প হিসাবে পরিচয় বিনির্মাণের জন্য তার প্রথম কাজ কংগ্রেসের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক আধিপত্য ভেঙ্গে ফেলা। সাংস্কৃতিক যা কিছু কংগ্রেসকে মুসলিম লীগের উপরে কমপারেটিভ সুবিধা দেয় তাকে আঘাত করা কর্তব্য জ্ঞান করে। কলকাতা কলোনী শহরে মুসলিম লীগের নিজের আলাদা পরিচয় প্রতীক আইকন দাঁড় করানো মানেই পার্টি হিসাবে দাঁড়ানো কুশন বা বসবার জায়গা তৈরি করা। এই কাজ সহজ করতে সে তার কনষ্টিটুয়েন্সীকে মনে করিয়ে দেয় শহুরে বাবুআনার প্রতীক ধুতি, এর অভিষেক হিন্দুদের হাতে। তথ্য বা সংবাদ হিসাবে কথাটায় সত্যতা আছে কিন্তু একথার অর্থ যেটাকে আমরা বলি 'মানে কী" - কী বলতে চাচ্ছো সেই ইঙ্গিতটা ঠিক না।

ইঙ্গিতটা হলো হিন্দুরা নিজের জন্য বা নিজের ধর্মের জন্য এটা করেছে। এই কথাটা ঠিক না। কারণ ধুতি মানে শহুরে, বাবু-ভদ্রলোক, নতুন জীবনের প্রকাশ, কলোনী মাষ্টারের শহরে জীবন যাপনে অনুপ্রাণিত হবার বীকন, নিজের ধর্ম নয়; কলোনি মাষ্টারের সহচর্য, মন, পশ্চিমের মন, "আধুনিক" হবার কথাবার্তা, পশ্চিমের জ্ঞান-বিজ্ঞান সাহিত্য ইত্যাদি - এককথায় মাষ্টারেরই নেটিভ জীবন প্রকাশ। ধুতির এই নতুন মানে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। যদিও এই নতুন সাংস্কৃতিক মানে ছড়িয়ে পড়তে বহু সময় লাগে।

সময় লাগে আরও একারণে যে মুসলিম লীগের আন্দোলন কংগ্রেসের পাশপাশি ক্ষমতা নেবার পাত্র হিসাবে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য যেমন চলছিল একই সঙ্গে সে সময় মফস্বল পূর্ববঙ্গের কাছে কলকাতা অভিমুখে ধাবমানতা, শহুরে জীবন প্রকাশ তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান - এই আকাঙ্খা স্হগিত ছিল না। মুসলিম লীগের আন্দোলনের সময়কালে মফস্বল পূর্ববঙ্গের কলকাতা অভিমুখে ধাবমানতা বন্ধ হয়ে যায় নি। ফলে একই সঙ্গে পুরানো শহুরে মুসলমানদের ধুতি ত্যাগ ও প্রচারও যেমন চলেছিল সেই সাথে নতুন আগত শহুরে মুসলমানদের অনেকের ধুতিকে বরণ করাও চলেছিল। একই মিশ্র পরিস্হিতি শহর ফেরত বা শহরের প্রভাবে প্রভাবান্বিত মফস্বলের মুসলমানদের। এই স্রোত, বিপরীত স্রোত - একেবারে ধুতি ত্যাগ করে থিতু হয়ে আসে দেশ বিভাগের পরে।

কারণ তখন রাজনৈতিক ভাবে বহু কিছুই সমাধা পেয়ে গেছে, সেই কলকাতাও আর আকাঙ্খার শহর নয়। এবার আকাঙ্খার শহরের নাম ঢাকা। কলোনী মাষ্টারের দিন শেষ হয়ে গেলে এই ধুতি আর বাবু ভাবের শহুরে জীবন প্রকাশ হয়ত আর টিকে থাকত না। (ইন্ডিয়ান কংগ্রেসের পোষাক আইকন বলা যায় নেহেরু টুপি ও খাদির কোট। ) থাকেও নি।

তবে মাষ্টার বিদায় নেবার অনেক আগেই ধুতি কলোনী মানসের শহুরে অর্থ ও প্রতীক নিয়ে আর টিকে থাতে পারেনি; ধর্মীয় পরিচয়ের চিহ্নে অভিযুক্ত হয়ে গেছে। পাঠক হয়ত লক্ষ্য করেছেন উপরে অনেক জায়গায় মুসলীম লীগের জন্ম তারিখ ধরে কথা বলে একটা মাইল ফলক যার সাথে ধুতি জীবন শেষ হওয়ার ইঙ্গিত রেখেছি। মুসলিম লীগ ধর্মকে জনগোষ্ঠির পরিচয় মেনে গড়ে উঠা রাজনৈতিক দল। অনেকে এজন্য একে সাম্প্রদায়িক দল বলে। ধুতি আর শহুরে - এই একাকার সমীকরণ কখন ভেঙ্গে যায় এর মাইল ফলক মুসলিম লীগের জন্ম - এতদূর পর্যন্ত ঠিক আছে।

কিন্তু মুসলিম লীগ এর কারণ নয়। মুসলিম লীগ না জন্মালেও এই সমীকরণ ভাঙতো। মূল কারণ, ধুতি কলোনী মাষ্টারের হাতে জেগে উঠা শহর আর এর বাবু-ভদ্রলোকের প্রতীক।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.