মানুষ যতক্ষণ হাঁটতে পারে ততক্ষণই সুস্থ। মানুষকে হাঁটার জন্য বাধ্য করার প্রয়োজন নেই যদি উপযুক্ত পরিবেশ পায় এমনিতেই হাঁটবে। পরিবেশ দূষণ, যানজট, জ্বালানি সংকট, জলবাযূর পরিবর্তন, অতিরিক্ত মোটা হওয়া ও নানা সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে হাঁটার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির করা জরুরী। ব্যায়ামের অভাব বা প্রয়োজনীয় শারীরিক পরিশ্রম না করায় শিশু ও সব বয়সী মানুষের মাঝে অতিরিক্ত মোটা হওয়া, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিসসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্তের হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সুস্থ থাকার জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ত্রিশ মিনিট এবং শরীরের অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য একঘন্টা হাঁটা প্রয়োজন।
ঢাকা শহরে অনেক মানুষ পায়ে হেঁটে যাতায়াত করে। অনেকের ক্ষেত্রেই পায়ে হেঁটে চলাচল যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম। এর ফলে ঢাকাবাসী একই সঙ্গে দুইভাবে উপকৃত হচ্ছে। যাতায়াতের পাশাপাশি ব্যায়ামের সুযোগও পাচ্ছে। এখন পর্যনত্দ ঢাকায় অধিকাংশ মানুষ হেঁঁটে, রিকশায় এবং পাবলিক পরিবহনে চলাচল করে।
অধিক হারে যান্ত্রিক যানবাহন ব্যবহারে পৃথিবীর অনেক শহরেই অস্বাস্থ্যকর ও বিরক্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। যা মানুষের স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এ অবস্থা মারাত্মক স্বাস্থ্য সঙ্কট তৈরি করছে। সকলকেই স্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে হাঁটা প্রয়োজন। আনন্দদায়ক এবং নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করা গেলে অনেকেই হাঁটতে উৎসাহী হবে।
এমনকি অল্প দূরত্বে গাড়ি পরিহার করে মানুষ হাঁটার প্রয়াস পাবে।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলিতে নগরকেন্দ্রিক যাতায়াত ব্যবস্থায় হাঁটাকে সর্বোচ্চ এরপর ক্রমানুসারে সাইকেল এবং পাবলিক পরিবহণকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রাইভেট গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। যে কারণে সেসব শহরগুলিতে মানুষ প্রাণবন্ত ও জীবন যাপনের মান অনেক উন্নত। নগর এলাকায় রাস্তা, ফুটপাত, পার্ক ও সমগ্র যাতায়াত ব্যবস্থা মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, মানসিক বিকাশের উপর বিশেষ প্রভাব ফেলে।
সমন্বিত পরিকল্পনা ছাড়া নির্মিত অবকাঠামো, যান্ত্রিক যানের ব্যবহার বৃদ্ধি, ফুটপাত ভেঙ্গে ফেলা, ফুটপাতে গাড়ি পার্কিং ও কনস্ট্রাকশনের জিনিসপত্র-ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখা, রাস্তা পারাপারের জন্য ফুটওভার ব্রিজ এর ব্যবস্থা করাসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ আমাদের স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত ও সর্বোপরি হাঁটার অধিকার খর্ব করছে।
ঢাকা শহরে অধিকাংশ যাতায়াত দুই থেকে তিন কিলোমিটারের মধ্যে। উপযোগী পরিবেশ পেলে এই দূরত্বে অনায়াসে হেঁটে যাতায়াত করা সম্ভব। পাশাপাশি সাইকেল, রিকশা এবং অধিক দূরত্বে যাতায়াতের জন্য পাবলিক পরিবহনের ব্যবহার যাতায়াত খরচ, জ্বালানীর ব্যবহার, পরিবেশ দূষণ ও দূর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বৃদ্ধি করবে। তবে ঢাকা শহরে ক্রমেই কম দুরত্বে যাতায়াতের জন্যও কিছু মানুষ প্রাইভেট গাড়ি বা ট্যাক্সি ব্যবহার করছে।
খুব অল্প সংখ্যক মানুষের প্রাইভেট গাড়ি রয়েছে। কিন্তু প্রাইভেট গাড়িকে প্রাধান্য দেওয়ায় যাতায়াত ব্যবস্থার অবনতি হচ্ছে এবং বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে অধিকাংশ জনগণকে।
গাড়ির হর্ন-শব্দ, বায়ূ দূষণ আর দূর্ঘটনার ভয় প্রতি মুহুর্তে হাঁটতে শঙ্কিত ও নিরুৎসাহিত করে। এছাড়া ঢাকার অনেক স্থানে রাসত্দা পারাপারের জন্য ফুটওভার ব্রিজ করা রয়েছে। রাসত্দার মাঝখানে গ্রিল দিয়ে মানুষকে ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে পার হতে বাধ্য করা হচ্ছে।
ভেবে দেখা প্রয়োজন শিশু, নারী, বৃদ্ধ, অসুস্থ, প্রতিবন্ধি মানুষসহ মালামাল নিয়ে ফুটওভার ব্রিজ পার হওয়া সম্ভব কি না? এ ধরনের ব্যবস্থাও শহরে মানুষকে হেঁটে চলাচলে নিরুৎসাহিত করে।
হাঁটার জন্য প্রয়োজন সুন্দর, মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশ। ফুটপাতে বিক্রিত বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী পথচারীদের হাঁটতে উৎসাহিত করে। রাস্তায় হকাররা নিরাপত্তা প্রহরীর দায়িত্বও পালন করে এবং মানুষ হেঁটে চলাচলে নিরাপদ বোধ করে। বিশ্বের অনেক দেশেই রাসত্দার পাশে হকারদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ফুটপাত হকারদের তুলে না দিয়ে সুশৃংখলভাবে ব্যবসা করার পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। যা হাঁটার জন্য মানুষকে আকৃষ্ট করার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে।
ফুটপাত শুধু হেঁঁটে গন্তব্যে যাবার জন্য নয়, এর সঙ্গে নগরবাসীর জীবন-যাত্রার নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। ফুটপাতে পথচারীদের বিশ্রামের জন্য বসার ব্যবস্থা হতে পারে সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নের একটি মাধ্যম। মানুষকে হেঁটে চলাচলে উৎসাহী করার জন্য আকর্ষণীয় পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়োজন যাতে মানুষ নিজ থেকেই হাঁটতে উৎসাহী হয়।
গাড়ি ব্যবহারকারীদের অপেক্ষা হেঁটে চলাচলকারীদের উপর রাস্তার পরিবেশ অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। হেঁঁটে এবং গাড়ী ব্যবহারকারী উভয় শ্রেণীর মানুষের জন্যই ফুটপাত ও রাস্তার পরিবেশ উন্নত করা প্রয়োজন। নিরাপদ ও আর্কষণীয় রাস্তা তৈরি করতে হবে যেখানে শিশুরা নিরাপদে ও স্বচ্ছন্দ্যে হাঁটতে এবং সাইকেলে করে স্কুলে যেতে পারবে। আমাদের এমন একটি শহর তৈরি করতে হবে যাতে মানুষকে প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ ও গনত্দব্যে পেঁৗছতে খুব বেশি দুরে যেতে না হয়। একটি পরিকল্পিত সড়ক ব্যবস্থাপনা পথচারীদের নিরাপত্তা সৃষ্টির পাশাপাশি আনন্দ-বিনোদনের জায়গা হয়ে উঠতে পারে।
যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে হেঁটে চলাচল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পুরো যাতায়াত ব্যবস্থায় এক স্থান হতে অন্য স্থানে যেতে কিছুটা পথ অবশ্যই হাঁটতে হয়। যেমন- পাবলিক পরিবহণ পাওয়ার জন্য স্টেশন পর্যন্ত হাঁটতে হয়। নগরে আমাদের প্রত্যেককেই কম বেশি হাঁটতে হয়। তাছাড়া বর্তমানে ঢাকা শহরে অধিকাংশ যাতায়াত হেঁটে।
তাই হাঁটার পরিবেশ উন্নত একটি বৃহৎ অংশের যাতায়াত সুবিধা নিশ্চিত করা যাবে।
হাঁটার পরিবেশ উন্নয়নে যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন:
* অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হাঁটার সুবিধা বৃদ্ধিতে কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা।
* শহরের সকল এলাকায় হাঁটার পরিবেশ তৈরি করা।
* ফুটওভার ব্রিজ না করে, জ্রেবা ক্রসিং বা সিগন্যাল সিষ্টেম উন্নত করা।
* পথচারীদের নির্বিঘ্নে রাসত্দা পারাপারের জন্য জেব্রা ক্রসিং এর পূর্বে গাড়ি থামানো।
যাতে সব মানুষ বিশেষ করে শিশু, নারী, বৃদ্ধ, শারীরিক প্রতিবন্ধী বা অসুস্থ ব্যক্তিরা সহজে রাস্তা পার হতে পারে।
* ফুটপাতে গাড়ি পার্কিং নিষিদ্ধ করা এবং কার্যকরভাবে তা বাস্তবায়ন করা।
* দূর্ঘটনামুক্ত নিরাপদ হাঁটার পরিবেশ তৈরি করার লক্ষ্যে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
* সকল এলাকায় যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রিত রেখে সুশংখলভাবে চলাচলের ব্যবস্থা করা। দিনের ব্যস্ততম সময়ে কিছু এলাকায় আংশিক গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ করা।
যেমন- হাসপাতাল, স্কুল এবং মার্কেট এলাকা।
* পথচারীদের চলাচলে উৎসাহী ও অপরাধের হাত থেকে নিরাপদ করতে ফুটপাতে সুশৃংখলভাবে ছোট দোকান বা হকারদের বসার ব্যবস্থা করা।
* ফুটপাত কনস্ট্রাকশনের জিনিসপত্র এবং ময়লা-আবর্জনামুক্ত রাখা।
* ফুটপাত প্রশস্ত করা ও ছায়ার জন্য পর্যাপ্ত গাছ লাগানো ও সংরক্ষণ এবং আলোর ব্যবস্থা করা।
* পরিবহণ পরিকল্পনা গ্রহনের ক্ষেত্রে ফুটপাতের পাশে জ্বালানিমুক্ত যানবাহন (সাইকেল, রিকশা) চলাচলকে প্রাধান্য দেয়া।
* মাস/সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে কোন কোন এলাকায় আংশিক বা পুরো সময় যান্ত্রিক যান নিষিদ্ধ করে শুধুমাত্র হেঁটে, সাইকেলে ও রিকশায় চলাচলের ব্যবস্থা করা।
নগর উন্নয়নের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রদান করা হোক অধিকাংশ মানুষের সুবিধাকে। ইট, পাথর, বালি, গাড়ী, যানজট, শব্দ ও বায়ূদূষণের পরিবর্তে মানুষের বসবাসের জন্য পরিবেশ বান্ধব নগর গড়ে তোলাই হোক আমাদের লক্ষ্য। যেখানে আমাদের শিশুরা নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতে পারবে, মানুষে মানুষে থাকবে অটুট বন্ধন, নিশ্চিত হবে সামাজিক সমতা, অগ্রাধিকার পাবে অধিকাংশ মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যে ও সহজে চলাচলের ব্যবস্থা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।