চোখ খুবলে নেয়া অন্ধকার, স্ফুলিঙ্গ জ্বেলে দাও!
রাত বেশি বাকি নেই। এখনই প্রভাতের আলো ফুটে উঠবে। বাতাসের আঘাত বাঁশ বাগানে। দূরের বাড়িগুলোয় প্রভাতবাতি জ্বলছে পিটপিট। হঠাৎ করে পাখিগুলো জাগতে শুরু করেছে।
সারারাত বন্যপ্রাণীর ভয়ে ভীত খোলের মুরগীগুলো ডানা ঝাঁপটাতে শুরু করেছে। মশার কামড় খেয়ে যন্ত্রণাগ্রস্ত গোয়ালের গরু লেজ নাড়ায় আর জাবর কাটে। উঠতি বয়সী মোরগের কড়কড় ডাক। এমন সময়ে কান্নাকাটি করে রসুল মিয়ার সদ্যজাত সন্তান। তিনদিন মাত্র বয়স।
তার আগমনকে ঘিরে সাড়া বাড়ি আনন্দমুখর। যেদিন শোনা গেল রসুল মিয়ার মিয়ার সন্তান এসেছে ঘরজুড়ে, সেদিনই চারদিকে কোলাহল পড়ে গেল। গফুর মিয়ার স্ত্রী ফুলঝুরি বেগম, হাক্কানী মিয়ার বিধবা মেয়ে, খিলা মিয়ার ছোট বউ, জয়নাল মিয়ার মা সহ অনেকেই সারারাত রসূল মিয়ার উঠানে কাদা ছোঁড়াছুড়ি করে নাচানাচি করেছিল। রসূল মিয়া তাঁর ভাঙা সাইকেল নিয়ে বাজারে যায়, বাতাসা আনে, বিলিয়ে দেয় সবাইকে। এ আনন্দ শেষ হয় নি, যেন শেষ হবার নয়।
রসূল মিয়ার স্ত্রী মাজেদা বেগম আঁতুর ঘরে থাকে সবসময়। নজর তার সদ্য প্রসবজাত সন্তানের দিকে। এখনও নাম রাখা হয়নি তার। হঠাৎ করেই মাজেদা বেগম ডাক পাড়ে স্বামীকে। "কোথায় তুমি? কেরাসিন তেলের বোতলডা দ্যাও।
বাতিটি নিভে গেল যে। "
ভূত-পেত্নীর ভয়ে নাকি সারারাত মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখতে হয় আঁতুর ঘরে। প্রদীপে তেল নেই, ফুরিয়ে গেছে এ জন্য যত ভয় মাজেদা বেগমের। সে ভয় অবশ্য নিজের জন্য নয়, সন্তানের জন্য। সব সময় সন্তানটিকে চোখে চোখে রাখে।
তিনদিন গোসল করেনি মা। ঘরময় রক্তের দুর্গন্ধ। রক্তস্রাবে ভেজা কাপড় দেহে জড়িয়ে শুয়ে থাকে। গেঁয়ো মাছির ভনভন করে মাজেদার কাপড়ে। সারাদেহের রক্ত শুষে খেতে চায় রাক্ষুসে মাছির দল।
তবুও বিরক্ত হয়না মাজেদা বেগম, মাছির ভনভনানি তার কাছে গান মনে হয়। বিছানায় উঠে নড়ে-চেড় বসে রসূল মিয়া। অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে দেয়। বাঁশের খুঁটি দিয়ে নির্মিত চৌকির নিচে রসূল মিয়া খুঁজে পায় কালো রঙের তেলের বোতল। পা বাড়ায় রসূল মিয়া ধীরে ধীরে।
চেয়ে দেখে আঁতুর ঘরটি। "কি শুনতি পাও আমার কতা?" দেরি হচ্ছে দেখে আবারও গলা ছাড়ে মাজেদা বেগম। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে তেলের বোতলটি এগিয়ে দেয় রসূল মিয়া। আঁতুর ঘরে পুরুষ মানুষের প্রবেশ নিষেধ সাত দিন পর্যন্ত এ কথা মনে পড়ে তার। সদ্যজাত ছেলেটিকে এখনও দেখেনি রসূল মিয়া।
স্ত্রীকে ভাল করে দেখতে পায়নি সে। ঘরে অর্থবিত্ত না থাকলেও স্ত্রীকে ভালবাসার মত সুন্দর একটা মন আছে রসূল মিয়ার। হয়ত ভালবাসা পাবার ব্যাকুলতা রসূল মিয়াকে কষ্ট দেয়। খাওয়া-দাওয়া হয় না ঠিকমত। গর্ভকালীন সময়েও খাওয়া দাওয়া হয়নি ঠিকমত।
অনেক কাবু হয়ে গেছে মাজেদা বেগম। রসূল মিয়ার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মাজেদাকে ঝাপসা চোখ দিয়ে চিনে নিতে খুব কষ্ট হয়, রসূল মিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সে শ্বাস যেন নবজাতক সন্তানের কানে গিয়ে বাজে।
"ভেতরে আসো না, দ্যাখে যাও কি সুন্দর হয়েছে ছেলে! যেন রাজপুত্তুর।
" স্বামীকে বলে মাজেদা বেগম। সন্তানের মুখটি দেখতে বড় ইচ্ছে করে রসূল মিয়ার। অবশ্য পাড়ার ছোট ছোট ছেলে-মেয়ের কাছ থেকে শুনেছে ছেলের কথা। টকটকে ফর্সা মুখ, শিমুল তুলোর মত নরম হাত-পা নাড়ে। খেলা করে।
আর থেকে থেকে হাসে। অধিকাংশ সময় ঘুমিয়ে থাকে ছেলেটা। চুলগুলো নাকি কোঁকড়া হয়েছে অনেক বেশী। রসূল মিয়া দেখতে চায় সন্তানকে, পারে না, বাঁধা পায়। "না থাক, এখন না।
আর মাত্র চারদিন। তারপরে দ্যাকব চোক্ ভরে। দ্যাখো মাজেদা চারদিন পরে আমার সন্তানকে কোলে নিয়ে আমি কত আনন্দ করি। আমার ভাঙা বাড়ির চাঁদের আলোকে নিয়ে বাড়ির উঠানে আমি খুশিতে নাচব। বাড়ির চারদিকে নিয়ে ঘুরব আমার আদরের ধনকে।
" কথা হয়না আর। রসূল মিয়া পিছনে ফিরে চলে আসে। চলে যায় অন্য ঘরে। সেটা অবশ্য ঘর নয়, তাল পাতার ছাউনি দেওয়া রান্নাঘর। নিজের সন্তানকে কোলে নিয়ে অস্ফুট স্বরে কাঁদে মাজেদা বেগম।
নিজের অজান্তেই সন্তানকে বলে "ক্যান বাবা তুই রাজপুত্তুর হয়ে আমার ঘরে এলি? তুই কি আমার ভাঙা ঘরে সুখে থাকবি?" ঘুম ভাঙে ছেলেটির, মায়ের কান্নার আওয়াজ শুনে জেগে ওঠে সে। অস্ফুট কান্নার সুর বাতাসে মিশে যায়। এমন সময় আজানের সুর ভেসে আসে। সে ভোরের আজান। রসূল মিয়া ভাঙা কালো বদনাটি ডান হাতে নিয়ে শ্যাওলাপড়া পুকুর ঘাটের দিকে যায়।
পায়ে সাদা সুতো দিয়ে সেলাই করা চটি। আওয়াজ হয় টস.....টস.......টস। অজু করে রসূল মিয়া। তারপরে কাসেম মৌলভীর খামারের মসজিদে নামাজ পড়ে। প্রার্থনা করে, অথচ কি প্রার্থনা করে তার অর্থ সে বোঝে না।
রসূল মিয়ার বোঝার দরকারও পড়ে না। কি করে দিনরাত মাঠে পরিশ্রম করে আবাদ বাড়ানো যায় তা বুঝলেই হলো। সূর্যের লাল রশ্নি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। বাচ্চা মেয়ে ফুলির রান্না করে রাখা পানতা ভাত তিন দিনের পঁচা মরিচ দিয়ে গপাগপ গিলে খায় রসূল মিয়া। গোয়াল থেকে হাক্কানি মিয়ার দেওয়া পুষনি গরু খুলে চলে মধ্যপাড়ার মাঠে।
রসূল মিয়ার জমির পাশে হাপাঁনি রোগী রজব মিয়া পাতার বিড়ি খায় আর ডাঁটা শাক তোলে। চেঁচিয়ে ওঠে রজব মিয়া- "খবর শুনচো মিয়া, গিরাম থেকে সবাই মিলে শহরে যাওয়া লাগবে। দুডো ট্রাক আসবে আমাগের নিতে। " হঠাৎ শহরে যাবার কথা শুনে ভাবনায় পড়ে রসূল মিয়া। জানার জন্য বলে "ক্যান"? "বুজলে না মিয়া? ঢাকা থেকে রাজনীতিক ন্যাতারা আমাগের কল্যাণের কতা কবে।
তুমি গুছ্যায় থ্যাকো মিয়া। " অনেক ভাষণ শুনেছে রসূল মিয়া। আর কত? আর কত শুনবে জনগণের কল্যাণের কথা? ভাষণে আর বিশ্বাস নাই রসূল মিয়ার। ভাষণকে ঢাক পেটানোর শব্দ মনে হয়, সাধারণ মানুষের বুকে লাথি মারার শব্দ মনে হয়। এরপরেও নতুন করে ঢাকার নেতার কি বলতে চায় রসূল মিয়ার জানার আগ্রহ বাড়ে।
আবারও শুনবে নেতার কথা। হঠাৎ করেই রসূল মিয়ার গ্রামের ধুলোমাখা পথের কথা মনে হয়। জনগণের কল্যাণের মানেটা কি এই?
মানুষের ঢল শহরের মাঠে। শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা বেশী। চোখে মুখে আশার প্রতিচ্ছবি সবার।
শুধু মানুষ নয়, মানুষের গায়ের জামাগুলোর চোখে পড়ে। কত রকম মানুষ। চোখ কোটরে ঢোকা মানুষ, নাক বোচা মানুষ, অন্ধ মানুষ, ঘুষখোর মানুষ, সবাই শুনবে ঢাকার নেতা কি বলেন?
এমন সময় নেতা খুক খুক করে কেঁশে নিলেন। সে কাশি হয়ত প্রবঞ্চনার র্কাঁশি। মুখস্ত বক্তব্যকে জনসমক্ষে উগড়ে দেবার কাঁশি।
গলা ছাড়লেন নেতা জোরে জোরে। অনেক কথা বললেন। সাধারন মানুষ অবাক বিস্ময়ে তাঁকায় নেতার দিকে। দেশের জন্য এত টান? লোকটা গণতন্ত্রের কথা বলে। রসূল মিয়া গণতন্ত্র কি বোঝে না।
কেবল এটুকু বোঝে নেতার হাঁক বর্ষাকালে অনর্থক ব্যাঙ ডাকার শব্দ মনে হয়। অন্য মানুষ নেতার বক্তব্য শুনলেও রসূল মিয়া নেতার দামি হাত ঘড়ি আর কালো কোট দেখে, অবজ্ঞায় দুচোখে ঘুম ধরে। হঠাৎ করেই সাদা ধোঁয়ায় ঢেকে যায় আকাশ। অন্ধকার নয়, যেন শীতের গাঢ় কুয়াশা। লোক ছুটাছুটি করে।
অন্ধ লোকগুলো পথ খুঁজে পায় না। জনসভা পন্ড হয়। বোম করে ফেটে ওঠে গ্রেনেড। সবাই যার যার গন্তব্যে পৌছয় গাড়িতে, পায়ে হেঁটে, নৌকায় কিংবা সাইকেলে। আবারও ব্যস্ততা বাড়ে মানুষের।
প্রতি বর্ষায় গাড়ি চাকা ভাঙে, বেড়ার স্কুলে পচন ধরে, বিলপাড়ের ব্রীজ ভেঙে পড়ে। রজব মিয়া বিড়ি খায়, হাঁপানি বাড়ে, তবুও ডাঁটা শাক তোলে। রসূল মিয়ার সদ্যজাত সন্তান হাত পা নাড়ে, বড় হয়। কিন্তু রসূল মিয়া আসেনা! সাধারণ মানুষের কল্যাণ হয় না। কল্যাণের বাণী মাজেদা বেগমের আঁতুর ঘরে তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে থাকে।
মাজেদা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
(প্রগতির পরিব্রাজক দল ঢাকা কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত ভাঁজপত্রে প্রকাশিত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।