আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আঁতুর ঘর ফিরে দেখা/৬



১৯৭০ সাল । বিশ শতকের বাঙালিদের ইতিহাসে এই সালটি একটি মাইল স্টোন বিশেষ । আর ঐ সময় বয়সটা যাদের জটিল তারুণ্যের তাদের কাছে সন'টা আরো এক বিশেষ তাৎপর্য্যের । কারণ বস্তুগত ভাবে পৃথিবীকে জানার চেনার পর্বটি শুরু হয় সেই শৈশবেই, আর বিষয়গত ভাবে পৃথিবীটাকে জানার পর্বটি শুরু হয় এই তারুণ্যেই । এই বয়সেই তৈরী হয় অজানাকে জেনে ফেলার, ধরে ফেলার এক অপ্রতিরোধ্য খিদে ।

ফলে আহত বিক্ষিপ্ত হওয়ার কালটা এই তারুণ্যেই বেশী । এই ১৯৭০ সালেই পৃথিবীর ইতিহাসে বিভক্ত দুই বাংলা দুটি পৃথক লড়াইয়ে অবতীর্ণ । একটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম-যুদ্ধ । অন্যটি একটি বিপ্লব প্রয়াস । দুটিই সশস্ত্র অভ্যুত্থান ।

কালক্রমে একটি সফল । স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের মধ্য দিয়ে । অন্যটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে রাস্ট্র- শক্তির হাতে । এইরকম একটি সময়ে আমি আমার কিছুটা রং চটে যাওয়া ফুল তোলা টিনের বাক্সটি নিয়ে ফিরে এলাম শিলিগুড়ি । এই এক বছরে যেন আমার অনেক বয়স বেড়ে গেছে ।

তারুণ্যের নমনীয়তা পেছনে ফেলে ততদিনে কিছুটা রূঢ় যুবক হয়ে পড়েছি । সেই বছরেই ভর্তি হয়ে গেলাম কলেজে । একই কলেজে ফুলদার তখন ডিগ্রি সেকেন্ড ইয়ার । ভর্তির পর আমাকে সে পই পই করে বোঝালো কলেজ এবং শহরের পরিস্স্থিতি । আমি যেহেতু নিজেকে তখন বেশ অভিজ্ঞ মনে করছি তাই ফুলদার কথায় বিশেষ গুরুত্ব দিলাম না ।

প্রথম প্রথম কলেজে যাওয়া ক্লাস করা ঠিক মতো চললেও কিছুদিনের মধ্যেই দেখলাম কলেজে প্রায়শঃই কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে গোলমাল , মারামারি, বন্দ্‌-ইত্যাদি শুরু হয়ে গেল । এত গুন্ডা মস্তান কলেজে পড়ে? পরে জানলাম কলেজের ছাত্র নয় এমন অনেক গুন্ডা মস্তান কলেজটাকেই তাদের লীলা ক্ষেত্র করে ফেলেছে । সুবিধে হলো তখনও বিনা নোটিশে কলেজে পুলিশ ঢুকতে পারেনা । ফলে যায়গাটা তাদের কাছে বেশ নিরাপদ । তখনকার শিলিগুড়ি শহরে যেহেতু একটাই কলেজ ছিলো তাই ভিড় সামলাতে সেটা তিন সিফ্‌টে চলতো ।

মর্নিং ডে এবং ইভ্‌নিং । ইভ্‌নিং এর অবস্থা তখন আরো খারাপ । ক্লাসে ক্লাসে অনেক আর্মড স্টুডেন্ট থাকতো । তারা পড়াশুনার চেয়ে বেশী রাজনীতি করতো । তাদের মধ্যে অনেকেই নক্সাল রাজনীতির কর্মী ছিলো ।

এতদিন আমরা দূর থেকে রাজ্যটার বিষয়ে জানতে পারছিলাম । এবার একেবারে চাক্ষুষ । মাঝে মাঝে প্রায় আমাদের ঘাড়ের উপরও পড়ছে পুলিশের হাত । খবরের কাগজে প্রতিদিন খুনের খতিয়ান । কোন জেলায় কত খুন।

বাইরের দু'একটা রাজ্যেও এমন খবর কিছু তৈরী হচ্ছে । কিন্তু আমাদের রাজ্যে সর্বত্র । দেয়ালে দেয়ালে বিপ্লবের ডাক । আন্ডারগ্রাউন্ড সাংগঠনিক কাজ । কোথায় কখন কি হবে বোঝার উপায় নেই ।

নিয়ম করে কলেজে যাই । গিয়েই শুনি কাল রাতে অমুককে পুলিশে তুলে নিয়ে গেছে । কলেজ বন্দ । অমুককে তিনদিন পাওয়া যাচ্ছেনা । কলেজ হরতাল ।

ঐ সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়া মানে মৃত্যুর মুখোমুখি থাকা । অথচ সেই সময় একদিন শুনলাম কলেজে আমাদের সারাক্ষণের সঙ্গী শিবাজী কে ভোর রাতে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে । সবচেয়ে নিরিহ, রামকৃষ্ণ মিশনে পড়া ছেলে শিবাজী কে কেন তুলল ---আমরা বিভ্রান্ত এবং আতংকিত । যতদূর জানি শিবাজীর একটি ছোট বোন আছে । মা বিধবা ।

নার্সিং হোমে আয়ার কাজ করে সংসার চালায়, ছেলেকে পড়ায় । আমার স্কুল জীবনের সহপাঠিও সে । পরিস্থিতি ক্রমে আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে । এবার শুনছি খুন । আজ মানস খুন হচ্ছে ত কাল খুন হচ্ছে রঞ্জন ।

আর একটু একটু করে বুক ভাঙছে আমাদের । আমরা যারা এই রাজনীতির আবর্তে পড়ে গেছি, অথচ জানিনা এর উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য কোনোটাই । এই বিবদমান মূল তিনটি দল হলো একটি মার্কসবাদী কম্যুনিস্ট, একটি মাওবাদী কম্যুনিস্ট এবং আর একটি তখনকার জাতীয় কংগ্রেস । সেই সময় এই তিন দলের সমীকরণ সাজানো ভীষণ কঠিন হয়ে পড়েছিলো । ছোট্ট করে বললে বলা যায় ভারতে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা পার্টি ছিলো কম্যুনিস্ট পার্টিই ।

বিপ্লবের পথ ও পন্থার প্রশ্নেই তারা প্রথম ভাগ হয় । তারপর ১৯৬৪ সনে তারা আবার ভাগ হয় । এবারের ভাগ হওয়ার মধ্যে অন্যতম বিষয় ছিলো সশস্ত্র বিপ্লব । ভাগ হওয়া একটা অংশই হলো মাওবাদী কম্যুনিস্টদের দল । তারা ১৯৬৭ সনেই শিলিগুড়ির কাছে নক্সালবাড়িতে সশস্ত্র বিপ্লবের সূচনা করে ।

ক্রমে এই দল তার ডালপালা ছড়িয়ে দেয় সারা প:বঙ্গে এবং অন্যান্য কয়েকটি রাজ্যে । ষাট/সত্তর দশকে রাজনীতি বলতে এই ধরণের বাম রাজনীতিই আমরা বুঝতাম । সেই বয়সে যেমন মার্কসবাদ আমি পড়িনি তেমনি পড়িনি বিপ্লবের ম্যানিফেস্টো । পড়েছি সে সব অনেক পরে । তথাপি শোষিত মানুষের কথা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পাবে --ক্রমে শোষণ মুক্তি ঘটবে ---এই আশায় এই সব রাজনৈতিক তৎপরতার প্রতি আমাদের একটা নীরব সহানুভুতি, সমর্থন তৈরী হতে লাগলো ।

(ক্রমশঃ)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।