জীবন গঠনে নিজেস্ব প্রতিক্রিয়ার দায় বেশি, ঘটে যাওয়া ঘটনার ভূমিকা সামান্য।
কলকাতায় না যেতেই আমি কলকাতা শহরটাকে খুব চিনতাম। অনিমেষ, অর্ক, দীপাবলী, ধ্রুব আর রেমি, কাকাবাবু, ফেলুদা, সুনীলের পূর্ব পশ্চিমের চরিত্ররা, যাদের সাথে আস্তে আস্তে বড় হলাম, তাদের সবার শহর কলকাতা। এসপ্লানেড, দমদম, ঢাকুড়া, সল্টলেইক, জিজ্ঞাসা করলে এরকম গড়গড়িয়ে দশ বারোটা জায়গার নাম বলে দিতে পারব অনায়েসে। অমিত আহমেদের গন্দম পড়ে যখন একেবারে ঢাকার ছেলেটাকে দেখলাম কলকাতায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন যাওয়ার ইচ্ছাটা খুব করে ধরল।
সুযোগও চলে আসল। বাংলাদেশ থেকে ফিরে আসার সময় আমাদের এমিরেটসের প্লেইনটা উড়বে কলকাতা থেকে। তাই দেশ থেকে কলকাতা যাওয়ার পথটুকু আমাদের নিজেদের দেখতে হবে। বাংলাদেশ থেকে যাবো বিমানে। বিমানের যেহেতু অধিকাংশ ফ্লাইটই হয় যায়গামত পৌঁছায় না বা পৌঁছালেও অন্তত: ঘন্টাখানেক দেরি করে, তাই আমরা ঠিক করলাম এক দিন আগেই চলে যাবো কলকাতা।
একটা ফ্লাইট মিস হলেও দ্বিতীয় ফ্লাইট তো থাকবেই। সেটাও মিস করলে কপালের দোষ দেয়া যাবে।
তারপর, খুব কুয়াশা ঢাকা সকালটায়, অনেক কেঁদে কেটে, এয়ারপোর্টে কফির গ্লাস উল্টে ফেলে, খুব কাছের মানুষটার ভোঁতা মুখটা শেষ বারের মত দেখে নিয়ে সকাল ৯.২০ এর ফ্লাইটে উঠলাম ১০.৩৫ এ। সারা বোয়িঙে যাত্রী সর্বসাকুল্যে পনের জন। অথচ বিদায় নিতে নিতে ৯টা বেজে গিয়েছিল বলে বিমান বন্দরের কাস্টমসে অফিসাররা সে কি ঝাড়ি! ঘাড় ফিরিয়ে আমি শেষ বারের মত নওকে দেখতে গিয়েই আবার ঝাড়ি খেয়েছিলাম, 'হইছে হইছে, এখন আর মায়া বাড়ায় লাভ নাই।
'
প্লেইন দিয়ে বাংলাদেশের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় কুয়াশার চাদরে মুড়ানো মায়া মায়া দেশটাকে শেষ বারের মত দেখা হলো না। কয়েকটা নির্ঘুম রাতের মাশুল দিতে গিয়ে ঘুমে চোখ খোলা রাখতে পারছিলাম না। একটু পর পর মাথাটা বিচ্ছিরি ভাবে ঢলে কাঁধে গিয়ে ঠেকছিল। চোখ খুললাম একেবারে দমদমে, ভাইয়ার চেঁচামেচিতে। ওর কাছে 'আন্তরাষ্ট্রীয়' বিমান বন্দর কথাটা খুব মজা লেগেছে।
ঢাকায় শব্দটা 'আন্তর্জাতিক'।
ভিতরে ঢুকে এরকম আরও খটমটে, মজার বাংলা চোখে পড়লো। টয়লেটের জায়গায় 'শৌচাগার'। এগজিট - নিষ্ক্রমণ, এরাইভাল - আগমন, ডিপারচার - প্রস্থান, ইন্টারন্যাশলান ডিপারচার - বহির্দেশ যাত্রা, ভিউয়িং গ্যালারী - দর্শন অলিন্দ। কথ্য ভাষায় এসব শব্দ কি ব্যবহার করা হয় কলকাতায়? জানার সুযোগ পাই নি।
তবে বাংলায় অনুবাদ করার জন্য এই তীব্র চেষ্টাটা বাংলাদেশে কম দেখা যায়, টয়লেটের মত যেসব শব্দের ইংরেজি প্রচলিত হয়ে গিয়েছে, সেগুলোকে সেভাবেই বাংলায় বানান করে লেখা হয়। আমাদেরটাই হয়তো বেশি প্র্যাকটিকেল, কিন্তু এরকম মিষ্টি অনুবাদগুলো পড়তে খুব মজা লাগছিল।
এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই অবশ্য ওই মুগ্ধতাটা পুরাপুরি ভুলে গেলাম ভীষণ ভাবে ঠকে গিয়ে। কলকাতায় নতুন শুনে প্রথমই খুব সহৃদয় এক ব্যক্তি এসে আমাদের ব্যাগ বোচকা টেনে নিয়ে গেল একটা প্রাইভেট কারের কাছে, সেই গাড়িতে নাকি এসি 'ফিট' করা আর সেজন্য আমাদের হোটেল পর্যন্ত যেতে দিতে হবে সাতশ' টাকা। অথচ মামনি বাবারা সারাদিনে পুরা কলকাতা শহর ঘুরেছে আটশ' টাকায়।
ঘাপলা আছে নিশ্চয়ই! আমরা নিজেরাই ভুরু কুঁচকে আবার ব্যাগ বোচকা টানতে টানতে এয়ারপোর্টের কাছে ফিরে আসলাম। এবার আসলো খাঁটি কলকাতার উচ্চারণের একজন স্বঘোষিত বাংলাদেশী লোক, সে নাকি ফরিদপুরের মানুষ। দেশী মানুষদের জন্য খুব প্রাণ কাঁদে, ঠকতে দেখে উদ্ধার করতে এসেছে আমাদের। তার নিজেস্ব এম্বেসডার গাড়িগুলো আছে ওই যে ওইখানে পার্ক করা (লোকটা আংগুল দিয়ে দেখালো), সেগুলো দিয়ে সে নিয়ে যাবে মাত্র সাড়ে তিনশ টাকায়, হলুদ ক্যাবের মত একই ভাড়ায়। হলুদ ক্যাবগুলোও আছে কাছাকাছি, কিন্তু ওগুলো প্রিপেইড, ঝামেলা বেশি, আবার এয়ারপোর্টের ভিতরে ঢুকতে হবে।
তাছাড়া, এই এম্বেসডার গাড়িগুলোতে এয়ারপোর্ট থেকে যাওয়ার সময় ভাড়া বেশি, কিন্তু আসার সময় একদম খালি আসে। খচাৎ করে একটা নাম্বার লিখে দিল আমাদের, যেদিন আসতে চাইব, সেদিন ফোন করে দিলেই একেবারে 'বিনা ভাড়ায়' নিয়ে আসবে আমাদের, যেটা হলুদ ক্যাব করবে না।
আমরা তবু অনিশ্চিত ভংগিতে হলুদ ট্যাক্সিগুলোর দিকে তাকাচ্ছিলাম, পরিচিত যান, কেমন যেন একটা নিশ্চয়তা আছে, লোকটা এবার মুখ শক্ত করল, 'ঠিক আছে যেতে পারেন, আপনাদেরই কষ্ট বেশি হবে, আসলে আমার মন পরিষ্কার, দেশি মানুষ দেখে সাহায্য করতে এসেছিলাম। ' কিন্তু আমাদের তো এতগুলো ভারতীয় টাকা নেই যে! 'ঠিক আছে দাদা, বাংলাদেশী পাঁচশ টাকা দিয়ে দেন, আমি প্রায়েই দেশে যাই, আমার কাজে লাগবে'! আমরা কিছু বলার আগেই আরেকটা লোক এসে সুটকেসগুলো গাড়ির পিছনে ঠেশে ভরলো, তারপর, হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইল! দশটাকা? দাদা, একি কথা… সুটকেসগুলো গাড়ি থেকে নামিয়ে হোটেলের কাছে ফুটপাথে রাখার জন্য আবার ড্রাইভার হাত পাতলেন… আরও পরে, হোটেলে ফিরে গিয়ে যখন একটা হলুদ ক্যাবের ট্যাক্সিওয়ালাকে আমাদের ভাড়ার কথা বললাম, তখন সে সবগুলো দাঁত বের করে হাসা শুরু করল। ভাড়া নাকি বড়জোর দু'শ, তার বেশি না কিছুতেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।