অনেকদিন আগে আমাদের এক শিক্ষক বলেছিলেন, " শিকল ভাঙতে হলে, শিকল পরতে হবে" । কবি নজরুল অবশ্য তারও অনেক আগে বলেছিলেন, "শিকল পরেই শিকল তোদের করবোরে বিকল"।
আমাদের শিক্ষক তাঁর শিক্ষকতার শিকল ভেঙ্গেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন তিনি। প্রচ্ছন্নভাবে ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করতেন কিভাবে ডিপার্টমেন্ট এর নষ্ট পরিবেশের (!) জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।
তিনি নিজেও সোচ্চার হয়েছিলেন। ফলে তার বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের ছিল বিস্তর অভিযোগ। হয়তো তার কথার সত্যতা ছিল, হয়তো ছিলনা। কিন্তু আমরা যারা মফস্বল থেকে এসেছি, ঢাকা শহরে ঠাঁই থাকলেও বুকে সাহসটা একেবারেই নেই তারা তাঁর কথায় মাথা হেলিয়ে কাত হয়ে গেলেও কাজে কিছুই করিনি। তাকে বরং সাহায্য করেছিল আমাদের রাজনীতি করা সহপাঠীরা।
বিভিন্নভাবে। (ভাবগুলো আর উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করিনা)। ইনি একমাত্র শিক্ষক যাকে আমরা 'স্যারের' বদলে 'ভাই' ডাকতাম। শেকল ভাঙ্গার প্রস্তুতির নমূনা হিসেবে।
একবার তিনি হঠাৎ আমাদের সেমিনার রুমের সামনে হাজির।
আমরাও দাড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম বন্ধুরা মিলে। তাঁর হাতে ধবধবে সাদা একটা বিড়াল। বিড়ালের গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, শোনো, আজ আমার বিচার হবে ডীনের (নামটা বললামনা আত্মরার্থে) কোর্টে। আমরা সাহস দিয়ে বললাম, যান ভাই, কিচ্ছু হবেনা আপনার। উনি হাসলেন।
বিড়াল নিয়েই বোধহয় তিনি ডীনের কোর্টে গেলেন। তারপর আর কি হয়েছে জানিনা। পরদিন দেখলাম উনি হাসিখুশি। এধরনের কার্যক্রম তিনি নাকি ইতোপূর্বেও আরেকবার করেছেন শুনেছি। সেবার ডিপার্টমেন্ট-র চেয়ারম্যানের রুমে।
সেবার নাকি তিনি বিড়ালকে অনুরোধ করেছিলেন চেয়ারম্যান মামাকে সালাম করার জন্য। সত্যমিথ্যা জানিনা। কাহিনীর অনেক ডালপালা গজায়, এটারও মনে হয় তাই হয়েছে।
আমাদের সেই স্যারভাই হঠাৎ শুনি জাপান চলে গিয়েছেন। মাস তিন, চার পাঁচ কি ছয় পরে হঠাৎ তাকে দেখি ক্যাম্পাসে।
আমরা হাকিম চত্বরে আড্ডা দিচ্ছি। শীতের শেষদিকে। বিকেল মনে হয় চারটা হবে। আচমকা লাল একটা প্যান্ট, কালো বা হলুদ শার্ট (ঠিক মনে নাই), জ্যাকেটের চেন খোলা, পায়ে কেডস, চোখে লাল ফ্রেমের কালো চশমা পরা এক লোক এসে বললো 'কি কমরেডরা , কি খবর তোমাদের?' আমরা তো মহাবিরক্ত। এমন করে কেউ রসভঙ্গ করে! বললাম, 'ভাই, চাপেন'।
সাথে সাথে একটু উষ্মার সাথে ' কি মিয়া তোমরা আমারে চিন নাই?' এবার উনাকে চিনলাম। এতো আমাদের স্যারভাই কিন্তু একি চেহারা! চা খেতে খেতে যা আলোচনা হলো, তাতে তার শিকল ভাঙ্গার কথা তো ছিলইনা বরং ছিল জাপানী কন্যাদের সৌন্দর্যের বর্ণনা। স্যার বেশ ফ্রী ছিলেন (!)
অনেকদিন দেখা নেই । শুনেছি তিনি নাকি গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন। একবার নাকি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্ধিতা করেছিলেন।
জানিনা জয়ী হয়েছিলেন নাকি পরাজিত। আর খোঁজ পাইনি।
আমাদের এই স্যারের সমকালীন শিক্ষক যারা ছিলেন তাদের কেউ আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। বিশেষ বিশেষ সময়ে বাংলাদেশে আসেন বিশেষজ্ঞ হিসেবে। পত্রিকায় তাদের সাক্ষাৎকার পড়ি।
কেউ আবার বিশ্বব্যাংকের বড় পদাধিকারী। কিন্তু আমাদের শিক্ষক/ভাই আর আসেননা। কোথায় যে হারিয়ে গেলেন!
আজ এতদিন পরে কখনও কখনও মনে হয়, স্যারের সাথে দেখা হলে জিজ্ঞাসা করতাম, ভাই, শেকল ভাঙ্গারীর কাজ কেমন চলছে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।