শিকল
পারভেজ রানা
উঠোন ঝাট দিচ্ছিল পারুল। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সায়েমের নজরটা সেদিকেই চলে গেল। এই সেদিনও পারুল কত ছোট ছিল। আর এখন পারুলের সারা অঙ্গ দিয়ে যৌবন বেয়ে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া যুবক সায়েম পারুলের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারে না।
গরীব ঘরের মেয়ে পারুল সায়েমদের বাড়িতে কাজ করে। হেট হয়ে উঠোন ঝাট দিচ্ছে সে। কামিজের নিচে তার লুকানো সম্পদ লুকোচুরি খেলছে। সেমিজ বা ব্রা কোনটিই সে পরেনি। কেনার মত সাধ্য তাদের নেই।
সায়েম প্রাণ ভরে সেই খেলা দেখছে। হঠাৎ যেন তার সহ্য হলো না। সে হাক দিলো, এই পারুল দেখ তো আমার ব্রাশটা কোথায়?
কোথায় আবার? থাকলে আপনার ব্যাগের মধ্যেই থাকবে। কালকেই তো বাড়ি আসলেন।
এনে দিতি পারছিস নে?
এই তো দিচ্ছি।
ঘরের সব কাজ পারুল নিপুণ হাতে করে। সায়েমের মা-বাবা তার ’পরে সন্তুষ্ট। কাজের মেয়ে হলেও পারুলের নিজেকে কখনো তেমন মনে হয় না। গ্রামের স্কুলে ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছে সে। পারিবারিক অনটনে পড়াশুনা এগোয়নি তার।
এ জন্যই সায়েমদের বাড়িতে কাজ করে। সায়েমের ব্যবহারও তার কাছে ভালো লাগে। সায়েমকে সে সায়েম ভাই বলে ডাকে। সায়েম তার নাম ধরে ডাকে। কিন্তু এবার বাড়িতে এসে সায়েমের গলার স্বর কেমন যেন আন্তরিক আর মোলায়েম হয়ে গেছে।
পারুল বুঝতে পারে না, কেন সায়েম এমন মোলায়েম করে কথা বলে। সন্ধ্যা বেলা পারুল বাড়ির পাশের পুকুরে গিয়েছিল হাসগুলোকে তাড়িয়ে আনতে। ওখানেই সায়েম তার জন্য অপেক্ষা করছিল। পারুল হাসগুলোকে ডাঙ্গায় উঠায়। সায়েম তাকে ডাকে, পারুল শোন ।
কী বলবেন, বলেন?
এতো ব্যস্ত করছিস ক্যান?
আমার হাতে অনেক কাজ।
তোর সাথে আমার অনেক জরুরী কথা আছে।
আমার শোনার টাইম নাই।
রাতির বেলা একটু পুকুর পাড়ে আসবি?
রাতির বেলা আবার কী কথা?
আসলিই জানতি পারবি।
আমি আসব না।
পারুল চলে যেতে উদ্যত হয়। সায়েম তার হাত টেনে ধরে। প্রথম বারের মত পারুল বন্দী হয়, একজন পুরুষের হাতে। সায়েমের শক্ত হাত তার শরীরের মধ্যে বইয়ে দেয় এক অদ্ভূত শিহরণ।
হাত ছাড়েন।
পারুলের কণ্ঠস্বর শীতল।
ছাড়ব। আগে বল তুই রাতে আসবি।
আসব। নিস্তার পাবার জন্য এ ছাড়া তার গত্যন্তর ছিলো না।
পারুলের এর পরের মুহূর্তগুলি কেটে যায় শিহরণে, দোদুল্যমনতায়, ভালো লাগায়। সে বুঝতে পারে- তার কোন উপায় নেই, তাকে যেতে হবে। পুকুরপাড়ে রাতের আঁধারে সায়েম আগেই বসেছিল। পারুল আসতেই সে তাকে পিছন থেকে জাপটে ধরে। গভীর আবেগে উচ্চারণ করে সেই চিরায়ত তিনটি শব্দ- আমি তোমাকে ভালোবাসি।
পারুল তার বাহু বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারে না। সে বুঝতে পারে এখানে এসে সে কী ভুল করেছে।
সায়েম ভাই আমাকে ছেড়ে দেন। আপনারা বড় লোক, আপনাদের সাথে আমাদের ভালোবাসা হয় না।
পারুল আমি তোকে বিয়ে করব।
আমার মনের রাণী করে রাখব।
চাচা-চাচী কোনদিনই মেনে নেবে না।
সে আমি বোঝব। পারুল, জীবনে এই প্রথম কোনো মেয়েকে আমি ভালোবেসেছি, আর সেটা হচ্ছিস তুই। তোকে কী করে বুঝাবো, তোকে আমি কত ভালোবাসি।
পারুল তার ভালোবাসায় ভুলে যায় ধনী-গরীবের ব্যবধান। সায়েমকে তার একটুও অবিশ্বাস হয়নি।
পারুলকে কাজ করতে বিভিন্ন সময় সায়েমের ঘরে যেতে হয়। সায়েম এই সব সুযোগ কখনোই হারায় না। তাকে বুকের মধ্যে জড়িযে নেয়।
আদর করে। পারুলের বুকের দু’টি সম্পদকে সে আনন্দের উৎস রূপে ব্যবহার করে। পারুলেরও এসব মন্দ লাগে না। মাঝে মাঝে অস্ফুট স্বরে বলে, ছাড়ো, হঠাৎ কেউ এসে পড়বে। সায়েম কখনো নিবৃত হয়।
কখনো হয় না। সায়েম শুধু এতেই তৃপ্ত ছিলো না। পারুলের চূড়ান্ত ভালোবাসা পাওয়ার জন্য সে মরিয়া হয়ে ওঠে। সায়েম সে সুযোগ পেয়েও যায়। তার মা বাপের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল।
বাবা বাজারে ব্যবসা দেখছে। সায়েম সুযোগটাকে পুরোপুরি কাজে লাগায়। পারুলকে ঘরে ডেকে বলে, আজ তোকে এমন এক জিনিস উপহার দেব যা তুই জীবনেও দেখিসনি। পারুল কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে, কী?
সায়েম ব্যাগের ভেতর থেকে একটা ব্রা বের করে। গতকাল বড় বাজার থেকে কিনে এনে রেখেছে।
‘এটাকে বলে ব্রেসিযার, নে পরে ফেল। ’
পারুল জিনিসটা হাতে নেয়। নেড়ে চেড়ে দেখে বুঝতে পারে এটা কোথায় পরতে হবে। লাজ নম্র হয়ে বলে, ‘আমার লজ্জা করছে, তোমার সামনে পরতে পারব না। ’
সায়েম তার লজ্জা ভাঙ্গতে চায়।
‘লজ্জা কী? তুই তো আমারই। তোর সব কিছুই তো আমার। আয় তোকে পরিয়ে দিই’।
সায়েম পারুলের কামিজের বোতামে হাত রাখে। সেদিনই পারুল তার সব লজ্জা বিসর্জন দিলো।
নিজেকে সমর্পণ করলো সায়েমের কাছে। তার নদী মিশলো একটি অবৈধ স্রোতে। ঘোলা জলে নদী অপবিত্র হলো। অভ্যন্তরে বাসা বাধল ভালোবাসা নামক পাপের ফল, অপুষ্ট ভ্রƒণ।
পারুল সায়েমকে জানায় সে মা হতে চলেছে।
বিযের জন্য তাগাদা দেয়। একদিন সায়েম রাজী হয়।
‘চলো আজ আমরা বিয়ে করব’। পারুল কাউকে না জানিয়ে ঘর ছাড়ে। কিন্তু সবই ছিলো সায়েমের ছল।
সে তাকে আত্মীয় বাড়িতে নিয়ে গর্ভপাত ঘটায়। প্রতারিত পারুলকে বলে সব ভুলে যেতে। দয়া করে যে তার জন্য এই উপকারটুকু করল, তার জন্য তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে বলে।
হতভাগী পারুল ফিরে আসে বাবা মায়ের কাছে। গ্রাম্য সালিস, থানা পুলিশ কেউই তাকে সুবিচার দেয়নি।
যেখানে প্রভাবশালীদের দ্বারা সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত, সেখানে সুবিচারের প্রত্যাশা করা বোকামীর নামান্তর। সমাজে অবাঞ্ছিত, লাঞ্ছিত পারুল হারিয়ে ফেলে মানসিক ভরসাম্য। অবশেষে ঠাঁই হয় পাবনা মানসিক হাসপাতালে। পারুলের বাবা জমি বিক্রি করে মেয়ের চিকিৎসা করান। মাত্র ছ’মাসের চিকিৎসায় পারুল সুস্থ হয়।
ফিরে আসে গ্রামে। স্বপ্ন দেখে নতুন করে স্বামী, সংসার, সুখের।
পারুলের বিয়ে হয়। স্বামী সংসার হয়। কিন্তু সুখ মেলে না।
শ্বশুর বাড়ির লোকজন জেনে যায় তার পূর্ব ইতিহাস। স্বামী-শ্বাশুড়ির লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অত্যাচারে পারুল আবারও মানসিক ভরসাম্য হারায়। তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাপের বাড়িতে। আর যাই হোক পাগল বউ নিয়ে তো আর ঘর করা যায় না।
দ্বিতীয়বার পারুলকে চিকিৎসা করানোর মত টাকা তার বাবার নেই।
যেটুকু সম্বল তাতে তাদের এমনিতেই চলে না। পারুল অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। সায়েমের বাড়ির দিকে ছুটে চলে। জোরে জোরে গান গায়, ‘মিলন হবে কতদিনে’, ‘ফাঁকি দিয়া চইলা গেলিরে বন্ধু’, ‘বন্ধু তিনদিন তোর বাড়িতে গেলাম’। ছুটে চলে যায় দূরে।
পারুলকে মুক্ত রাখা সম্ভব হয় না। তার পা শিকল দিয়ে বেধে রাখা হয় সারা দিন রাত। সমাজ তাকে পরিয়ে দিয়েছে লোহার শিকল। এই সমাজ তাকে দেয়নি এতটুকু মানবাধিকার। সরল প্রাণ হয়ে ঠকেছে সে।
প্রতারণার কোন প্রতিকার সে পায়নি। পরিস্থিতি তাকে করে তুলেছে একিউট সাইকোসিস নামের মানসিক রোগী। আজও সে বিশ্বাস করে সায়েম তাকে ভালোবাসে। সে তার কাছেই চলে যেতে চায়। সায়েমের কাছে গেলেই তার সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।
সে আর ‘মিলন হবে কতদিনে গাইবে না। ’
একদিন রাতে সায়েম আসে। পারুলের শিকল খুলে দেয়। বলে, আর কখনো হারাবো না আমি, পালিয়ে যাবো না, আমি চিরকাল তোমারই থাকবো। সায়েম তাকে নিয়ে চলে যায় অনেক অনেক দূরে, যেখানে কেউ তাদেরকে চেনে না।
যেখানে ধনী-গরীবের ব্যবধান নেই।
না। এ শুধু লেখকের কল্পনায় সম্ভব। বাস্তবে কখনো নয়। অদৃশ্য শিকলে বন্দী হাজারো পারুল।
তাদেরকে উদ্ধার করার কেউ নেই।
উৎসর্গ: পারুল
* পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অবলম্বনে।
ঝড়ের শেষে গল্প গ্রন্থের একটি গল্প। প্রকাশক: জ্যোতি প্রকাশ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।