বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী এ নিয়ে শঙ্কার মধ্যে আছেন বেশির ভাগ মানুষ। প্রায় ২০০ বছর আমরা ব্রিটিশের অধীনে ছিলাম, আর দুই যুগ আমাদের শাসন করেছে পাকিস্তানিরা। ঔপনিবেশিক শাসকদের চেষ্টাই থাকে দখলকৃত দেশের জনগণের মধ্যে, যাতে স্বাধীনতার চেতনা মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে, কেবল উগ্র বল প্রয়োগের মাধ্যমে তারা তা দমন করে তা নয়, কৌশলে পদানত জাতিকে চিন্তায়, মননে, সংস্কৃতিতে পঙ্গু করে রাখতে চায়। বাঙালিরা বুদ্ধিহীন, কাপুরুষ, অলস এ ধরনের প্রচার তারই অংশ। অথচ বাঙালিরা কোনো কালেই ভীরু নয়।
এক মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা গোটা বাঙালি জাতিকে বিশ্বাসঘাতক বানাতে পারে না। কারণ তার পর থেকে ২০০ বছরের বাঙালির ইতিহাস উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইতিহাস। বাঙালিরা বারভূঁইয়া, তিতুমীর, হাজী শরীয়তউল্লাহদের বংশধর; ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, তারকেশ্বর দস্তিদারদের উত্তরাধিকার। বাঙালি জাতিরই আছে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, যা অনেক জাতির নেই। আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামকে চীন-ভিয়েতনামের মতো যে কোনো দেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।
কোনো রকম শ্লাঘার অনুভূতি ছাড়াও বলা যেতে পারে, বাঙালি বীরের জাতি। বর্তমানেও জাতিসংঘ শান্তিমিশনে অনন্যসাধারণ ভূমিকা রাখার কারণে বাঙালিরা সারা বিশ্বে বিশেষভাবে প্রশংসিত।
বাঙালিরা বিশেষভাবে প্রশংসা পেতে পারে তাদের জীবন-সংগ্রামে। মাত্র ৫৪ হাজার বর্গমাইলের এই ভূখণ্ডে ১৬ কোটি মানুষের বাস_ এক বিস্ময়কর ব্যাপার। ঘূর্ণিঝড়, সিডর, আইলা এখানকার নিত্যসঙ্গী।
এতে প্রতি বছর মারা যায় হাজার হাজার মানুষ; বিধ্বস্ত হয় উপকূল, লণ্ডভণ্ড হয় জীবন। বিদেশিরা মনে করে, এ যেন এক মৃত্যু উপত্যকা। বুঝি কোনো দিনও আর জীবন ফিরে আসবে না এখানে। অথচ সবাই অবাক-বিস্ময়ে দেখে, মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে করতে এখানে কেমন করে জীবন আবার জেগে ওঠে, পল্লবিত হয়, পত্র-পুষ্পে শোভিত হয়।
বাংলাদেশের যখন জন্ম হয়, তখন এটা একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ।
অর্থনীতি, পরিবহন সবই ধ্বংসপ্রাপ্ত। বাংলাদেশের প্রথম বাজেটের আয়তন ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। আর আজ চার দশক পর বাংলাদেশের বাজেটের পরিমাণ প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা। স্বাধীনতার পর আমাদের মোট খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় এক কোটি টন। আর চার দশক পর সেই উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে তিন কোটি টনের উপরে।
যে মঙ্গা প্রতি বছর এক রংপুরেই কেড়ে নিত অজস্র জীবন, সেই মঙ্গা এখন নেই। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল কত লোক। কিন্তু আজ আর অনাহারে মৃত্যুর কোনো ঘটনা নেই। খেয়াল করা দরকার, সে সময়ের তুলনায় জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ আর চাষের জমি কমেছে প্রায় এক-চতুর্থাংশ।
গত দুই দশকের কথা ধরা যাক।
এ সময়ে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার চার শতাংশের নিচ থেকে ছয় শতাংশের উপরে উঠে এসেছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে তুলনামূলকভাবে আরও বেশি হারে। এখন তা ৯২৩ মার্কিন ডলার, যা ৭৪ হাজার ৩৮০ টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। এর পেছনে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স আর তৈরি পোশাক খাতের মতো রপ্তানিমুখী আয় বড় ভূমিকা রেখেছে। ফলে বাংলাদেশ একটি সাহায্যনির্ভর দেশ থেকে বাণিজ্যনির্ভর দেশে পরিণত হয়েছে।
পণ্য ও সেবা খাতের রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি জিডিপিতে বৈদেশিক সাহায্যের অংশ শতকরা প্রায় ছয় ভাগ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে শতকরা দুই ভাগের নিচে নেমে এসেছে। পণ্য রপ্তানি ও রেমিট্যান্স থেকে নিট বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের পরিমাণ বর্তমানে আমরা যে বৈদেশিক ঋণ পাই তার ১৫ গুণেরও বেশি। চীনের পর বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এ ক্ষেত্রে কৃষিও পিছিয়ে নেই। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন স্বাধীনতা লাভের সময় থেকে বর্তমানে কৃষি ভূমির পরিমাণ কমে গেলেও মেধাবী ও পরিশ্রমী কৃষকের কারণে সাড়ে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার ভিতকে শক্তিশালী করেছে।
খাদ্য আমদানির অপরিহার্যতা দূর করেছে। এ ছাড়া জাহাজ নির্মাণ, ওষুধ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, বস্ত্র, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংসহ তথ্য-প্রযুক্তির সফটওয়্যার রপ্তানিতে ক্রমোন্নতিসহ ছোট-মাঝারি শিল্প খাতেও দেশ এগিয়েছে।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণ তাদের ধৈর্য ও অধ্যবসায় এবং ঘুরে দাঁড়ানোর যোগ্যতা দেখিয়েছে গত বিশ্বমন্দার সময়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলো প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল সেই মন্দার ধাক্কায়; কিন্তু বাংলাদেশ তখনো তাদের অর্থনৈতিক গতি মোটামুটি স্বাভাবিক রেখেছিল। প্রবৃদ্ধির হার ছিল ইতিবাচক এবং এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কৃষি, গার্মেন্ট শিল্প এবং রেমিট্যান্স সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল।
অনেকে অবশ্য বিতর্ক করবেন। কেবল প্রবৃদ্ধির হার দেখেই অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভালো বলা যাবে না। যদি না উন্নয়নের সুফল জনগণের কাছে পেঁৗছতে পারে। সে কথার সঙ্গে আমরা একমত পোষণ করেও এ কথা উল্লেখ করছি এ জন্য, এ থেকে অর্থনৈতিক বিনির্মাণে আমাদের দরিদ্র ও মেহনতি মানুষের অপরিসীম শক্তি বোঝা যাবে। এ কারণেই আমরা বিশ্বাস করতে চাই, বাংলাদেশের আরও এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।
আমাদের নেতারা যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তা কোনো অসম্ভব ব্যাপার নয়। ২০২১ সালের মধ্যে আমাদের পক্ষে মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে ওঠা সম্ভব ছিল। একই বিবেচনা থেকে আমরা বলতে চাই, প্রবৃদ্ধির যে হারের কথা আমরা বলছি, তাতে আমাদের আত্দতৃপ্ত হওয়ার কোনো বিষয় নেই। কারণ এ ক্ষেত্রে আমরা দুই সংখ্যায় পেঁৗছতে পারতাম। পারিনি কেন তার জবাব এ বছরের বাজেট দেওয়ার সময় খোদ অর্থমন্ত্রী বলেছেন।
এ বছরের বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সাত শতাংশের বেশি। কিন্তু অর্থমন্ত্রী বলেছেন, গত বছরের মতো এ বছরও তা ছয় শতাংশে আটকে থাকবে, যদি রাজনীতিতে যে ভয়াবহ সাংঘর্ষিক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তার অবসান না হয়।
রাজনীতি গত কয়েক বছরে ভয়ঙ্করভাবে সাংঘর্ষিক হয়ে উঠেছে। এটা কেবল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের শক্তির বিষয় নয়, যুদ্ধাপরাধের বিচার নয়, এটা প্রধানত ক্ষমতা দখল ও ভোগের কুৎসিত লড়াইয়ের ফসল। এটা খুবই দুঃখজনক যে, স্বাধীনতার চার দশক পরও সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অধীনে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের নিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়নি।
মূল দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রত্যেকেই ক্ষমতাকে মুখ্য মনে করেছে। মুখে বলা হচ্ছে, আমরা শাসক নই সেবক; কিন্তু ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের পর দেখা যাচ্ছে_ দুর্নীতি, লুটপাট, দলীয়করণে প্রতিটি নির্বাচিত সরকার একে অপরকে পাল্লা দিয়ে টপকে যাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। তাদের হাতে রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যেমন দলীয় সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে, তেমনি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। সোনালী ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহ দেউলিয়া হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। এদের হাতে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসনসহ কোনো কিছুই আর নিরাপদ নয়।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো অঙ্গীকারের দুর্বলতা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের শত্রু হলো দুর্নীতি ও দেশপ্রেমের অভাব। আমাদের রাজনৈতিক দল দুটি অঙ্গীকারে খুবই পারদর্শী। একেবারে বিবেচনা-বর্জিত। ভোটের চিন্তা করে তারা অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করে, কেবল অঙ্গীকার করে থাকে।
বাস্তবায়নের কথা মাথায় আনে না। রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে দেখুন, ক্ষমতায় যাওয়ার আগে তারা যে অঙ্গীকার করেছিল তার অধিকাংশই অবাস্তবায়িতই থেকে যায়। উন্নয়নের জন্য দরকার মানবসম্পদ। আমাদের তা আছে, কিন্তু আমরা তাকে কাজে লাগাই না। আমাদের শাসকরা নিজের সন্তানকে যত ভালোবাসে দেশের জনগণকে তত ভালোবাসে না।
দেশের জনশক্তিকে সম্পদে পরিণত করার তেমন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় না। জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে যদি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিশেষ যত্ন নেওয়া হতো, তাহলে গার্মেন্ট, রেমিট্যান্স এমনকি কৃষি খাত থেকে আমাদের আয় আরও বাড়ানো সম্ভব ছিল।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ব্যবস্থাপনা-দক্ষতা একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। এ জন্য প্রশাসনকে যোগ্য করে গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। উন্নয়নের জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগ অধিকাংশেই অঙ্কুরে বিনষ্ট হয় প্রশাসনের স্বার্থপরতা ও নিরপেক্ষতাহীনতার কারণে।
আমাদের প্রশাসনকে এক কথায় দুর্নীতিবাজ ও জনস্বার্থ-বিরোধী বললে ভুল হবে না। এটা পাকিস্তান আমল থেকেই ছিল। হয়তোবা ব্রিটিশ আমল থেকে। এক মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই প্রশাসনে কোনো পরিবর্তন তো আসেইনি, বরং বড় দুটি দলের ক্ষমতার লড়াই ও প্রশাসনকে নগ্নভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে। এতে দুর্নীতি কমেনি বরং বেড়েছে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনায় নির্বাচিত দলের পরিবর্তন স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশে এখন এই পরিবর্তনের অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে প্রশাসনের ওপর। প্রশাসনের নিম্নস্তর পর্যন্ত দলের লোকদের বসাতে গিয়ে যোগ্য-অযোগ্য বিচার করা হচ্ছে না। সৎ-অসতের বাছ-বিচার বিবেচনায় আনা হচ্ছে না। ফলে প্রশাসন হয়ে পড়েছে দুর্নীতিবাজ ও দলবাজদের আখড়া।
লেখাটি শুরু করেছিলাম বংলাদেশের ভবিষ্যৎ কি এ প্রশ্নকে সামনে নিয়ে। সাধারণত আমরা সমালোচনা পছন্দ করি। আর সমালোচনায় সাধারণত নেতিবাচক দিক বেশি থাকে। নিশ্চিতই বাংলাদেশের অনেক সমস্যা আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো রাজনৈতিক সমস্যা।
কিন্তু সেই সমস্যার মধ্যেও আমাদের অনেক অর্জন আছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার কিছু লক্ষ্য আমরা নির্দিষ্ট সময়ের দুই বছর আগেই অর্জন করেছি, যা সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশের সম্ভাবনা নিয়ে নোবেল-জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ভারতের চেয়ে বেশি আশাবাদী। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়নকে বিশ্বের জন্য মডেল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
আমাদের আশাবাদী হওয়ার তাই সঙ্গত কারণ আছে।
কিন্তু সেটাকে আমরা সতর্ক আশাবাদ বলতে চাই। সতর্কতা এ জন্য যে, ক্ষমতার উদগ্র মদমত্ততা, ভয়াবহ সাংঘর্ষিক রাজনীতি আমাদের সব অর্জন ধ্বংস করে দিতে পারে। এখনই সময় সিদ্ধান্ত নেওয়ার- এই দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি বর্জন করার।
লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য
ই-মেইল : mrmanna51@yahoo.com
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।