আমেরিকান ক্রনিকল-এর মন্তব্য
বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটিগুলো এখনো তাদের রিপোর্ট দেয়নি। কিন্তু যথাযথ তদন্ত হবে কি না কিংবা দোষীদের শনাক্ত করা হবে কি না তা নিয়ে ইতোমধ্যেই সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে আমেরিকান ক্রনিকল মন্তব্য করেছে, এই রিপোর্ট সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রিপোর্টটির গুরুত্বপূর্ণ অংশ এখানে তুলে ধরা হলোঃ
বাণিজ্যমন্ত্রী লে. কর্নেল (অবঃ) ফারুক খান সম্প্রতি বলেছেন, বিডিআর হত্যাযজ্ঞ শুধু একটা ‘বিদ্রোহ’ ছিল না, এটা ছিল বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে অস্থিতিশীল করার একটি গভীর ষড়যন্ত্র। এখন পর্যন্ত ৮৪১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সংগৃহীত ১ হাজার ২০০ গুরুত্বপূর্ণ আলামত পরীক্ষা করা হচ্ছে এবং অপরাধ হয়েছে এমন ৬৬টি স্থান চিহ্নিহ্নত করা হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
এটা ছিল মন্ত্রীর পঞ্চম দফার পরিবর্তিত ভাষ্য। তিনি বিদ্রোহ তদন্তে গঠিত তিনটি কমিটির প্রধানও।
মন্ত্রীর সর্বশেষ ভাষ্যে ‘বিদ্রোহ’ এখন ‘হত্যাযজ্ঞে’ পরিণত হওয়ায় অনেকে মনে করছেন রক্তাক্ত ঘটনাটির ব্যাপারে এটাই সবচেয়ে যথাযথ পরিভাষা। এতে করে ‘বিদ্রোহে’ সংশ্লিষ্টদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত সাধারণ ক্ষমা থেকে সংশ্লিষ্টরা লাভবান হতে পারবে না, কারণ এটা বিদ্রোহ ছিল না, ছিল পূর্ব-পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ।
এখানে ওই ঘটনা সম্পর্কে বাংলাদেশী ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এড়িয়ে যাওয়া কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারেঃ
১. হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে নয়টায় (পার্লামেন্টে শেখ হাসিনা এবং পিলখানায় বেঁচে যাওয়া কয়েকজন কর্মকর্তার ভাষ্যেও তা নিশ্চিত হওয়া গেছে)।
২. স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক তার সহকর্মী মির্জা আজম এমপিকে নিয়ে বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যদের সাথে ‘আলোচনার’ জন্য দুপুর পৌনে ৩টায় বিডিআর সদর দফতরে গিয়েছিলেন।
৩. বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে বিদ্রোহী সৈন্যদের ১৪ জনের একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল।
৪. দুপুর আড়াইটায় ঢাকা সেক্টর কমান্ডার কর্নেল সৈয়দ মুজিবুল হক ও ৩৬ রাইফেল ব্যাটালিয়ন কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল এনায়েতের লাশ নবাবগঞ্জ ড্রেনে পাওয়া যায়।
৫. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ততক্ষণে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন এবং ঘাতক প্রতিনিধিদলটি যখন তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল তখন তিনি তাদের বিষয়টি জিজ্ঞাসা করেছিলেন।
৬. প্রধানমন্ত্রী বিডিআর’র উপসহকারী পরিচালক তৌহিদুল ইসলামকে (অন্যতম হোতা) উদ্ধার করা লাশ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি, ‘ডিজিসহ কয়েকজন অফিসারকে’ হত্যার কথা স্বীকার করেন।
৭. প্রধানমন্ত্রী নিহত অফিসারদের নাম বা তাদের লাশের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাননি, যদিও নিহতদের লাশ হস্তান্তর, জীবিত ও তাদের পরিবারবর্গ সম্পর্কে তথ্য সরবরাহের পূর্বশর্তারোপ ছাড়াই তিনি সন্ধ্যা ৬টায় বিদ্রোহীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন।
৮. যদিও সন্ধ্যা ৬টায় সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয় এবং বিডিআর সদস্যরা টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ও একই সাথে প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে ফিরে আসা তাদের প্রতিনিধিদলের মাধ্যমে সাধারণ ক্ষমার বিষয়টি জেনে গিয়েছিল কিন্তু তবুও বিডিআর সদর দফতরের অভ্যন্তরে গুলিবর্ষণ বন্ধ হয়নি। সাধারণ ক্ষমার সুযোগে অফিসার ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর হত্যা ও বর্বরতা অব্যাহত থাকে।
৯. প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত সাধারণ ক্ষমার আওতায় সব অপরাধ থেকে ক্ষমা পাওয়া যাবে এটা জেনে জওয়ানরা ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতের আঁধারে সেনা পরিবার সদস্যদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে।
১০. গত ১ মার্চ বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী হঠাৎ করেই ১০০ শতাংশ রেশন পাওয়া শুরু করে।
বিডিআর’র ২২ দফা দাবিরও একটি ছিল এটা। তাহলে কি পুলিশ বাহিনীতেও একই ধরনের ঘটনার আশঙ্কা সংক্রান্ত কোনো বিশ্বস্ত গোয়েন্দা তথ্য ছিল? যদি হয় তবে কোন সূত্র থেকে? নাকি সরকারের শক্তিশালী কোনো মহল থেকে নির্দেশনা পেয়ে বিডিআর সদর দফতর থেকে বিদ্রোহীদের পালানোর সুযোগ দেয়ার ‘সহযোগিতা’ করার ‘পুরস্কার’ ছিল এটা?
১১. ‘বাংলাদেশ মিলিটারি ফোর্সেস’-এর ওয়েবসাইটে (http://www.bdmilitary.com) পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী ‘আপনি কি মনে করেন সরকার বিডিআর হত্যাযজ্ঞের তদন্ত নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করছে?’-এ প্রশ্নের জবাবে ৮০ শতাংশের বেশি ‘হ্যাঁ’ জবাব দেয় ও মাত্র ১২ শতাংশ ‘না’ জবাব দেয়। এটা কি বাংলাদেশী জনগণের মনের কথা প্রতিফলিত করে? যদি হ্যাঁ হয়ে থাকে, তবে অবশ্যই ঘটনাটির ‘নিরপেক্ষ’ তদন্তে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার দৃঢ় যুক্তি রয়েছে।
১২. এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক রহস্যজনক অসুস্থতায় হঠাৎ করেই বাংলাদেশ ত্যাগ করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে তার ‘শারীরিক অবস্থা’ সম্পর্কে আর একটি শব্দও পাওয়া যায়নি বা তিনি সিঙ্গাপুরের কোন মেডিক্যাল সেন্টারে চিকিৎসা নিচ্ছেন সে ব্যাপারে প্রশাসনের কেউই কোনো কথা বলেনি।
১৩. সিঙ্গাপুরে অনেক প্রবাসী নানককে সে দেশের অনেক স্থানে ‘বেশ ভালো’ ও ‘অত্যন্ত স্বাস্থ্যবান’ অবস্থায় দেখেছেন। ক্ষমতাসীন দলের আরো অন্তত চারজন প্রভাবশালী ব্যক্তি গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ত্যাগের চেষ্টা করেছিলেন, যাদের নাম রক্তাক্ত হত্যাযজ্ঞটির সন্দেহভাজন বিপথগামী হিসেবে এসেছে।
১৪. বিমানবন্দরে বিশেষ ব্যবস্থায় বেশ কয়েকজন ‘বিদ্রোহীকে’ দেশ থেকে পালাতে সাহায্যকারীদের নাম খুঁজে বের করতে সরকার কোনো তদন্ত করেনি। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছোট ভাই জি এম কাদের বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন। কাদের ইতোমধ্যেই জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরে আওয়ামী লীগের প্রতি অনুগত হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।
১৫. বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোকে বিডিআর হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কিত যেকোনো ধরনের কভারেজ বা ফলোআপ রিপোর্ট বন্ধে সম্ভাব্য সব উদ্যোগ গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ ধরনের পদক্ষেপের ফলে অনেক ধরনের বিভ্রান্তি ও সন্দেহের সৃষ্টি করতে পারে।
১৬. বিডিআর হত্যাযজ্ঞে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া আওয়ামী লীগের নেতা তোরাব আলী আখন্দ ও তার ছেলে হঠাৎ করেই মিডিয়া কভারেজ থেকে সরে গেছেন। ইতঃপূর্বে বলা হয়েছিল, হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে তোরাব আলী স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে রাজি ছিলেন। কিন্তু সিআইডি সন্দেহজনকভাবে তাকে স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতি দেয়ার সুযোগ প্রদান বা হঠাৎ করে তাকে ‘মিডিয়া নিঃসঙ্গ’ করার বিষয়টি খুবই কৌতূহলজনক।
তোরাব আলীকে জিজ্ঞাসাবাদে যেসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যায় তিনি হত্যাযজ্ঞের সাথে জড়িত হিসেবে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলটির হেভিওয়েট অনেক ব্যক্তির ইঙ্গিত দিয়েছেন। তোরাবকে মিডিয়া থেকে দূরে রাখার বিষয়টি ক্ষমতাসীন দলের লোকদের হত্যাযজ্ঞে জড়িত থাকার দায়ে কোর্ট মার্শাল থেকে রক্ষার প্রয়াসের অংশ হতে পারে।
বিডিআর হত্যাযজ্ঞে যথাযথ তদন্ত এবং হত্যাকারী, সহযোগী ও প্ররোচনাকারীদের দ্রুত বিচার ইতোমধ্যে বাংলাদেশের জনগণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর রিপোর্টের জন্যও প্রতীক্ষা করা হচ্ছে। সবাই মনে করছে এটাই হবে নিখুঁত, পক্ষপাতহীন ও নিরপেক্ষ।
(নয়া দিগন্তের সৌজন্যে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।